পারিবারিক আদব ও নৈতিকতার বর্তমান খণ্ডচিত্র

এ্যাডভোকেট বীথি ইসলাম

এ্যাডভোকেট বীথি ইসলাম: আইন অনুশীলনের ব্রত নিয়ে দীর্ঘ পাঁচ বছর আইন শিক্ষার ঘরে চরম ধৈর্য, নিষ্ঠা আর অধ্যবসায় করে অবশেষে চল্লিশ বছর বয়সে আইন চর্চার আইনানুগ সনদ পেয়ে নিজের কাছে মনে হলো যুদ্ধক্ষেত্র থেকে যুদ্ধ জয় করে ঘরে ফিরেছি। ১৯৯১ সাল থেকে সমাজসেবামূলক কার্যক্রমে নিজেকে সম্পৃক্ত করে বারবার মনে হচ্ছিল সমাজকর্মের সেবার নিয়ামকগুলোর সাথে যদি আইনশাস্ত্রের সেবার নিয়ামকগুলোর সম্পর্ক নিবিড় থেকে আরো নিবিড়তর করা যায়, সমাজ ও পরিবারে প্রত্যেককে যদি তাদের অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে ধর্মীয় ও সামাজিক অনুশাসনের আদলে অভ্যস্ত করা যায়, তাহলে হয়তো সমাজে বিদ্যমান সামাজিক সমস্যা ও অপরাধের প্রবণতা ধীরে ধীরে হ্রাস পাবে। সমাজের প্রাণ বা উপাদান যাই বলি সে ফিরে পাবে তার কাঙ্খিত জীবনমান মূল্যবোধ, পরিবার ব্যবস্থা  ও পারিবারিক আদবে। শুনতে খারাপ লাগলেও এটা সত্য আমরা আজ ধর্মীয় অনুশাসন ও সুস্থ সামাজিক মূল্যবোধে গড়ে ওঠা পারিবারিক আদব আর নৈতিকতা থেকে অনেকটাই দূরে সরে বা বিচ্ছিন্ন। পিতা, মাতা, অভিভাবক অথবা বয়োজ্যেষ্ঠ যে যেখানেই থাকি না কেন, আমরা আজ প্রায় সকলেই আমাদের আচরণ দ্বারা কোমলমতি শিশুদের শিখাচ্ছি মিথ্যা বলা, স্বার্থপরতা, বেয়াদবি,  লোলুপতা, অসুস্থ বিনোদন, আত্নকেন্দ্রিকতা, উশৃঙ্খলতাসহ নানারকম ক্ষতিকর আত্নপ্রকাশ ভঙ্গি। যা স্তব্ধ করে দিচ্ছে মানুষের মানবিক বৈশিষ্ট। যাই হোক চোখের সপ্ন-মনের ভাবনা সব একাকার করে স্থির করলাম মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে আইনের দ্বারস্থ ঐ অসহায় সমস্যাগ্রস্ত মানুষগুলোর হয়ে লড়ব। তাই মনের মধ্যে একটি অদম্য ইচ্ছাশক্তি নিয়ে সকলের সহযোগীতায় শুরু করি আইন পেশা। অনেক আগ্রহ, জিজ্ঞাসা, বুঝা না বুঝার ভাবনা নিয়ে দেখতে থাকি আদালতের বিচারব্যবস্থা, বিচারক, বিচারপ্রার্থী, আমার মত সনদধারী নবীন-প্রবীণ আইনজীবী, মহুরী ও রাজ্যের ভাবনা নিয়ে অপেক্ষমাণ উৎসুক মুখগুলো। মনে হলো বিচারতো ঠিকই আছে, তারপরও  কি যেন নেই। বিচার প্রার্থী বিচার পাচ্ছে, আইনজীবীগণ প্রাণপণ লড়াই করছে মোয়াক্কেলের জন্য, বিচারকগণ আইন ও আইনের রেফারেন্স পড়ে মামলার বিচার্য বিষয় নিয়ে গভীর অনুভবে নিজেদের মধ্যে জাগিয়ে তুলছেন বিচারিক সত্তা। কোনো কোনো দিন আবার কারো কারো নির্ঘুম রাত কাটে কর্মময় দিনের খন্ডচিত্রের হিসাব মিলাতে। আর আমার মধ্যে জেগে উঠে ভাবনা কিছু খন্ড চিত্র।

ঢাকা শহরে নয়ন আর  নাহিদের দুই বছরের সংসার । ভালোবেসে তারা বিবাহ বন্ধনে আবন্ধ হয়, বিবাহে মত ছিল না নাহিদের পরিবারের। কিছুদিন পরে তাদের সংসারে জন্ম নেয় মেয়ে তইবা। তইবার জন্মের কিছুদিন পর নাহিদ তার বাবাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে বউ আর মেয়েকে বাড়ি নিয়ে যাবে বলে ঢাকা থেকে বাড়ি চলে আসে। আর ফেরা হয়নি নাহিদের। তাই একদিন অসহায় নয়ন মেয়েকে নিয়ে আসে নাহিদের বাড়িতে। মা-মেয়ের কষ্টের  কথা বলে সবাইকে। শ্বশুর নিশ্চুপ। স্বামী নাহিদও যেন এখন বাবার বাধ্যগত সন্তান। বাবার কথার বাইরে তার কোন কথা নেই। ছোট খাটো একটা লড়াইয়ের পর বুদ্ধিমতী শ্বাশুড়ির লোক দেখানো দয়ায় শেষ পর্যন্ত স্বামীর ঘরে জায়গা হয় নয়নের। কিছুদিন সময় অতিবাহিত হওয়ার পর নযনের নারী মনের কষ্টাঘাত শুকাতে শুরু কওে তখন নাহিদ একদিন বেড়ানোর ছলনায় নয়ন ও তইবাকে পাঠিয়ে দেয় নয়নের বাবার বাড়ি। নয়ন বাবার বাড়ি যাবার কিছু দিন পর নাহিদের বাড়ি থেকে জানিয়ে দেয় নয়ন যেহেতু সমাজের নিচুস্তরের একজন গরীব পিতার সন্তান তাই তাকে নাহিদের বাবার পক্ষে পুত্রবধূ হিসেবে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। সমস্যা মনে হলে তইবাকে যেন তাদের কাছে ফিরিয়ে দেয়। অবস্থার প্রেক্ষিতে নাহিদের অবস্থানও পিতৃ মেরুতে। সমাজপতিরাও নয়নের এই দুরাবস্থায় নিরব দর্শক। কিন্তু নয়ন চায় মেয়ে নিয়ে স্বামীর সংসার করতে। এ অবস্থায় নয়নের প্রতিকার কোথায় ?

একান্নবর্তী সংসারে সুমাইয়া, মোসাদ্দেকের স্ত্রী। সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না আর মান-অভিমানে প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে চলে তাদের সংসার জীবন। আকাশ ও চাঁদ তাদের দুই সন্তান। শ্বশুর-শাশুড়ি, স্বামী-সন্তান ও অন্যান্য আত্নীয় নিয়ে ভালোই দিন কাটছে সুমাইয়ার। সুখের কোন কমতি নেই সুমাইয়া-মোসাদ্দেক দম্পতির। একরাতে মোসাদ্দেক হঠাৎ করে ছনিয়া নামক অন্য এক স্ত্রীলোককে ঘরে তুলে তার দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে। আকারে-ইঙ্গিতে সবাইকে বুঝিয়ে দেয় একটি অনৈতিক সম্পর্কের ফসল তার এই বিয়ে। বুঝতে চায় না শুধু সুমাইয়ার দগ্ধ অনুভূতিগুলো। তাই মোসাদ্দেক সুমাইয়াকে ঘরের ভিতরে নিয়ে মৃদু ভাষায় চরমভাবে শাসিয়ে দিয়ে বলে সবাইকে বলবে আমি আমার স্বামীকে দ্বিতীয় বিবাহ করতে বলেছি এবং ইসলাম ধর্ম মতে একজন স্বামী একত্রে চারজন স্ত্রী নিয়ে সংসার করতে পারে। আপনারাই বলুন সুমাইয়া তার এই অপূরণীয় ক্ষতির প্রতিকার কোথায় কিভাবে পাবে ?

ধর্মীয় ও সামাজিক নিয়ম-কানুনে বিবাহ হয় তাহসিন ও সুজনের। তাদের একমাত্র সন্তান আলো। আলোর বয়স ১০ বছর। ব্যক্তিগতযোগ্যতার লড়াইয়ে ধীরে ধীরে চিড় ধরে তাদের দাম্পত্য জীবনে। অবশেষে একদিন আইনানুগ প্রক্রিয়ায় অবসান হয় তাহসিন ও সুজনের দাম্পত্য জীবন। বিবাহ বিচ্ছেদের পর আলো থাকে তার মায়ের সাথে। বাবাও খোঁজখবর রাখে আলোর। মাঝে মাঝে কিছু টাকাও পাঠায় সুজন তার মেয়ের জন্য। এভাবে দিন যায়, মাস যায় বছর আর যায় না। এরই মধ্যে আবারো বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয় সুজন। নতুন স্ত্রীকে নিয়ে সেজে উঠে সুজনের রঙিন জীবন। মলিন হতে থাকে আলোর সাথে বাবার যোগাযোগ। কিছুদিন পর তাহসিনের বাবা-মা ও তাদের মেয়েকে অন্যত্র বিয়ে দেয় এই অযুহাত জোয়ন মেয়ে স্বামী ছাড়া কিভাবে ঘরে রাখি। অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ আর হতাশায় পরে থাকে শুধু অসহায় আলো। নিভে যায় আলোর জীবেনের রঙিন আলো। শুরু হয় আলোর টানাপোড়েনের জীবন। আলো কার কাছে প্রতিকার চাইবে তার প্রতি এই অন্যায় ও জুলুমের ?

সবুর চাকরিজীবী মানুষ। স্ত্রী, ছেলেমেয়ে ও বৃদ্ধ মা-বাবা নিয়ে সবুরের সংসার। কাজ শেষে বাড়ি আসে পরিবার পরিজনদের সাথে একটি সুন্দর সময় কাটানোর আশায়। কিন্তু বিধি বাম। সবুরের অর্ধাঙ্গিনী নূরী স্বভাবতই একজন বদমেজাজি, আত্নকেন্দ্রীক ও আক্রমণাত্মক স্বভাবের মহিলা। নিজেকে ছাড়া অন্য কাউকে নিয়ে ভাবার সময় তার নেই। তাই সবুরের সাথে রাগারাগি আর সবুরের চৌদ্দ পুরুষের পিন্ডি চটকানো নূরীর প্রতিদিনের আবশ্যকীয় কাজগুলোর মধ্যে অন্যতম। পরিস্থিতির মোকাবেলায় সবুর হতবাক। সমাজের ভয়, নারী-শিশু আইনের ভয়, তার উপর স্ত্রীর ভয়, সর্বোপরি সংসার হারানোর ভয়। এই অসহায়ত্ব থেকে সবুরকে রক্ষা করবে দেশের কোন আইন?

এই রকম অসংখ্য সমস্যাশুধু বাংলাদেশের ভোলা জেলার চরনোয়াবাদেই নয়, বরং সমগ্র পৃথিবীর পরিবার তথা ব্যক্তিজীবনকে ঘিরে রেখেছে আষ্টেপৃষ্ঠ। যেখান থেকে বের হতে পারছিনা আমরা, যা প্রতিনিয়ত কুঁরে কুঁরে খাচ্ছে আমাদের জীবনব্যবস্থা। শুধুমাত্র রাষ্ট্রীয় আইন বা আইনের প্রয়োগ দ্বারা এ সমস্যা সমাধান করা কি আদৌ সম্ভব ? আমরা জানি, মানুষ কিছু মূল্যবোধ ও নিয়ম-নীতি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত। ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজভিত্তিক এই মূল্যবোধ গড়ে তোলে মানুষকে প্রকৃত মানুষরূপে। অথচ জ্ঞান ও প্রযুক্তির দ্রুত বিকাশ এবং বৈষয়িক পরিবর্তন বা উন্নতির সাথে তাল মিলিয়ে নিজেকে উন্নতির পথে নিয়ে যাওয়ার প্রতিযোগীতায় প্রতি মুহুূর্তে ব্যস্ত আমরা । দিনের পর দিন দূরে সরে যাচ্ছি আমাদের জীবনের মূলমন্ত্র ধর্মীয় অনুশাসনে সৃষ্ট পারিবারিক আদব আর নৈতিকতা থেকে। আমরা এখন আমাদের ভবিষ্যতকে শিখাই কিভাবে বৃদ্ধ অসহায় বাবা মাকে বৃদ্ধ নিবাসে পাঠাতে হবে; কিভাবে অন্যের সম্পদ অতি সাবধানে অন্যায়ভাবে হলেও নিজের করা যাবে;কিভাবে স্কুলের টিফিন বন্ধুদের রেখে একা একা খাওয়া যাবে; কিভাবে একের পর এক মিথ্যা কথা বলে নিজেকে সকল দোষের উর্দ্ধে রাখা যাবে; কিভাবে স্নেহ, মমতা, ভালোবাসার পরিবর্তে আক্রমণ করে নিজের আধিপত্য বিস্তার করতে হবে প্রভৃতি। নিজ তৈরী এই শাণিত অস্ত্রগুলো দিয়ে আমরাই প্রতিনিয়ত জখম হচ্ছি অথচ উপলদ্ধি করতে পারছি না। তাই বাঁচতে হলে আমাদের ছাড়তে হবে এই সকল ক্ষতিকর আত্মঘাতী অনুশীলন। ফিরতে হবে পারিবারিক আদবও নৈতিকতায় গড়ে ওঠা আলোর পথে। মহানআল্লাহ আমাদের সহায় হোন।

বি দ্রঃ যারা মোসাদ্দেকের কথার সাথে একমত, মোসাদ্দেকসহ তাদের বিনয়ের সাথে বলছি আপনারা দয়া করে পবিত্র কুরআনের বিবাহ সংশ্লিষ্ট সূরা এবং তাফসীরসহ তদীয় আয়াত ( সূরা বাকারার আয়াত নং ২২১, ২৩২, ২৩৪-২৩৫; সূরা নিসার আয়াত নং ৩, ২২-২৫; সূরা নূরের আয়াত নং ৩ এবং সূরা কাসাসের আয়াত নং ২৭;  বিশেষ করে সূরা নিসার আয়াত নং ৩  ) সমূহ জীবনে একবার হলেও পড়ুন এবং তারপর বলুন।
লেখক: পেশাদার সমাজকর্মী, আইনজীবী ও গবেষক

ফেসবুকে লাইক দিন

আমাদের সাইটের কোন বিষয়বস্তু অনুমতি ছাড়া কপি করা দণ্ডনীয় অপরাধ।