সর্বশেষঃ

স্মৃতি’র চিঠি

এম.অলিউল্যাহ হাসনাইনঃ ১৪০৯ খ্রিস্টাব্দ ফাল্গুন মাস। নতুন করে প্রকৃতিকে সাজিয়েছে বসন্ত। ফাগুনের হাওয়ায় মনকে দোলা দিয়ে যাচ্ছে অনবরত। সবে মাত্র ক্লাশ টেইনে পড়ছে হৃদয়। আবেগ, উৎকন্ঠার মধ্য দিয়ে সময় কাটছে হৃদয়ের। উদাসীনতায় নিজেকে একাকিত্ব মনে হচ্ছে। প্রকৃতিতে ঘুরে বেড়াতে সাচ্ছন্দ্যবোধ হচ্ছে। আর এই প্রকৃতির রঙের সাথে হঠাৎ ভালোলেগে যায় স্মৃতি’কে।

স্মৃতি’র সাথে প্রতিদিন দু/এক বার দেখা হয় হৃদয়ের। স্মৃতি’কে দেখার তৃপ্তিতে ভালোলাগার অনুভূতি কয়েকগুণ বেড়ে যায় হৃদয়ের।
স্মৃতি যেন এক অপরুপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি। প্রকৃতির একচ্ছ মেয়ে। বণহরিনির মতো ছুটে বেড়ায় স্মৃতি। হিত চঞ্চলা ষোড়শী।
আজ ১৪ই ফেব্রুয়ারী (ভ্যালেনটাইনস ডে) ১লা ফাল্গুন। বিকাল ৫ঃ২৫। গ্রামের মেঠোপথ, চারিদিক কুয়াশায় ধোয়ার মতো করে ঘির আসছে। সরু পথ,পথের দুই পাশে ধান ক্ষেত। হৃদয় একাকী হাটছে। রাস্তার ওপ্রান্তে হঠাৎ চোখে পড়লো পরী প্রতিচ্ছবি। জনমানব শূন্য নিস্তব্ধ গোধূলি মাখা গ্রামীন জনপদে আঁতকে উঠল হৃদয়। দুজন দুদিক থেকে হাটছে,আর ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে প্রতিচ্ছবি। হৃদয় চিনতে পেরেছে যে এ স্মৃতি। লাল-নীলের সমন্বয়ে নকশি করা শাড়ি পড়া। কুয়াশাচ্ছন্ন সবুজে ঘেরা প্রকৃতিতে যেন বাস্তবিক পরী। কাছাকাছি আসতেই স্মৃতি’র সৌন্দর্য দেখে হৃদয় বাকরুদ্ধ প্রায়। কপালে লাল টিপ, ঠোঁটের লাল লিপস্টিকের হাসিতে যেন হৃদয়কে মুগ্ধ করেছে। হৃদয় আজ শুধু স্মৃতি’কে দেখছে। দেখার তৃপ্তিতে কথা হাড়িয়ে ফেলেছে হৃদয়।
স্মৃতি হৃদয়কে জিজ্ঞেস করলো কেমন আছেন?
হৃদয়ঃ ভালো। তুমি কেমন আছো?
স্মৃতিঃ ভালো।
হৃদয়ঃ কোথায় থেকে আসলে?
স্মৃতিঃ লায়লা ফুফুদের বাসা থেকে।
সামান্য কুশল বিনিময় করে চলে গেল স্মৃতি।
হৃদয় অপলক তাকিয়ে স্মৃতির চলে যাওয়া দেখছে।যেন প্রজাপতির মতো নেচেনেচে যাচ্ছে। হৃদয় তাকিয়ে আছে আর স্মৃতি’কে নিয়ে কল্পনা করছে। ভালোবেসে ফেলেছে স্মৃতি’কে।
কিন্তু কিভাবে বলবে স্মৃতি আমি তোমাকে ভালোবাসি। ভাবতে ভাবতে রাত কেটে গেল। হৃদয় কি করবে ভেবে পাচ্ছেনা। স্মৃতি’কে ভালোবাসার কথা বলারও সাহস পাচ্ছেনা। হৃদয়,স্মৃতি’কে চিঠি লিখছে।

প্রিয় স্মৃতি,
ঘনায়মান সন্ধ্যার অপরূপ রূপের মাধুর্য ধরে রাখার ক্ষমতা আমার হৃদয়ের নেই। এই অনুভূতি প্রকাশের কোনো ভাষা আমার জানা নেই। জানা নেই তোমার মনের গোপন রহস্য। বুঝতে পারিনি তোমার মিষ্টি হাসির সারকথা। তবে জানি, ভালোবাসার অন্তহীন বিবর্তনের মধ্যেও সুখ উঁকি দেয় মনের কোণে। তোমাকে বোঝাতে চেয়েছিলাম জনমানবহীন নিঝুম দ্বীপের নিঃসঙ্গতা। তোমার কি ভালোবাসার কোনো অভিজ্ঞতা আছে? কখনো কি বুঝতে পেরেছ আমার হৃদয়ের অনুভূতি?
দু’টি মনের টান, অব্যক্ত কথামালা, একটু দেখার আকুলতা, পাশাপাশি থাকার ব্যাকুলতা, স্নিগ্ধ ভালোলাগা, স্বপ্ন ছুঁয়ে যাওয়ার নামই যে ভালোবাসা, তা আজ আমার অবুঝ হৃদয় গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছে। একটু একটু করে নরম রোদ ছড়িয়ে পড়েছে নীল আকাশে। একইভাবে তোমার ভালোবাসা আমার নিউরনের প্রতিটি কণায় ছড়িয়ে দিচ্ছে ভালোলাগার বার্তা। স্মৃতির অতলে ডুব দিয়ে পেলাম একটি লাল গোলাপ। সেদিনের কথা খুব মনে পড়ছে এখন। শেষ বিকেলের কুয়াশাচ্ছন্ন আভায় সৃষ্টির অপরুপ সৌন্দর্যে আবির্ভূত হলে তুমি। বাড়ি ফিরলাম আবেগঘন অনুভূতিতে, মন ছিল তোমার ভালোবাসায় অস্থির। নানা স্মৃতি,নানা রঙে,নানা সুরে গান গেয়ে জানান দেয় তোমার কথা। তাই তো সবুজাভ খামে ভরে ভালোবাসার আমন্ত্রণে প্রেমের রঙিন চিঠি দিলাম তোমার ঠিকানায়।

হয়তো আর দেখা হবে না, কথা হবে না বহুদিন। তারপর হয়তো একদিন দেখা হবে। তখন আমার আবেগের চাহনি দেখে বুঝে নিয়ো ভালোবাসার গভীরতা। দূর থেকে চাইব ভালো থেকো সব সময়।
হৃদয়
১৪.০২.২০০৩ ইং

হৃদয়ের লেখা চিঠি স্মৃতি’কে দিতে পারেনি।পড়ালেখার জন্য চলে গেলো ঢাকায়। স্মৃতিকে লেখা প্রথম চিঠিতে কত আবেগ, কত রোমাঞ্চ আর ভালোবাসা ছিল। স্মৃতিকে লেখা হৃদয়ের প্রথম চিঠিই ছিল শেষ চিঠি।

চিঠিটা গন্তব্যের পথ ভুল করে চলে যায় স্মৃতির বাবার কাছে। স্মৃতিকে না বলা অব্যক্ত কথাগুলা পর্যন্ত বলা হয়নি। চিঠির গন্তব্য ভুল হওয়ার ফলাফল আমরা পাঁচ বছর আলাদা। দীর্ঘ এই সময় পরে বাবার কাছে যাওয়া চিঠির গল্প স্মৃতির কাছে পৌঁছায়। শুনে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারেনি স্মৃতি। ভালোবাসার মায়াজালে আবদ্ধ করেছে স্মৃতিকে। অপেক্ষার আলিঙ্গন যে এভাবে হবে, কখনো ভাবতে পারিনি। ভালোবাসি তোমাকে। জয় হয়েছে ভালোবাসার প্রথম চিঠির।

সুখ সাচ্ছন্দে কাটতে লাগলো দু’জনের সময়। যেন ভালোভাসা এক গতিশীল প্রক্রিয়া। মাঝে মাঝে দেখা হয় সেই মেঠোপথে। কথা হয় বর্তমান-ভবিশ্যত নিয়ে। তারা দুজন কল্পনা করে ভবিশ্যত নিয়ে।

কয়েক দিন হলো স্মৃতির দেখা নেই। স্মৃতি চলে যেতে বাধ্য হলো বাবার নির্বাচিত নতুন ঠিকানায়।প্রতিবাদের ভাষা জানা নেই স্মৃত,র। কখনো যে বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে সাহস পায়নি। আজও জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে নিরবতা ছিন্ন করতে পারেনি স্মৃতি। জিন্দা লাস হয়েই অনাকাঙ্ক্ষিত ভবিষ্যতে পা বাড়াতে হলো।

শেষ দিন স্মৃতি’র সাথে যখন শেষবার কথা হয়েছিল, ঠিক তখনো ভাবতে পারিনি, অন্য কারও হয়ে গেছে স্মৃতি। এত প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পরও আমাকে নিশ্ব করে চলেগেলে? কথা ছিল জীবনের শেষ সূর্যাস্ত একসঙ্গে দেখার। সারা জীবন পাশে থেকে ঝগড়াঝাটি আর সংসার করার। অথচ আমি কী বোকা! আমি বিশ্বাস করেছিলাম, মানুষ কথা দিলে সেটা রাখে। আজও মনে একটাই প্রশ্ন, কেন না বলে চলে গেলে? নিজের দোষটুকু যদি জানতে পারতাম, তবে তাই নিয়েই ভালো থাকার চেষ্টা করতাম। আমাকে রেখে গেলে ঘোর তমসাচ্ছন্ন আঁধারে।

আজো নিজের অজান্তে স্মৃতির চিঠি রাখার নির্দিষ্ট জায়গায় কি যেনো খোঁজে হৃদয়। নিঃসঙ্গ একাকী হাটছে হৃদয়। চোখে পড়ে স্মৃতি’র নিশানায় চিঠির ভাজে সাদা একটা চিরকুট। যাতে লেখা
“ক্ষমা করো আমায়”।

 

এম.অলিউল্যাহ হাসনাইন
সহকারী শিক্ষক
চন্দ্রপ্রসাদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়
ভোলা সদর-ভোলা।

ফেসবুকে লাইক দিন

আমাদের সাইটের কোন বিষয়বস্তু অনুমতি ছাড়া কপি করা দণ্ডনীয় অপরাধ।