স্মৃতিতে বঙ্গবন্ধু : ফজলুল কাদের মজনু

জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর শততম জন্মজয়ন্তীকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য জাতীয় সংবাদ সংস্থা বাসস এর তৃণমূল পর্যায়ে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক উত্তরসূরিদের মধ্যে যারা তার ক্ষণিকের সান্নিধ্য পেয়েছেন তারা কখনোই তাকে ভুলতে পারেননি, তেমনি একজন বর্তমান ভোলা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি, বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী জনাব ফজলুল কাদের মজনু মোল্লা।
প্রশ্ন : আপনার সাথে বঙ্গবন্ধুর প্রথম পরিচয় কখন ?
ফজলুল কাদের মজনু : বলতে পারেন ১৯৫৩ সালে। বঙ্গবন্ধু ও মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী সাংগঠনিক সফরে ঐ সময় ভোলায় এসে আমাদের বাসার মেহমান খানায় অবস্থান করেন। তখন আমি খুবই ছোট। বাবা কাকাদের মুখে শুনেছি পরবর্তীকালে, বঙ্গবন্ধু আমাকে এবং ভোলা মহকুমা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আমার বড় চাচা মোঃ সোলায়মান মোল্লার ছেলে ওবায়দুল হক বাবুলকে আদর করে কোলে নিয়ে দুই টাকা করে বকশিশ দেন। আমার বাবা কাকাদের পদাংঙ্ক অনুসরণ করে বঙ্গবন্ধুর প্রতিষ্ঠিত সংগঠন ছাত্রলীগে যোগ দেই যখন তখন আমি ক্লাস সিক্সে পড়ি। নবম শ্রেণীতে উঠে স্কুল কমিটির সভাপতি, দশম শ্রেণীতে ছাত্রলীগের মহকুমা শাখার দপ্তর সম্পাদক, ১৯৬৯ সালে ছাত্রলীগের মহকুমা সাধারণ সম্পাদক হই।
প্রশ্ন : ৬৯ সালেই তো বঙ্গবন্ধুকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়?
ফজলুল কাদের মজনু : ২২ শে জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু আগরতলা মামলা থেকে অব্যাহতি পান, নভেম্বরের ২২ তারিখ রাজনীতির বিধি-নিষেধ প্রত্যাহার হলে, তিনি দেশব্যাপী সফরের প্রথম দিকেই ভোলায় আসেন। ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে জনসভার প্রস্তুতি আমাদেরকেই নিতে হয়।
প্রশ্ন : এ সময় আপনি বঙ্গবন্ধুকে কাছ থেকে দেখার অনেক সুযোগ পেয়েছিলেন ?
ফজলুল কাদের মজনু : জি হ্যাঁ, ভোলার খেয়াঘাটে বঙ্গবন্ধু এসে নামলে আমাদের উইলী জিপে হুড খুলে, বঙ্গবন্ধুকে ভোলা শহরের উকিলপাড়ায়, ছাত্রলীগ অফিসে নিয়ে আসি। এই দীর্ঘ প্রায় সাড়ে ৬ কিলোমিটার পথে বিশাল শোভাযাত্রায় আমি রিকশায় মাইক বেঁধে স্লোগান দিছিলাম। ভোলা শহরের মুখে কালিনাথ বাজারে ছাত্রলীগ কর্তৃক নির্মিত তোরনের কাছে, বঙ্গবন্ধু আমাকে বলেন মজনু বল শিক্ষা শান্তি প্রগতি প্রগতি, বঙ্গবন্ধুর স্পষ্ট উচ্চারণ প্রতিটি মানুষকে আরও উদ্বেলিত করে, সবাই সমস্বরে শ্লোগানে অংশ নেয়।
প্রশ্ন : তারপর ?
ফজলুল কাদের মজনু : ছাত্রলীগ কার্যালয় পরিদর্শন ও পরিচিতি শেষে বঙ্গবন্ধুর সংক্ষিপ্ত উপদেশ। তারপর দুপুরের খাবার খেতে তৎকালীন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক, (পরবর্তীতে দীর্ঘকাল সভাপতি ছিলেন) মোফাজ্জল হোসেন শাহীন ভাইয়ের বাসায় তার মুখোমুখি হই। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে আদর করে দেন। সেখান থেকে আমি ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা জনসভার মাঠে চলে আসি। জনসভা পরিচালনা আমি করি। ছাত্রলীগের পক্ষ হতে একটি সোনার তৈরি, ছাত্রলীগের মনোগ্রাম সিদ্ধান্ত মোতাবেক বঙ্গবন্ধুকে পরাবার দায়িত্ব আমাকে দেওয়া হয়। মাইকে ঘোষণা দেন তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতা, আজিজুল ইসলাম ভূঁইয়া যিনি এক সময় বাসসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন।
৫ ফুট ৫ইঞ্চি সাইজের আমি, বঙ্গবন্ধুর বুকের নাগাল পাওয়ার প্রাণান্তকর চেষ্টায় এক হাস্যরসের পরিবেশ সৃষ্টি হলো ! বঙ্গবন্ধু আমাকে দুই হাত দিয়ে ধরে বুকের কাছে টেনে নেন, বলেন ভালোকরে লাগিয়ে দে, আর সেই মুহূর্তের ছবি তুলে আমাকে উপহার দেন, বঙ্গবন্ধুর ফটোগ্রাফার সিলেটের মোস্তফা আল্লামা ভাই। আমার জীবনের সেই ঐতিহাসিক মূল্যবান ছবিটি, আমি মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে হারিয়ে ফেলি।
সভাশেষে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সভাপতি মরহুম শামসুদ্দিন মিয়ার বাসায় চা নাস্তা খেয়ে আমার চাচা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মরহুম সোলায়মান মোল্লার কবর জিয়ারতে যান। তোফায়েল ভাই এবং আমাকে সঙ্গে নিয়ে দলের অন্য নেতা-কর্মীরাও পেছন পেছন আসতে থাকে। এরপর আমাদের বাসায় এসে আমার চাচি এবং বাবা কাকাদের সাথে কথা বলেন এবং ১৯৫৩ ও ৫৬ সালের ভোলা এসে আমাদের বাসায় অবস্থানের স্মৃতিচারণ করেন। আমাদের কোলে নিয়ে আদর করার কথা বলে, আমার দিকে তাকিয়ে স্নেহ মাখা হাসি দিয়ে বলেন, ছোট মজনু এখন বড় নেতা হয়ে গেছে।
১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী মরহুম হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সাথে ভোলায় জাতীয় সংসদের উপ-নির্বাচনের জনসভায় আসেন বঙ্গবন্ধু। সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী অ্যাডভোকেট ইউনুস মিয়া হেরে যান নেজামে ইসলামের প্রার্থী মতিউর রহমানের নিকট। ১৯৭০ এর ১২ই নভেম্বর স্মরণকালের ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাস এর ক্ষয়ক্ষতি দেখার জন্য ও মানুষের কষ্ট লাঘবের চেষ্টায় বঙ্গবন্ধু ভোলায় ছুটে আসেন ২০ নভেম্বর।
প্রশ্ন : তখনতো জাতীয় সংসদের নির্বাচন চলছিল ?
ফজলুল কাদের মজনু : হ্যাঁ, নির্বাচনী সফরে উনি বাগেরহাট ছিলেন। সেখান থেকে ছোট্ট একটি লঞ্চ জোগাড় করে ১৬ই নভেম্বর রওনা করে ২০ নভেম্বর ভোলায় আসেন এবং মরহুম বরশতউল্যা চৌধুরীর কালিনাথ বাজার সংলগ্ন বাসায় তোফায়েল ভাইয়ের নির্বাচনী কেন্দ্র ও থাকার স্থান হিসেবে চৌধুরী সাহেব দেন, সেখানেই বঙ্গবন্ধু অবস্থান নেন।
প্রশ্ন : তখন ভোলার কি অবস্থা ছিল?
ফজলুল কাদের মজনু : ভয়াবহ অবস্থা, এমনকি অনেকের বাসায় রান্নার চুলা পর্যন্ত ছিল না। আমি দ্রুত আমাদের বাসা থেকে চা এবং কিছু নাস্তা নিয়ে আসি (আমাদের বাসার রাস্তার ওপারেই) তিনি আমার কাছে ভোলার সামগ্রিক ক্ষয়-ক্ষতির কথা জানতে চান, বল্লাম। তিনি বঙ্গবন্ধু, জরুরী ভিত্তিতে কি কি করা যায় তাও তিনি জিজ্ঞেস করলেন। ভোলার বাজার থেকে কোন ত্রাণ সংগ্রহ করা যায় কিনা জানতে চান ? জানালাম, এই মুহূর্তে সম্ভব নয়। বললেন তাহলে কি করা যায় ? কাছের মেহেন্দিগঞ্জ বাজার থেকে হয়তো পাওয়া যাবে ! বঙ্গবন্ধু তোফায়েল ভাই কে ডাকলেন এবং ত্রাণ সংগ্রহ করার কথা বললেন। সিদ্ধান্ত মতো আমরা কয়েকজন পরের দিন মেহেন্দিগঞ্জ গেলাম। ভোলার হাবিবুর রহমান তালুকদারের গোলাম কাদির লঞ্চ নিয়ে। পাতারহাট বন্দরও গেলাম। সেখান থেকে যা পেলাম তা নিয়ে পরের দিন ভোলায় আসলাম ২২শে নভেম্বর। ১৯৭০ আমাদের নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সাথে মেঘনা উপকূল হয়ে মনপুরা গেলাম। পথে নদীতে তখনও ভাসছিল অসংখ্য লাশ। তা দেখে বঙ্গবন্ধু বিচলিত ও মর্মাহত হলেন। মনপুরা এসে নদীর পাড়ে বিরাণ ভূমিতে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন। ধ্বংসপ্রাপ্ত এক ভয়াবহ জনপদ। মনপুরায় তৎকালীন আওয়ামী লীগের নেতা বরশতউল্যা চৌধুরীর সাথে দেখা। তৎকালীন আওয়ামী লীগের নেতা বরকত উল্লাহ চৌধুরী কে খালি গায়ে দেখে বঙ্গবন্ধু তার গলায় ঝুলানো সালটি দিয়ে চৌধুরী সাহেবের শরীর ঢেকে দেন। ফিরে আসার সময় বিমর্ষ বঙ্গবন্ধুর নানান স্মৃতিকথা শুনতে শুনতে আমরা ভোলায় ফেরত আসি। এটা আমার জীবনের একটা শ্রেষ্ঠ সময়।
ভোলা এসে বঙ্গবন্ধু জানতে পারেন মাওলানা ভাসানী ভোলা এসেছেন। তিনি আমাকে নির্দেশ দেন তোদের গাড়িটা নিয়ে হুজুরকে নিয়ে আয়। আমি হুজুরকে আনতে ভোলার দৌলতখান গেলাম। আমি তাকে পাছুয়ে সালাম করে বললাম, বঙ্গবন্ধু আপনার জন্য গাড়ি পাঠিয়েছে। তিনি গাড়িতে উঠতে অস্বীকার করেন। হুজুরের সাথে তার একান্ত সচিব মাহফুজুল বারী ছিল। অগত্যা হুজুরের রিক্সার পিছন পিছন আমি আস্তে আস্তে গাড়ি নিয়ে এগোচ্ছিলাম। হুজুর ভোলা এসে এক সময়ের আওয়ামী লীগ সভাপতি হেদায়েত মোক্তার সাহেবের বাসায় উঠেন। মুক্তার সাহেবের বড় ছেলে সাজাহান ভুট্টো সাহেব ইউপি করতেন। আমি ফিরে বঙ্গবন্ধুকে গিয়ে জানাই। তিনি বলেন মুক্তার সাহেবের ফোন নাম্বার আছে ? আমি ফোন নাম্বার জোগাড় করে বঙ্গবন্ধুকে জানাতেই তিনি ফোন দিয়ে দীর্ঘ সময় হুজুরের সাথে একান্তে আলাপ করেন। পরের দিন জরুরি ভিত্তিতে বঙ্গবন্ধু ঢাকা চলে যান এবং সংবাদ সম্মেলন করেন। বন্যার কারণে উপকূলীয় কয়েকটি অঞ্চলে নির্বাচন পিছিয়ে ওই বছরের ডিসেম্বরের ১৭ তারিখ নির্ধারিত হয়।
প্রশ্ন : ডিসেম্বরে কি বঙ্গবন্ধু পুনরায় নির্বাচনী সফরে এসেছিলেন?
ফজলুল কাদের মজনু : বঙ্গবন্ধু ডিসেম্বরের নির্বাচনী সফরে পুনরায় ভোলায় আসেন, কিন্তু দুর্ভাগ্য ভোলায় পদার্পণ করেই তিনি সংবাদ পান চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা এমএ আজিজ মৃত্যুবরণ করেছেন। তিনি বিমর্ষ হয়ে পড়েন। তিনি প্রোগ্রাম বাতিল করে সিপ্লেন আনিয়ে নিয়ে দ্রুত চট্টগ্রাম চলে যান জানাজায় অংশ নেওয়ার জন্য।
প্রশ্ন : এরপর আপনার সাথে কি আর বঙ্গবন্ধুর দেখা সাক্ষাৎ হয়েছে?
ফজলুল কাদের মজনু : হ্যাঁ, তিনবার হয়েছে। দেশের শাসনভার হাতে নিয়ে মুক্তিবাহিনীকে অস্ত্র জমা দিতে বলেন। আমরা ঢাকা স্টেডিয়ামে মুজিব বাহিনীর সদস্যরা অস্ত্র জমা দিতে যাই। ভোলার লাইনের অগ্রভাগে আমি ছিলাম। তখন বঙ্গবন্ধু লাইনের সামনে এলে সালাম জানাই। দ্বিতীয়বার বাহাত্তরে তিনি বেড়িবাঁধের কাজ উদ্বোধন করতে ভোলার দৌলতখানে আসেন সেখানে দেখা হয়। তৃতীয়বার ৭৩ মার্চ মাসের শেষ দিকে ভোলার ছাত্রলীগের নেতৃবৃন্দকে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করতে যাই। তখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি। তিনি আমাকে উপদেশ দেন এখনতো ঢাকা ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছো, ভালো করে লেখাপড়া করবে। রাজনীতি করতে হলে দেশের জন্য কাজ করতে হলে পড়ালেখা জানতে হয়। এরপর ঢাকায় পড়ালেখা এবং নতুন পরিবেশে রাজনীতির কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। তার সাথে আর দেখা হয়নি।

মাহাবুবুল আলম নীরব মোল্লা
বীরমুক্তিযোদ্ধা ও সাংবাদিক।

ফেসবুকে লাইক দিন

আমাদের সাইটের কোন বিষয়বস্তু অনুমতি ছাড়া কপি করা দণ্ডনীয় অপরাধ।