জীবনের ডায়েরী থেকে গল্প সমগ্র : পর্ব-৮৮

ড. তাইবুন নাহার রশীদ (কবিরত্ন), 

(গত পর্বের পর) : আমার মা :
মা নাই গৃহে যার
সংসার অরণ্য তার
দেখিলে মায়ের মুখ
মুছে যাবে সব দুঃখ
পৃথিবীতে সকল মা তার সন্তানদের জন্য একজন নিঃস্বার্থ সেবিকা যার তুলনা সে নিজে। আমার মা বারো ভুঁইয়া ঈসা খাঁন বংশধর ছিলেন। আমার নানা হামিদুল্লাহ ভুঁইয়া তখন দৌলতখান কোর্টে ওকালতি করতেন। আমার মায়ের নানা ও দৌলতখান কোর্টে ওকালতি করেছেন। তাদের বংশের পুঁথি ছিল।
দৌলতখান তখন একটি মহকুমা ছিল। ১৮৭৬ খৃষ্টাব্দে (বাং ১২৮৩) ৩১শে অক্টোবর বাংলা ১৬ই কার্তিকের মহা ঝড়ের কথা বাখরগঞ্জবাসীর স্মৃতিপটে চিরদিন জাগরুক থাকবে। এরূপ মহা প্রলয়ংকরী বন্যার কথা আর শোনা যায় নি। এই মহাঝড়ে দৌলতখান নামক স্থান এবং পাশর্^বর্তী গ্রাম একেবারে ধ্বংস প্রাপ্ত হয়েছিল। বাবু উমাচরণ চট্টোপাধ্যায় এই দৌলতখান মহকুমার এসডিও ছিলেন। বার্টন সাহেব ছিলেন জিলা ম্যাাজিস্ট্রেট।
আমার মায়ের দাদা চর নিশিন্দপুরের বিখ্যাত জমিদার ছিলেন। আমার নানাকে প্রতি সপ্তাহে একটি করে ঘোড়া কিনে দিতেন। ঘোড়ায় চড়ার পারদর্শিতা লাভ করার জন্য। আমার নানা কিছুই করতেন না। কোর্টে যেতেন, ঘোড়ার চড়ে বেড়াতেন। বড় বড় বেড়িবাঁধের ন্যায় উঁচু পাড়ওয়ালা তিনটি দীঘি ছিল। শান বাঁধানো ঘাট, বিরাট তাল গাছ ছিল। বড়শি ফেলে মাছ ধরতেন। আমার নানা গ্রামের চেয়ারম্যান ছিলেন।
সন্ধ্যাবেলায় বাড়ীর দরজায় মজলিসে বসতেন। নানা রকম ময়না, টিয়া, এবস পালনের হবি ছিল। মেঘনা নদী তাদের সব গ্রাস করে সর্বহারা করে দিয়েছে। একই সাথে আমার পৈত্রিক পরিচয় না দিলেই নয়। আমার দাদা মৌলভী আলী আহম্মদ তৎকালীন ভোলা মহকুমায় দৌলতখান থানায় বিজয়পুর গ্রামের জমিদার। বাড়ীতে প্রকান্ড শান বাঁধানো ঢেউ খেলানো দীঘি। চারিদিকে ঢেউ খেলানো উঁচু দীঘি। বাড়ীর সামনে বাঁধানো গেইট। ওনারা বলতেন সিংহ দরজা। জীর্ণ-শীর্ণ একতালা বিরাট বিল্ডিংটার ইটগুলো খুলে খুলে গিয়ে কালের জমিদারীর নিদর্শন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বাড়ীর সামনে বিরাট মসজিদ, পাকা প্রাইমারী স্কুল ছিল। মাস্টার ও মৌলভীগণের বেতন আমার বড় কাকা (চাচা) বহন করতেন। আমার বড় কাকা খুব রাশভারি লোক ছিলেন। তার সামনে কোন অন্যায় করলে খুব রাগ করতেন। এই ছিল আমাদের পারিবারিক ঐতিহ্য।
আমার মা এরূপ আভিজাত্য পরিবারের মেয়ে হওয়া সত্ত্বেও কোন হিংসা বিদ্বেষ তাঁর মধ্যে পরিলক্ষিত হয় নি। মা ভীষণ দয়াবতী ছিলেন। কোন সময় খেতে বসলে একজন ভূখা গরীব এলেই মা না খেয়ে পাতের ভাতগুলো তাকে দিয়ে দিতেন।
মা এত পর্দা করতেন যে, বাইরের অন্য কোন পুরুষ মায়ের মুখ দেখছেন কিনা আমার সন্দেহ আছে। মা খুব সুন্দরী ছিলেন। নামায, রোযা, দান-খয়রাতে তিনি অসম্ভব পটু ছিলেন। রাতদিন নামাযের মসলায় তাসবীহ নিয়ে বসতেন। তাহাজ্জুদ নামায গভীর রাতে আদায় করতেন সারা জীবন আমি আমার মার মুখে মুখে বেহেস্ত ও দোযখের গল্পই শুনতাম। আমরা তা এক কান দিয়ে শুনে অন্য কান দিয়ে বের করে দিয়েছি। দান-খয়রাত, হজ্জ, যাকাত সম্পর্কে মার ধ্যান ছিল।
রোজার এক মাস মা তসবীহ হতে আল কুরআন শরীফ নিয়ে বসে থাকতেন। প্রতি শুক্রবার সোমবার আমাদের ভোলায় হাট বসে। রোজার এক মাস সন্ধ্যা বেলায় ইফতারের সময়ে হাটের সমস্ত লোককে মিসরির শরবত তোকমা দিয়ে মুড়ি এবং ছোলা খাওয়াতেন।
মা রোজা রাখতে পারতেন না। একজন, দুজন, তিনজন গরীব লোককে সন্ধ্যায় ভাত খাওয়াতেন, ইফতার করাতেন। চাকর-বাকর, কাজের লোকের প্রতি মা ও বাবার খুব দয়া ছিল। মা তাদেরকে ভাল খাবার ও সুন্দর পোশাক দিতেন। কাজের মেয়েদের কানে, গলায়, হাতে সোনার অলংকার বানিয়ে দিতেন। আমি এ জন্য বাবা ও মায়ের উপর রাগ করতাম। বলতাম বাবা কেন ওদের ভাল কাপড় গহনা বানিয়ে দেন।
মা প্রায় দশ বছর প্যারালাইজড ছিলেন। একটা বড় পালঙ্কের উপর বসে থেকেই আমার বাবার শান-শওকত, খান বাহাদুরি ঐতিহ্য তিনি বজায় রেখেছেন। চাকর, বাবুর্চি, কাজের মেয়ে সকলকেই তিনি পরিচালনা করে গেছেন। জামাই, বেয়াই, বেয়ান, মেয়ে ছেলে, নাতি, নাতনী সকলকে যতœ করেছেন-আদর, ¯েœহ, ভাালবাসা দিয়ে গেছেন। তিনি অসম্ভব বুদ্ধিমতী ছিলেন। তার কাজ থেকেই থার্মোমিটার দেখা, জ¦র চার্ট করা, সেবাশুশ্রষা করা শিখেছি। সভ্যতা, ভদ্রতার শিক্ষাও তার কাছে পেয়েছি।
বাবা রাত ছাড়া কোন সময়ে বাড়ীতে থাকতেন না। রাজনীতি, মামলা-মোকদ্দমা ও মানুষের বিভিন্ন কাজে সকাল ৬টা থেকে রাত বারটা পর্যন্ত তিনি ব্যস্ত থাকতেন। মায়ের অসখু বা আমাদের অসুস্থতা কোনটাই বাবা লক্ষ্য রাখতে পারতেন না। মাকে বলতেন, সিন্দুকে টাকা আছে, তুমি আছ, ডাক্তার আছে দেখাও। আমার জন্য অপেক্ষা কর না। তোমার উপর ভর দিয়ে আমি নিশ্চিন্ত।
আমার মা গ্রামের মেয়ে। সামান্য বই, পুঁথি, পুুুুুস্তক, হাদীস, কোরআন পড়তে পারতেন। তার মাথার কাছে সব সময় হাদীসের বই থাকত। তসবীহ, আতর, গোলাপ, সুরমা মওজুত থাকত। মায়ের কাপড় ও পোষাক থেকে আতরের সুগন্ধি আসত।

 

(চলবে—–)

ফেসবুকে লাইক দিন

আমাদের সাইটের কোন বিষয়বস্তু অনুমতি ছাড়া কপি করা দণ্ডনীয় অপরাধ।