মধ্যরাত : পর্ব-২৫৩
ড. তাইবুন নাহার রশীদ (কবিরত্ন),
(গত পর্বের পর) : তখন রাত অনেক অনেক হয়ে যাচ্ছিল। উমা এসে আমাকে ও হেমন্তকে বলে গেল এখন তোমরা ঘুমাও। রাত অনেক হল। হেমন্ত অসুখ থেকে উঠেছে, এত রাত পর্যন্ত কথা বললে শরীর খারাপ হবে। হেমন্ত কম্বলটা গায়ে জড়িয়ে শুয়ে পড়ল। আমি বাতিটা নিভিয়ে আমার রুমে গেলাম।
ডোরার চিঠিটা বার বার ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখলাম। কত স্মৃতি বিজরিত মুগ্ধ রাতের বিচিত্র প্রেম ভালবাসার কল্প কথা আমার স্মরণ করিয়ে দেয়। অনেক অনেক ভালবাসার কথা। কতদিন কতদিন, কত রাত আমি দোলার কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পরেছি। কত হাজার বছর ধরে আমার আজ তা মনে নেই। কিন্তু ডোরার কি মনে পড়ে ? মানুষ কি কেবল বিয়ে করলেই মানুষকে ভালবাসে ? বিয়ে না করলে কি ভালবাসা য়ায় না ? আজ নিজকে বড় অসহায় বলে মনে হয়। সুশান্ত যখন বেঁচে ছিল তখন ওর কাছে দু-চারটি মনের কথা বলেছি, এখন কেউ নেই যে গভীরতম প্রদেশের দু-চারটি কথা বলার মত। আগে উমা ঠাট্টা করত, ডোরাকে নিয়ে এখন উমা সুশান্ত মরে যাওয়ার পর থেকে ডোরার কথা নিয়ে কোন উচ্চ-বাচ্চ করে না।
আর আমি স্বার্থপরের মত ডোরার কথা উমার কাছে বলতে লজ্জা পাই। অথচ ডোরা আমার সমস্ত হৃদয় জুড়ে বসে আছে। ডোরাকে আমি মুছে ফেলতে পারি না। ডোরাকে আমি দোষী করি বটে, কিন্তু সেওত বলে আমার জন্য সমস্ত জীবন সে পথ চেয়ে বসেছিল। জানি না ভবিতব্য জানেন কিন্তু কেন ? আমরা বিয়ে করলাম না। ডোরাও বলে কেন ? আমরা বিয়ে করলাম না। আমিও বলি কেন ? এই কেনর কোন উত্তর নেই ? আজ ডোরাকে সহজে সচ্ছন্দ বলতে পারি না, ডোরা আমার কাছে এসে থাক। ডোরাও থাকতে চায় না। যতই বলি আমরা ওটা একটা ডিসিপ্লিন বাধন সংস্কার বা কুসংস্কার, বিয়েটা একটা ডিসিপ্লিন। কিন্তু ওটা একটা মস্তবড় বাঁধন। আইনগত ধর্মীয় নীতি। আমাদের রক্তের শিরায় শিরায় মজ্জায় মজ্জায় আমাদের পূর্ব পুরুষও আমাদের মধ্যে মিশে গেছে। এটাকেও কেউই অস্বীকার করতে পারবে না। এই বিংশ শতাব্দির যুগে আমিও অস্বীকার করতে পারি না। আমার মা-দিদি-মা, তার মা দিদিমা, সকলেই সকলেই এ পথে ধর্মের শাসন মেনে এসেছে। যতই শিক্ষার দাবী করি, যতই বলি কুসংস্কার, যতই বলি মন্ত্রপড়ে আগুন সাক্ষী করে একটি মেয়েগে গ্রহণ করা ওটা একটা ডিসিপ্লিন, কিন্তু আজ দেখছি ওটা একটা শান্তি ও স্বস্তিও বটে। মনের কোনায় একটা মস্ত বড় দাগ কেটে দেয় সেই শুভক্ষণের। শুভলগ্নে বিয়ে ও বা মন্ত্রপড়া আগুনের সামনে নিয়ে ১০ জনের সামনে ভগবানকে সাক্ষী করে একটি অবলা অবুঝ মেয়েকে গ্রহণ করা। আজ আমি তা ব্যি চক্ষে অনুধাবন করছি, এর অনেক অনেক মূল্য, সমাজ ও ধর্মে এবং রাষ্ট্রে কাছে।
ঊড় ঘড়িটায় ১২টা বাজার ঘণ্টা পরল। তাড়াতাড়ি বিছানায় শুয়ে পরলাম। শুয়ে শুয়ে চিন্তায় চিন্তায় আমার যেন একটু তন্দ্রা এল। কতক্ষণ তন্দ্রায় আচ্ছন্ন ছিলাম বলতে পারছি না। হঠাৎ গলার আওয়াজ আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। প্রশান্ত দা, প্রশান্ত দা, আমি কি স্বপ্ন দেখলাম। আমার মা মরে গেছে, আমি তাকে চিন্তায় দাহ করছি। আমি ধরমড়িয়ে উঠে বসলাম। ঘড়ি দেখলাম, ছোট্ট টেবিলটায় তেমনি ছোট গ্লাসে করে জল ঢাকা আছে। ঢক ঢক করে খেয়ে নিলাম। হেমন্তের কাছে গিয়ে মাথায় হাত রাখলাম। বললাম কি অত চেচাঁমেচি করছ কেন ? ও বলল বললাম তো, আমি বললাম- ও সব স্বপ্ন সব মিথ্যা। ও বলল, মিথ্যা হতে পারে না। আমি দেখলাম আমার মা মরে গেছে। আমি তাকে মুখাগ্নি করছি। উমাও পাশের ঘর থেকে উঠে এল। কি হয়েছে দাদা। আমি বললাম, স্বপ্ন-স্বপ্ন চিঠি লিখে দেয়। তোমার মা দিব্বি ভালো আছেন। উমা নীরবে এসেছিল, আবার নীরবে চলে গেল। আমি হেমন্তের পাশে বসে বললাম, ঘুমো; অতো চিন্তা করো না। রাত জেগোনা, হেমন্ত ফুলে ফুলে কাঁদতে লাগল। আমি বললাম, কি মা পাগলা ছেলেরে বাবা।
(চলবে——–)