আজ খাঁন বাহাদুর নূরুজ্জামান (এমবিই)’র ৫০তম মৃত্যু বার্ষিকী

আজ সাবেক এমবিই ও বিশিষ্ট আইন বিশারদ, ভোলার গণ মানুষের নেতা মরহুম এডভোকেট খাঁন বাহাদুর নূরুজ্জামান এর ৫০ তম মৃত্যু বার্ষিকী। এ উপলক্ষে রশিদ ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ ও ভোলার ডায়াবেটিক হাসপাতাল যৌথ উদ্যোগে মরহুমের কর্মময় জীবনের উপর এক আলোচনা ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করেছে। এ উপলক্ষে আজ বিকাল সাড়ে ৫টায় ভোলা ডায়াবেটিক হাসপাতালে এক আলোচনা ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে। এছাড়াও আছর নামাজ শেষে খলিফাপট্টি ফেরদাউস জামে মসজিদসহ শহরের বিভিন্ন মসজিদে মরহুমের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনায় দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে। এছাড়াও ভোলার পৌর এলাকার বেশ কয়েকটি মসজিদে মরহুমের আত্মার মাগফিরাত কামনায় দোয় অনুষ্ঠিত হবে।
মরহুম খাঁনবাহাদুর নূরুজ্জামান ১লা জানুয়ারী ১৮৯৫ ইং তারিখে বর্তমান ভোলা জেলার পুরাতন দৌলতখান থানায় তদান্তিন মহকুমার বিজয়পুর নামক গ্রামে সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম ছিল শেহালুদ্দিন মুন্সী ওরফে সেলু মুন্সী। ওই সময় বর্তমান ভোলা জেলা দক্ষিণ শাহাবাজপুর নামে পরিচিত ছিল। সেলু মুন্সীর একটি পাকাবাড়ী ছিল এবং চারদিকে ইটের দেওয়াল ছিল। তিনি ইসলাম ও সাধারণ জ্ঞান সম্পন্ন, ইংরেজী ভাষায় বিশেষ পারদর্শী ছিলেন।
নূরুজ্জামান ছোট বেলা থেকে ছিলেন প্রখর মেধাবি ও শুনিপুন কর্মবীর। তিনি লেখা পড়ার জন্য ভোলা, বরিশাল, নোয়াখালীর বিভিন্ন স্থানে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা সমাপ্ত করে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯১০ সালে এন্ট্রান্স পান করেন। তখনকার শিক্ষা কারিকুলাম অনুযায়ী কলিকাতা থেকে ১৯১২ সালে আইন বিষয়ে ডিগ্রী লাভ করেন। ১৯১৪ সালে তিনি ভোলা মহকুমার একজন মুসলিম আইনজীবী হিসেবে আত্মনিয়োগ করেন। সে সময় ব্রিটিশদের কষাঘাতে মুসলমানগণ উন্নতর জীবন থেকে বঞ্চিত ছিল। তৎকালীন সময়ে খাঁনবাহাদুর নূরুজ্জামান ভোলার অন্যতম ক্ষমতাধর আইনজীবী হিসেবে তাঁর নাম পূর্ব-পশ্চিম বাংলার সর্বত্র ছড়িয়ে পরে। আইনজীবী পেশায় তিনি স্বীয় যোগ্যতা ও দক্ষতার কারণে ভোলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও ব্রিটিশ সরকারের আইন উপদেষ্টা ছিলেন।
১৯২৩-২৫ সালে নূরুজ্জামান বর্তমান ধনিয়া ইউনিয়নের গঙ্গার্কীর্তি গ্রামে মল্লিকা বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করে নারী শিক্ষার অগ্রগতি সাধন করেন এবং ১৯২৫ সালে ভোলার প্রথম এ রব হাই মাদ্রাসা (নিউ স্কীম) তাঁর অকান্ত পরিশ্রমে প্রতিষ্ঠিত হয়। অর্থাৎ জৌনপুরের পীরে কামেল মরহুম মাওলানা আঃ রব (রহ:) এর উদ্যোগে উক্ত মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। যা কেবলমাত্র ইসলাম কেন্দ্রীক পাঠদান হত। অতঃপর খাঁনবাহাদুর নূরুজ্জামান শিক্ষাকে যুযোপযোগী করার লক্ষ্যে নিউ স্কীম তথা ইসলামের শিক্ষা ও সাধারণ শিক্ষার সমন্বয় করে সর্ব সাধারণকে শিক্ষার প্রতি উৎসাহিত করেন। ইহা মুসলমানদেরকে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করার একটি অপূর্ব নিদর্শন বটে। যা খাঁনাবাহাদুর নূরুজ্জামান সাহেবের চেষ্টায় শিক্ষা বিভাগ কর্ত”ক অবিভক্ত বাংলায় স্বীকৃতি লাভ করে।
১৯২৬ সালে ইংরেজ সরকার কর্তৃক অবহেলিত মুসলমানদেরকে উন্নত শিক্ষার লক্ষ্যে ভোলায় খাঁনবাহাদুর নূরুজ্জামানের নেতৃত্বে মুসলিম ইন্সটিটিউট এন্ড পাবলিক লাইব্রেরী স্থাপন করা হয়। যাহা মুসলমানদের শিক্ষার স্বতন্ত্র সংস্কৃতির বহিঃপ্রকাশ ঘটে। বর্তমানে তাহা নতুন আঙ্গিকে পরিচালিত হইতেছে। তিনি ১৯২৭-২৮ সালে বর্তমান ভোলার পুলিশ সুপার কার্যালয়ের সামনে প্রথম মেগা ডিপ কল স্থাপন করে ভোলার লোকদের বিশুদ্ধ পানিয় জলের সু-ব্যস্থার জন্য বিশাল দিঘি খনন করেন। অনুরুপ ভাবে ইলিশা রাস্তার মাথায় সরকারী দিঘী খনন করেন এবং রতনপুর বাজারের সরকারী দিঘী ও পূর্বে ইষ্টিমারঘাট সংলগ্ন দিঘী সবই তাঁর প্রচেষ্টায় খনন করা হয়। বর্তমানে উক্ত দিঘীসমূহ জেলা পরিষদ কর্তৃক পরিচালিত হচ্ছে।
১৯২৮-৩০ সালের মধ্যে ভোলা টাউন নাগরিক বিদ্যালয় স্থাপনের লক্ষ্যে ৭ সদস্য বিষিষ্ট কমিটি গঠিত হয়। তখন খাঁনবাহাদুর নূরুজ্জামানকে উক্ত কমিটির কনভেনর করা হয়। বিগত ১৯২১ সালে ভোলার প্রথম সেন্ট্রাল কো-অপারেটিভ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা হলে তিনি সর্ব প্রথম উক্ত ব্যাংকের সেক্রেটারী এবং বেশ কিছু কাল সভাপতি ছিলেন। তখন তাঁর নাম পূর্ব ও পশ্চিম বাংলায় প্রকাশ পায়। ব্রিটিশ সরকার ১৯৩৫ সালে তাকে স্বর্ণের সমবায় মেডেল প্রদান করেন। এসব কারণে তাঁকে ব্রিটিশ সরকার ১৯৩৭ সালে খাঁনবাহাদুর উপাধিতে ভূষিত করেন।
১৯৩৮-৪০ সালের মধ্যে খাঁনবাহাদুর নূরুজ্জামানের সত্য, ন্যায়-নিষ্ঠা, কর্ম দক্ষতা, যোগ্যতা, অভিজ্ঞতার সুনাম ভারত উপমহাদেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পরলে তিনি ব্রিটিশ সরকারের সু-দৃষ্টিতে পরেন। যার ফলে তাঁকে এমবিই টাইটেল দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। কিন্তু শর্ত ছিল যে কোন জমিদার ব্যতিত এমবিই টাইটেল পাইতে পারে না। তাই ব্রিটিশ সরকার তাঁর জমিদারী আইন সংশোধন পূর্বক কোর্ট জমিদার গেজেট নোটিফিকেশন এর মাধ্যমে তাঁকে বর্তমানে ভোলা জেলার চরফ্যাশন উপজেলার ৫০০ (পাঁচশত) একর জমি বরাদ্দ পূর্বক তাঁর নামে নুরাবাদ মৌজা এবং তার স্ত্রী আমেনা বেগমের নামে আমিনাবাদ মৌজা নামকরণ পূর্বক ঘোষণার মাধ্যমে কোর্ট জমিদার হিসেবে ১৯৪০ সালে স্বীকৃতি প্রদানের পর তাকে এমবিই (গবসনবৎ ঙভ ঞযব ঙৎফবৎ ঙভ ঞযব ইৎরঃরংয ঊসঢ়রৎব) উপাধিতে ভূষিত করেন। যা নুরাবাদ এস্টেট নামে পরিচিত ছিল। এরপর ১৯ জুন ১৯৪১ তারিখে এমবিই টাইটেলের এক বছর পূর্তি হিসেবে গেজেট প্রকাশ করা হয়। ব্রিটিশ সরকার ভোলার খাঁনবাহাদুর নূরুজ্জামান ব্যতিত উপমহাদেশে কাউকে জমিদার বানিয়ে এ বিরল সম্মান এমবিই টাইটেল প্রদান করেননি।
১৯৪১ সালের ২৫-২৬ মে বর্তমান ভোলা জেলায় এক অনাকাঙ্খিত প্রবল বন্যা হলে এ অঞ্চলে সরকারী হিসাব অনুযায়ী তিন হাজারের অধিক লোক প্রাণ হারায়। বাড়ি-ঘর, গাছ-পালা বিলিন হয়ে যায়। ব্রিটিশ সরকার অত্র এলাকার জন্য কোন সাহায্য দেননি। যার কারণে নূরুজ্জামানকে ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক জমিদারি এষ্টেট অর্থাৎ নুরাবাদ ও আমিনাবাদ মৌজার ৫০০ (পাঁচশত) একর জমি বিক্রয় করে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের লঙ্গর খাইয়ে জীবন বাঁচিয়ে ছিলেন।
১৯৪৬ সালে অবিভক্ত ব্রিটিশ ভারতের তিনি ভোলার একমাত্র বঙ্গিয় আইন পরিষদের (এমএলএ) প্রার্থী হিসেবে বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন। নূরুজ্জামান সাহেব পূর্ব বাংলার গণপরিষদের (বিধান সভার) সদস্য হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৪৬ সালে অবিভক্ত বাংলায় হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িক (ঈড়সসঁহধষ জরড়ঃ) দাঙ্গায় বহু হিন্দু-মুসলমান মারা যায় ও ক্ষয়-ক্ষতির সম্মুখিন হয়। কিন্তু ভোলা মহকুমায় খাঁনবাহাদুর নূরুজ্জামানের অকান্ত পরিশ্রম ও অভিজ্ঞতা ও দুরদর্শিতায় কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে নাই। হিন্দু-মুসলমান সকলেই একই সাথে শন্তিপূর্ণভাবে বসবাস করেছে।
১৯৪৭ সালের ১৪ই আগষ্ট ভারত উপমহাদেশ দ্বি-জাতিতত্ত্ব ভিত্তিতে পাকিস্তান ও ভারত নামে দুটি রাষ্ট্র সৃষ্টি হইলে খাঁনবাহাদুর নূরুজ্জামান পূর্ব পাকিস্তান গণপরিষদের (বিধান সভার) সম্মানিত সদস্য হিসেবে ১৫ই আগষ্ট যোগদান করেন। যে সময় কায়েদ আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ সাহেবের নির্দেশে ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক পূর্বে দেওয়া সকল সম্মাননা মেডেলসমূহ ফেরত দেওয়ার নির্দেশ দেন। তখন খাঁনবাহাদুর নূরুজ্জামান তাঁর সকল সম্মাননা মেডেলসমূহ লন্ডনে ফেরত পাঠিয়ে দেন। ১০০ গ্রাম ওজনের প্লাটিনাম মেডেল এবং ১০০ ভরি স্বর্ণের মেডেল যার বর্তমান মূল্য ৫০ কোটি টাকা।
উল্লেখ্য, যে ব্রিটিশ স¤্রাট যাদেরকে ভারতীয় উপমহাদেশে সম্মাননা মেডেল দিয়ে ছিলেন খাঁনবাহাদুর নূরুজ্জামান ছাড়া অন্য কেউ তা ফেরত দেননি। তিনি ১৯৩০ সাল থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত বরিশাল জেলা বোর্ডের সম্মানিত সদস্য ছিলেন। তিনি ১৯৪৭ সালের ১৫ আগষ্ট হইতে ১৯৫৪ সাালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান সরকারের গণপরিষদের (বিধান সভার) সম্মানিত সদস্য ছিলেন। পাকিস্তান রাষ্ট্রের শেষ দিকে বৃদ্ধ বয়সে খাঁনবাহাদুর নূরুজ্জামান সাহেব অবসরে দিন অতিবাহিত করতেন।
তখন ১৯৬৯/১৯৭০/১৯৭১ এর অগ্নি ঝড়া দিনগুলির প্রতি তিনি আন্তরিক সমর্থন ব্যক্ত করেছেন। তখন তার বড় কন্যা টিএন রশিদ (ডি লিট) কবিরতœকে অসহযোগ আন্দোলন পরিচালনা পূর্বক স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে বাঙ্গালী জাতিকে রক্ষার নির্দেশ দেন। খাঁন বাহাদুর নূরুজ্জামান সাহেবের নির্দেশে টিএন রশিদ তখনকার আওয়ামীলীগের কিছু সংখ্যক মহিলা প্রেসিডিয়াম সদস্য সহকারে (যাদের মধ্যে অনেকেই বর্তমান সরকারের মন্ত্রী পদে বহাল আছেন) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শেষ বর্ষের অনেক ছাত্রী ও ঢাকার বিভিন্ন কলেজের জিমনেসিয়ামের ছাত্রীসহকারে সর্বমোট ২০০ জনকে নিয়ে ঢাকা সিটি মহিলা সংগ্রাম পরিষদ গঠন পূর্বক দেশমাত্রিকা স্বাধীনতার জন্য রাইফেল ট্রেনিং ও নার্সিং প্রশিক্ষণ দেন। টিএন রশীদ (ডি লিট) কবিরতœ এর নেতৃত্বে প্রশিক্ষণ দলটি ১৯৭১ এর ২৩ মার্চ মরিচা হাউজ (সাজেদা চৌধুরীর বাসভবন) থেকে মানিক মিয়া এভিনিউ দিয়ে দেশ-বিদেশের সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তাঁর ৩২ নম্বর ধানমন্ডির বাসভবনে (বর্তমানে যাদুঘর) গার্ড অব অনার প্রদান করেন এবং টিএন রশীদের হাতে থাকা বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত পতাকা বঙ্গবন্ধুর হাতে তুলে দেন। উল্লেখিত ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হলে ভোলার মুক্তিযোদ্ধাগণ খাঁনবাহাদুর নূরুজ্জামানের স্বাধীনতা প্রাপ্তির (সম্মান প্রদর্শণ করেন) গার্ড অব অনার প্রদান করেন।
অবশেষে মহান এই কর্মবীর খাঁনবাহাদুর নূূরুজ্জামান ১৯৭২ সালের ১২ সেপ্টেম্বর (আজ) ৭৭ বছর বয়সে তাঁর ভোলা শহরের উকিলপাড়াস্থ নিজ বাসভবনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। আজকের এই দিনে ভোলাবাসী তাকে গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছে।

ফেসবুকে লাইক দিন

আমাদের সাইটের কোন বিষয়বস্তু অনুমতি ছাড়া কপি করা দণ্ডনীয় অপরাধ।