সর্বশেষঃ

মহান মুক্তিযুদ্ধ ॥ স্মৃতিময়-৭১: শেষ পর্ব

মাহাবুবুল আলম নিরব মোল্লা

(গত পর্বের পর) : এখন খুলনা শহর ব্যাতিত গোটা এলাকা মুক্ত। স্বাধীনবাংলা বেতারের এম আর আক্তার, মুকুলের শিহরন জাগানীয়া চরমপত্র, আকাশ বানীর দেব দুলাল বন্দোপদ্যায়ের আবেগীয় ভরাট সাবলীল সংবাদ প্রবাহ, বিবিসির সংবাদ আমাদের বিজয়ের বিশ্বাসকে আরও প্রত্যয়ী করে তুলে। প্রেক্ষ্যাপট দ্রুতই বদলে যাচ্ছে আনুমেয়। ভারতীয় বিমান আমাদের আকাশ বিদির্ন করে উড়ে যাচ্ছে মুক্ত পাখির মতো, পাকিস্তানী ও তাদের এ দেশীয় দোসরদের কলিজায় কাপন ধরিয়ে। এতদিনের গর্তে লুকানো মানুষ মুক্ত এলাকায় প্রাণ খুলে রাস্তায়, হাটে-মাঠে চায়ের দোকানে আড্ডায় গাল-গল্পে মেতে উঠছে। এতদিনের বন্ধি জীবনের বুঝি অবসান হতে চলেছে। চারদিকে দিন রাতে জয় বাংলা ধ্বনিতে মুখরিত। মুক্তিযোদ্ধাদের দেখলে তাদের জড়িয়ে ধরছে, দোয়া করছে, অনেকে আপ্যায়ন করতেও চায়, তাদের কাহিনী শুনতে চায়।
৩ ডিসেম্বর ভুটান বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও সরকারকে স্বীকৃতি দেয়। ৬ ডিসেম্বর ভারতের পার্লামেন্টে সিদ্ধান্তে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় এবং পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা দেয়, একই সঙ্গে বাংলাদেশে যে সকল পাক বাহিনী অবস্থান করছে তাদের আত্মসমর্পণ করার আহবান জানায়। পাকিস্তানিদের মনোবল ভেঙ্গে গুড়িয়ে যায় এবং মুক্তি ও মুজিব বাহিনীর সাঁড়াশী আক্রমনে অবশেষে ৯ ডিসেম্বর খুলনা শহরও হানাদার মুক্ত হয়।
আমাদের বাহিনী নিয়ে টুকু ভাই, আজম খান বাণিজ্য মহাবিদ্যালয়ে ঘাঁটি স্থাপন করেন। খুলনায় কিছু শিল্পাঞ্চলে বিহারিদের প্রাধান্য ছিল। আমাদের সাথী আহত হীরা ভাই ক্যালকাটা থেকে সুস্থ্য হয়ে এসে পরে বিহারিদের সাথে এক সংঘর্ষে শহীদ হন। মেজর জলীল সাহেবও তখন খুলনায়।
এরপর আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষন, ভারতীয় বেতার থেকে ভেসে আসে জেনারেল মানেরশার কন্ঠ, হাতিয়ার ডালদো আমরা জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী তোমাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করব, অন্যথায় পরিনাম হবে ভয়াবহ। ১৬ ডিসেম্বর, পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে দীর্ঘ ৯ মাসের দমবন্ধ পরিবেশ থেকে দেশ ও জাতী মুক্তিলাভ করে। আনন্দে মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। গগন বিদীর্ন জয় বাংলা ধ্বনিতে আকাশ-বাতাস মুখরিত হয়। কিন্তু স্বাধীনতার মূল কারিগর জাতীর পিতা বঙ্গবন্ধু, পাকিস্তানের কারাগারে বন্ধি। তাকে ছাড়া এ বিজয় অপূর্নাঙ্গ। ভারতের ও সদ্য সাধীন রাষ্ট্রের পক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন এবং বিশ্ব নেতৃবৃদ্ধ বঙ্গবন্ধু মুজিবের মুক্তির আহবান জানান।
আমরা তখন ভাবছি কি করে ভোলায় আমাদের স্বজনদের কাছে ফিরব, জানিনা কে কোথায় আছেন বেঁচে আছেনকে কে নেই ? বাবুল ভাই কি নিরাপদে ভোলায় পৌঁছতে পেরেছেন ? এরকম নানান প্রশ্ন উকি দিচ্ছে মনে। কিন্তু পাক বর্বর বাহিনী পলায়ন করে চলে যাওয়ার সময়, নদী পথে ভাসমান মাইন ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিয়ে যায়। সেগুলি অপসারনের জন্য নৌ-বাহিনীর বিশেষ একটি দল আসার অপেক্ষায় আরও দুদিন কেটে যায়। তারা এলে তাদের সাথে বোটে আমাদের উঠিয়ে দেওয়া হয়। সেই বোটে ভোলার দৌলতখানের নুরে আলম মামার (হাবিবুল্যা মাওলানা সাহেবের ছেলে) সাথে দেখা, ইতিপূর্বে ওনার সাথে সানি ভিলায় কোলকাতায় দেখা হয়েছিল। নৌ-বাহিনী পথে পথে মাইন সুইপিং করে বরিশালের পথে আগাতে থাকে। এভাবে দিন রাত কাজ করে তিন চারদিন পর বরিশাল পৌছি, আবার সেই ইসলামিয়া হোটেল যেখানে ইন্ডিয়া যাওয়ার সময় উঠেছিলাম। পরদিন বরিশাল কলেজে মুজিব বাহিনীর ক্যাম্পে হাসনাত ভাইর সাথে দেখা করতে যাই জানতে পারি আগামীকাল আমির হোসেন আমু ভাই বরিশাল আসবেন, আমরা ভোলা যাওয়ার কোন বাহনও পাচ্ছিনা।
পরদিন আমু ভাই একটা বোটে যা ডিসিরা ব্যবহার করে, তাতে করে বরিশাল পৌঁছলেন। ওনাকে মুজিব বাহিনীর সদস্যরা অভিবাদন জানান, উনি আমাদের পিট চাপরে চলে যান। এদিকে আমরা সারাক্ষন লঞ্চঘাটে খবর নেই কোন কিছু পাই কিনা ? যাতে করে আমরা ভোলা যেতে পারি।

আমরা বরিশাল এসেছি জানুয়ারির তিন তারিখ ১৯৭২ সাল, আজ ৭ই জানুয়ারি, এখনো যাবার কোন উপাই করতে পারিনাই সেজন্য মনটা অস্থির। অবশেষে সকাল ১০টায় পেয়েগেলাম একটা ছোট্ট ট্রলার, গাঁদাগাদীকরে বেশকিছু যাত্রী আমরা উঠলাম ট্রলারে, শুধু একজন চেনালোক পেলাম তিনি আমাদের অবশ্য চেনেন,না, উনি ভোলা কলেজের শিক্ষক হালিম স্যার।ছোট্ট ট্রলার টালমাটাল অবস্থা কোনক্রমে চলছে ভোলা খালের মুখে এসে বিকেল বেলায় মেশিন নষ্ট হয়ে গেল, অগত্যা কি করা ওখানেই অবতরন।এবং হাঁটা শুরুকরি। গ্রামের মানুষদের উৎসুক প্রশ্নের জবাব দিতে দিতে সন্ধায় ভোলা খেয়াঘাটের ওপার এসে পৌছি। তারপর খেয়া নৌকায় এপার। তখনকার দিনে সন্ধারপরে আর আর খেয়ানৌকা পাওয়া যেতনা। ভেদুরিয়া ভেলুমিয়ার মানুষ তখন ভোলায় কাজ বা মামলা মোকদ্দমা থাকলে একদিন আগে ভোলায় আসত। এখনকার অবস্থা দেখে তা অনুমান করাও দুসাধ্য। যাক এপাড় এসে আল্লার রহমতে খেয়াঘাটে রিক্সা পেয়েযাই। এতক্ষনে মনে শান্তি পেলাম, যদিও শরীর ক্লান্ত অবশন্য। রিক্সায় বাহলুল আমি দুজনেই চুপ, ভাবছি সবযদি ঠিকঠাক থাকে তাহলে হঠাৎ আমাদের দেখে বাবা, মা বাড়ীর সবাইর কি প্রতিক্রিয়া হবে ? মা চাচীরা হয়ত কাঁদবেন আনন্দে বাবা ও কাকাদের বকা নিশ্চিত।
অবশেষে সন্ধারপরে বাসায় পৌঁছলাম। কেউই বকা দলেন, না। বাসা কিছু সময়ের মধ্যে আত্বীয় স্বজন তালুকদার বাড়ীর বন্ধু তরিক, হুমায়ুন, হারুন, আবুল হোসেন বাপ্তার কাদের এসে হাজির কিছু সময়পর। বন্ধু সানিধ্যে ক্লান্তি কোথায়, চলেগেল ঘরের প্রাথমিক দেখা সাক্ষ্যাত শেষে তালুকদারদের পুকুর ঘাটলায় গীয়ে বসলাম। মা, বাবা কাকারা সাবধান করেছেন যে বেশী রাতযেন না করি। আমরা আসার দুই-তিন দিন আগে ভোলায় এক মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেযায়। মুক্তিযাদ্ধা ভোলা ছাত্রলীগ সভাপতি সালে আহমেদ, কলেজের ভিপি ছাইফুল্যা ও জুলফিকার জুলু ভাইকে হত্যাকরা হয়। আজ মনেপড়ে কত কষ্টকর ঝুকিপুর্ন ছিল সে যাত্রা ঐ নয় মাসের জীবন প্রতিটি স্বাধীনতার স্বপক্ষের মানুষের জন্যই ছিল উৎকন্ঠার ঝুকির।
কাজ থেকে দেখেছি জাতীয় নেতাদের ক্লান্তিহীন পরিশ্রম, সংগ্রাম, ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা। মেজর জলীল সহ অনেকেই আসতেন সানি ভিলায়। দেখেছি ৪৭ এ দেশ ভাগেরপর ভোলা থেকে চলে যাওয়া কলিকাতাবাসী মানুষদের আন্তরিকতা তাদের সেবা সাহায্য সহযোগীতা। প্রতিদিন আসতেন অজিত কাকু, আমাদের নাস্তা করাতেন মাঝে মাঝে হাত খরচ দিতেন। দেশে ডুকবার আগে ওনাকে শাহাজাদা কাকা নজরুল ভাই কিংবা তোফায়েল ভাই কাউকেই বলিনী যেমনি না বলে দেশ থেকে একদিন বেরিয়ে ছিলাম অজানার পথে, ঠিক সেভাবেই। ৭১ এর ভেতর কল্পনায় ঝাপিয়ে পড়ে সে সময়টা আবার সৃজন করতে ইচ্ছে করে। অসুখ, উৎকন্ঠা, সংকট, সমস্যা, জীবন যাপনের গ্লানী, প্রান ধারনের আর্তীবাদ প্রতিবাদ, ঘৃনা, নিন্দা, অবিশ্বাস, দূর্নীতি এসবের ভেতরেই তো ডুবে আছি।
মাটির প্রতি ভালবাসা আর আনুগত হতে না পারলে দেশের প্রতি ভালবাসা জন্মায় না। যে কেউ ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক, শিল্পপতি, আমলা, প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি হতে পারে। কিন্তু মুক্তযোদ্ধা হওয়া যায় না, এটা কোন জাতীর জীবনে বিশেষ সময়ে ত্যাগি আত্মবিসর্জনে উম্মুখ বিশেষ ব্যক্তিই হতে পারে।

ফেসবুকে লাইক দিন

আমাদের সাইটের কোন বিষয়বস্তু অনুমতি ছাড়া কপি করা দণ্ডনীয় অপরাধ।