জীবনের ডায়েরী থেকে গল্প সমগ্র : শেষ পর্ব

ড. তাইবুন নাহার রশীদ (কবিরত্ন),

(গত পর্বের পর) : বাড়ীতে ভাল বাবুর্চি। কাজের ছেলে ৪ জন, কাজের মেয়ে ৪ জন। আর নোয়াখালী থেকে মা আমাদের বাবুর্চিকে পাঠিয়ে তিন-চার জন মেয়ে একশত টাকা দিয়ে ক্রয় করে আনতেন। ওরাও অনেক কাজকর্ম করত। ওরা বড় হলে মা ওদের ভাল ছেলে দেখে বিয়ে দিয়ে দিতেন। এত লোকজন থাকা সত্ত্বেও বাবা আমার পড়াশুনা বন্ধ করে দিয়ে খেলা-ধূলার সাজ-সরঞ্জাম কিনে দিয়ে মাসিক মোহাম্মদী ও আনন্দবাজার পত্রিকা রেখে দিয়ে বললেন, বাসায় বসে পড়াশুনা কর। ভাল চিঠিপত্র লিখতে পার, ভাল ভাল বই পড়ে শোনাতে পার, মেয়েদেও আর বেশী পড়ে কি লাভ ? বাবার কথা শুনে নিরবে কাঁদলাম। কত ইচ্ছে ছিল আমি বড় বড় ডিগ্রী নিব।
বাবা বিকেলে ক্লান্ত শান্ত হয়ে ঘর্মাক্ত হয়ে ফিরতেন। বাবাকে পাখার বাতাস দিতাম। আমার মাকে আমি কোনদিন সুস্থ্য দেখি নাই। সব সময় পালঙ্কে তাকে শুয়ে থাকতে দেখেছি। দেখেছি বাবা কোর্ট থেকে ফিওে এসে মায়ের পায়ের কাছে বসে মার শরীরের কথা মৃদুমন্দভাবে জিজ্ঞাসা করতেন তার সেই ¯েœহসুলভ কথা আজও আমার কানে বাজে। আমার আজও মনে পড়ে মাকে ও বাবাকে। দু’জনকে ভিন্ন পালঙ্কে শুতে দেখেছি। একসাথে কখনও কোনও দিন, কোন সময় শুয়ে থাকতে দেখিনি। প্রেম ভালবাসার কোন অভিনয় করতে দেখিনি। বাবা বলতেন, তোর মাকে ঠিক মত ঔষধ খাইয়েছিস ত, গা মুছে দিয়েছিস, মায়ের সেবা করিস। আমি আমার মার খুব সেবা করেছি। সে জন্য আমি এত নাম, সম্মান, মর্যাদা পেয়েছি। একটি গান গাও তো মা। এখনই ত গিয়ে আবার মক্কেল নিয়ে বসতে হবে। বৈঠকখানায় যাবার আগে বলতেন তিনি। সেই ফিরতে রাত ১২টা বাজবে।
অনেক রাতে বাবা বৈঠকখানা থেকে ফিরে আসতেন। আমার বয়স তখন ১০ বছর। ঘুমে ঢুলঢুলু হয়ে বসে থাকতাম। কখন বাবাকে কাছে বসে খাইয়ে-দাইয়ে সারা ঘরদোর খুজে দেখে শুতে যাব। এই ছোট বয়সেও যেন আমার মাথার উপর এক গুরু দায়িত্বভার বহন করে আমি অহনিশি দাড়িয়ে আছি আমার মা-বাবার সেবা শুশ্রুষা ও যতেœর জন্য।
বাবা অনেক রাতে ফিরতেন, তখন রাত ১২টা কি ১টা হবে। মা তখন রোগশয্যায় ক্লান্ত হয়ে হয়তঃ একটু চোখের পাতা এক করেছেন। আমি তখন বাবাকে কাছে বসে এটা ওটা পাতে তুলে দিয়ে মায়ের মত ¯েœহ আদর করে খাইয়ে দরজা-জানালা বন্ধ করে লোহার সিন্দুকের চাবি আবার গদির নিচে থেকে অন্য জায়গায় সরিয়ে রেখে শুতে যেতাম।
খুব ভোরে ফজরের নামাজের আজান হওয়া মাত্রই বাবা ঘুম থেকে উঠে নামাজ পড়ে এসে বাবা আমাদের দু’বোনকে ডেকে তুলতেন। যদি আলস্য করে ঘুমিয়ে থেকেছি, বাবার সরু বোতলে বেতের লাঠির একটা দন্ড আমাদের গা স্পর্শ করত। বাবা বলতেন, এ তবু, এই আম্মু তোরা শীঘ্রই বাইরে বেড়িয়ে আয়, শরীর ভাল থাকবে। কোথায় বেড়ানো টেড়ানোর নামে ঘুম থেকে উঠেছ হিন্দু প্রতিবেশীর বাড়ীর ফুল চুরি করে এনে বাসায় বসে বসে ফুলের মালা গাঁথতাম। তখন সেই ছোট বেলায় বুঝতে পারিনি হাটা-চলাফেরা করা স্বাস্থ্যের জন্য কত মূল্যবান। বিকাল বেলা বাবা কোর্ট থেকে ফিরে দেখতেন আমি শুয়ে শুয়ে গল্পের বই পড়ছি। বাবা খুব বকতেন। বলতেন, যাও ব্যাডমিন্টন খেল, স্কিপিং কর, ফুটবল নিয়ে খেল, না হয় হাটা-চলা কর। কিন্তু আমার অসম্ভব বই পড়ার নেশা ছিল, অনেক রাত পর্যন্ত জেগে জেগে হারিকেন জ্বালিয়ে বই পড়তাম।
বাবা কোর্ট থেকে ফিরে এসে বলতেন, তবু কই ? মা বলতেন, এই দ্যাখেন গিয়ে আইন পড়ছে। বাবা বলতেন, আহা তোমাকে দেখাশুনা করার জন্য মেয়েটার পড়াশুনা ছাড়িয়ে দিলাম, আর তুমি বলছ- আইন পড়ছে। পড়াশুনা না করলে, কি নিয়ে থাকবে ?
ছোট বেলায় কোন দিন আমাদের বৈঠকখানায় আমরা পড়াশুনা করতে পারিনি। অন্য উকিল সাহেবরা বাসায় গিয়ে পন্ডিত-মাষ্টারের কাছে পড়াশুনা করেছি। তখনকার দিনের বি.এ, এম.এ পাশ। ভাল ব্রাহ্মণ মাষ্টার পন্ডিতদের কাছে লেখা পড়া করেছি। যতদিন স্কুলে পড়েছি, ততদিন বাবা আমাদের দু’বোনের জন্য বড় বড় বিদ্বান লোক দিয়ে আমাদের পড়াশুনা করিয়েছেন।
কোরআন শরীফ তিন-চার বার পড়েছি। খতম করেছি তাও কোরআনে হাফেজ দিয়ে। বড় বড় গানের মাষ্টার রেখে বাবা আমাকেও আমার বোনকে গানের তালিম দিয়েছেন। বাবার রেখে যাওয়া স্মৃতি আজও আমার মনে পড়ে।

ফেসবুকে লাইক দিন

আমাদের সাইটের কোন বিষয়বস্তু অনুমতি ছাড়া কপি করা দণ্ডনীয় অপরাধ।