খয়রাত চাইনা, বাদাম্মাগো খেদান

শোষণ আর শাসনের চক্রে চর মদনপুরের ১০ হাজার মানুষ

এইচ এম নাহিদ ॥ দুই যুগের উপরে হইবো চর ঝাগছে। ঝুপ জঙ্গল ছাপ কইরা ঘর তুলছি। চাষবাস কইরা, নদীতে জাল ফেলাইয়া খুব শান্তিতে ছিলাম। এহন আর শান্তি নাই। চরে জমি আলাগো জমি নাই, বাদাইম্মারা (বহিরাগত) এহন চরের জমিদার। বছর দশেক হইলো চরডার উপর ঠাডা পরছে। যাওনের যায়গা নাই হের লাইগা চরডায় পইরা আছি। এহন আর খয়রাত চাইনা, আমনেরা চরের তনে খালি বাদাইম্মাগোরে একটু খেদান। বলছেন চর মদনপুরের ৬০ উর্দ্ধে কৃষাণী মনেজা খাতুন (ছদ্ধনাম)।
অনুসন্ধানে জানা যায়, মেঘনার কোল ঘেষে জেগে উঠা একটি বিস্তৃর্ণ দুর্গম চর, চর মদনপুর। ভোলার দৌলতখাঁন উপজেলার ছিটকে পড়া বিচ্ছিন্ন একটি ইউনিয়ন। প্রায় ৮ হাজার একর জমি নিয়ে বিস্তৃত এই চরটি। এখানে দশ হাজার মানুষের বসতি। মৎস শিকার, কৃষিকাজ ও গবাদী পশু পালনই একমাত্র জীবন জীবিকার মূল উৎস। নদী ভাঙ্গন, বন্যা, খড়া ও নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগে টিকে থাকার ভিন্ন ধরনের জীবন ব্যাবস্থা। দেশের অর্থনীতির বিশাল সম্ভনাময় একটি বিস্তৃর্ণ এলাকা। সোনালী ফসল, পুকুরের মাছ গবাদী পশুতে যেন থৈই থৈই করে।
যাতায়াত ব্যাবস্থা বলতে পায়ে হাটা বা নৌকাই একমাত্র ভরসা। জীবিকা বলতে ভূমি মালিকের জমিতে কামলা খাটা, আর ভূমির অধিকার বলতে কতিপয় প্রভাবশালী ব্যক্তির মালিকানায় গড়ে ওঠা ভূমি ব্যবস্থার অধীনে ভূমিহীন বা প্রান্তিক কৃষকের দীর্ঘ সারি।
রয়েছে উৎপাদিত পণ্যার বাজারজাত সমস্যা, ন্যায্যমূল্য না পাওয়া, সামাজিক নিরাপত্তার অভাব, অভাব রয়েছে কর্মসংস্থান ও বিকল্প আয়ের উৎস, খাদ্য ও পুষ্টিমানের অভাব, অভাব রয়েছে স্বাস্থ্য ও শিক্ষার।
চরাঞ্চলে রয়েছে মানুষের জীবনে অনিশ্চয়তা ও চরম হতাশা। উন্নয়ন ও বৈষম্যর শিকার হচ্ছেন প্রতিনিয়ত। একটি প্রভাবশালী চক্র ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে কৃষকের খরের গরু, মহিষ লুট করা, ফসলি জমি বিনষ্ট করা, মাছ ধরার ট্রলার ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনা ঘটে। এখানে মানুষ মারার ঘটনা, মামলা,হামলা করে সর্বশান্ত করার বিষয় ও বিদ্যমান।
নিদৃষ্ট পরিকল্পনার অভাবে সরকারের বরাদ্ধের অর্থ চরাঞ্চলের মানুষের উন্নয়নে কখনো কাজে লাগেনি। এখানে প্রতিটি খেটে খাওয়া মানুষের জীবন যুদ্ধ এক অরক্ষিত বসতির সাক্ষ্য বহন করে। চারদিকে নিরব সুনশান অবস্থা বিরাজ করছে। অপরিচিত কোন পর্যটক বা গনমাধ্যম কর্মীদের দেখলেই যেন একটু মুক্তির স্বপ্ন দেখেন। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সংগ্রাম দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিরাট অংশের দাবিদার হলেও একধরনের শোষিত শক্তির আস্তাবলে পড়ে এই মানুষ গুলোর অর্জনগুলো কেড়ে নেয়া হচ্ছে। একধরনের শোষন আর শাসনের বেড়াজালের চক্রগুহে পড়ে বছরের বছর শুধু মাত্র মাটির টানে পড়ে কাটিয়ে দিচ্ছেন জীবন।
এই মানুষ গুলোর জীবনমান উন্নয়নে সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ছারাও বিভিন্ন সেচ্ছাসেবী সংগঠন তাদের টেকসই জীবনমান উন্নয়নে নিরলস ভাবে কাজ করছে। যাতে প্রান্তিক এই জনগোষ্ঠির জীবনমান উন্নয়নে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে সরকারের প্রচেষ্টা বাস্তবায়ণ হয়। আর এ বাস্তবায়ণে একমাত্র বাঁধা চর মদন পুরের স্থানীয় শাসন ব্যাবস্থা।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, স্থানীয় সরকার দলের হাউব্রীড শাসন কর্তা দিয়ে কোনদিন সরকার এই জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে দৃশ্যমান সাফল্য প্রতিষ্ঠা করতে পারবেনা। স্থানিয়রা বলছেন, নদী ভাঙে নদী জাগে চর হয়, ঘর তুলি ঘর ভাঙে, আমাদের মন ভাঙে কিন্তু সব কিছু দেখানো যায় না। আমরা সবসময় নদী ও প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করে ফসল ফলাই, মাছ ধরি। অনেক স্বপ্ন থাকে কিন্তু স্বপ্ন আমাদের কোনদিন বাস্তবায়ন করার সাহস পাইনা।


আদর্শ কৃষক আব্দুর রহমান (৫৫) বলেন, আমরা খনেক রাজা খনেক প্রজা। ভাঙ্গা গড়ার মধ্যে টিকে আছি। আমার বয়সেই আমার বাড়ি ৭ বার ভাঙ্গা দিয়েছে। তারপরও শুধু টিকে আছি এই মাটির ভরসায়।
কৃষক কদম আলী (৪৮) বলেন, এখানে বাপ দাদার নিশানা ধরে চাষবাস করে চলতে হয়। এখানে চরে প্রচুর ফসল হয়। ১৫ হাজার টাকা খরচা করে ঘরে কারেন্ট আনছি। সরকার কারেন্ট লইয়া গেছে। এহন সোলার চালাই, রাস্তা নাই ট্রলার, নৌকায় যাতায়াত করি।
কৃষাণী রিজিয়া (৪৫) ও সেলিনা বেগম (৪৮)’র সাথে কথা হলে বলেন, ধান খেতের বন বাচা, ঘাস কাটা, গরু ছাগল পাহাড়া দিয়া দিন চইলা যায়। চরে গরু চোরদের উৎপাতে অনেক সমস্যায় আছি। না খাইয়া যেটুকু চালান হইছে হেইডা যদি চোরেগো পেডে যায় তা-হইলে আর বাচন যাইবোনা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইউনিয়নের এক ইউপি সদস্য বলছেন, চেয়ারম্যান চরে তেমন একটা আসেননা, পরিষদের সকল কাজ কর্ম তার চেলা-ছোমরা দিয়া করায়। চরের যত সমস্যা আপনারা দেখছেন তার সকল নাটের গুরু চেয়ারম্যান। এখানে চেয়ারম্যানের ইশারা ছাড়া কিচ্ছু হয়না। তিনি চোরকে বলেন চুরি কর আর গৃহস্থরে কয় সজাগ থাক। এই নীতিতে আজ চরে কোন ভাল মানুষ থাকতে পারেনা। এই চর নিয়া যাদের মনে স্বপ্ন ছিল তারা আজ সর্বশান্ত।
চর মদনপুরের চেয়ারম্যান নাসির উদ্দিন নান্নু অভিযোগ শিকার করে বলছেন, গুরু চোর আর যায়গা জমির কিছু ঘটনা সত্য। সরকারি বরাদ্ধ’র বিষয়টি হল বরাদ্ধ কম, মানুষ বেশি তাই সবার মন খুশি করতে পারিনা। তাছাড়া খাস জমির বিষয় আমি কিছু জানিনা ইওনো জানেন। আপনারা যেহেতু বলছেন অনিয়মের বিষয় দ্রুত ব্যাবস্থা নেব। আমার এখানে কোন মাস্তান নাই। যারা ছিল তারা পলাতক আছে। এছাড়া অন্যান্য সুযোগ সুবিধা সহ চরের মানুষ আমার কারনে খুব শান্তিতে বসবাস করছে।
দৌলতখাঁন উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা পাঠান মো. সাইদুজ্জামান ভোলার বাণী’কে বলেন, চরটি যেহেতু উপজেলা থেকে বিচ্ছিন্ন তাই শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও যোগাযোগ ব্যাবস্থার সমস্যা আছে। আমরা এই বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করবো। আর বাকি যে বিষয়গুলো আছে তার সঠিক তদন্ত সাপেক্ষে প্রশাসনিক ব্যাবস্থা নেব।

ফেসবুকে লাইক দিন

আমাদের সাইটের কোন বিষয়বস্তু অনুমতি ছাড়া কপি করা দণ্ডনীয় অপরাধ।