সর্বশেষঃ

নদীয়ার উদার আকাশ

সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসায় নৌকার মাঝি পাশের গাঁয়ে বাড়ি গেছে হয়তো। নদীর পাড়ঘেঁষা পাকা সড়ক। কী সুন্দর সরিষার খেত! অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়। মাঝে মাঝে আলু, বাদামের খেতে সবুজের সমারোহ। নদীর পানি কী স্থির! চলছে শীতের আমেজ। তাই যেন গঙ্গা ডাকে তার বুকে, গঙ্গাপারের মনোহরপুরে আছে তিনটা টং দোকান। একটা চায়ের দোকান—শ্রীমতী তরী নন্দী (৪৯) একাই চালায়। চা দিতে দিতে জানাল, তার চার মেয়ে, দুইটার বিয়ে হয়েছে। একজন বিএ, অন্যজন মাধ্যমিকে পড়ে। স্বামী অসুস্থ, সে দিনে ১০০, ১৫০ রুপি বেচাকেনা করে। এতেই কষ্ট করে সংসার চালাতে হয়। শহর থেকে অনেক দর্শনার্থী ঘুরতে আসছে নদীপাড়ে ঘাটের দৃশ্য দেখতে। ভাঙা পাকা সিঁড়ি। গঙ্গা নদীর ঘাটে মধ্যবয়সি কৃশকায় খেতমজুর হরিদাস কাজ শেষে এক কাপড়ে পড়ন্ত বিকেলে গোসল করতে সিঁড়ির শেষ প্রান্তে দাঁড়ালে কাছে গিয়ে আমিসহ ছবি তুললাম। এই শীতে হাঁটুতক মলিন ধুতি কাপড়ে দেখে গান্ধীজির সেই খালি গায়ে লাঠি ভর দিয়ে অর্ধধুতি পরা ছবির কথাটি মনে ভেসে এলো। যেন এপার এবং ওপার বাংলার পরিবেশ পরিস্থিতি একই। একই বঞ্চনা-গঞ্জনা-বৈষম্য

আমার গাইড ড. শুভংকর মণ্ডল সঙ্গেই আছে। প্রস্তাব দিল আরেকটু এগোলেই একটি মুসলিম গ্রাম আছে, সেদিক দিয়েও কল্যাণী ফেরা যাবে। গ্রামে মোট ১ হাজার ৩০০ মুসলিম পরিবারের বসবাস। পথে একটা মসজিদ দূর থেকে দেখাল। যেতে গ্রাম পঞ্চায়েত কার্যালয়ও রাস্তার পাশে চোখে পড়ল। গরিবি চেহারা, দরজা বন্ধ। বিকাল ৪টা। চান্দাবাড়ী বাজার ক্রস করলাম। আমাদের দেশের বৃহত্ নোয়াখালী জেলার রামগতি থানার হিন্দু অধ্যুষিত চর সীতা ও চর আলেকজান্ডার বুড়া কর্তার আশ্রমকেন্দ্রিক গ্রামের কথা মনে উঠল। সময় কম। ৫টার মধ্যে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছাতে হবে, সেখানে উপাচার্য মহোদয়ের সঙ্গে সাক্ষাত্ করার কথা। আছে প্রোগ্রামও। আমার হোস্ট ফারুক সাহেব অপেক্ষা করছেন। ড. শুভংকর আমাকে পৌঁছে দিয়ে বিদায় নিলেন। দ্রুততার সঙ্গে গ্রাম ঘুরে এমন একটি সহজ অথচ মৌলিকত্ব বিষয় দেখার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য গ্রামোন্নয়ন ডিপার্টমেন্টকে ধন্যবাদ।

সন্ধ্যা হয়েই গেল। কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্যের কার্যালয়ের সামনে ফারুক আহমেদ সাহেব ঠিকই ফুলের তোড়া হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন আমাকে স্বাগত জানানোর জন্য। স্থানীয় পত্রিকার ‘উদার আকাশ’-এর পক্ষ থেকে সাদামাটা এক অনুষ্ঠানে চা-বিস্কুটের আয়োজন ছিল। দুই বাংলার উন্নয়নের পথপরিক্রমা নিয়ে আলাপ-বিনিময় হলো উপ-উপাচার্য ড. গৌতম পাল ডিএসসির গোছালো অফিসকক্ষেই। বিশ্ববিদ্যালয়, বিশেষ করে রুরাল ডেভেলপমেন্ট ডিপার্টমেন্টের মাধ্যমে আমাদের বেসরকারি সংস্থা ডর্প-এর সঙ্গে একাডেমিক ও মাঠ অভিজ্ঞতা বিনিময় হলো, আলোচনা হলো। বিজ্ঞানী ড. প্রফেসর গৌতম পাল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এক লেকচার সেশনে এসেছিলেন বলে জানালেন। ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষায় ‘ডর্প’ প্রকাশিত নূর কামরুন নাহার সম্পাদিত ‘জলের গল্প’ এবং আ হ ম ফয়সলের লেখা ‘গুসি আন্তর্জাতিক শান্তি পুরস্কার বিজয়ী-২০১৩ মাতৃবন্ধু এ এইচ এম নোমান’ এই দুটি বই তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে দিলাম। একপর্যায়ে ‘প্রচারহীনবীরত্ব—Unsung Hero’ শিরোনামে উপ-উপাচার্য ড. পাল আমাকে অ্যাওয়ার্ড প্রদান করে অভিষিক্ত করেন। ‘উদার আকাশ’ পত্রিকা ও প্রকাশন এই আয়োজন করে। ধন্যবাদ কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়কে, ধন্যবাদ উদার আকাশ ও সংশ্লিষ্টদের—তাদের আকাশসম উদারতার জন্য।

বিকেলে ফারুক সাহেবের বাসায় গেলাম। মিসেস ফারুক-মৌসুমী কথাবার্তায় ও পোশাক পরিচ্ছদে শালীন। কথাবার্তা বলেন মেপেঝেপে। ডাবল মাস্টার্স এমএডও করেছেন। দেখতে মানানসই ভদ্র। ফরসা-লম্বাটে। চোখা নাকের পাশে একটি বিউটি স্পটও আছে। চোখে পড়ার মতো। বাবা হাইস্কুলের হেডমাস্টার ছিলেন। মাঝেমধ্যে ঝি-নাতনিজামাই দেখতে ও বেড়াতে কল্যাণী আসেন। মেয়েকে স্কুলে আনা-নেওয়া, বাসা গোছগাছ, রান্নাবান্না, সামাজিকতা রক্ষা ইত্যাদি কারণে মৌসুমীর চাকরির ইচ্ছা থাকলেও করতে পারেন না। বাসায় কাজের লোকের সংস্থান নেই। তাই একা সব সামলাতে হয়। টেবিলে মাছের কাটলেট, বিস্কুট, চা দিতে দিতে ফাঁকে ফাঁকে এসব কথা আলাপচারিতায় জানা গেল। মেয়ে রাইতা আমাকে ঘরে ঢুকতে দেখেই যেন বাঁধা পাখির খাঁচা থেকে ছুটে দৌড়ে এলো। বোঝা গেল, পড়ার বোঝায় শিক্ষাকক্ষে বন্দি বাংলাদেশের শিশুদের মতোই ওর অবস্থা।

কিছুক্ষণের মধ্যে রাইতার মা-বাবা তৈরি হয়ে গেল। আমারও ক্লান্তির কিছুটা অবসান হলো। বের হতে চাইলে ফারুক ভাই বললেন, ‘অসুবিধা নাই, হোটেলে দিয়ে আসবক্ষণ।’ তাড়া করে বেরিয়ে পড়লাম। নিচে নেমে গ্যারেজে দেখি মৌসুমী গাড়ি প্লেস করল। রাইতা ওর বাবাসহ পেছনে। মৌসুমীর ড্রাইভিংয়ে, পাশের সিটে আমি। এই কথা সেই কথা বলতে বলতে কিছুক্ষণের মধ্যেই হোটেলে পৌঁছে গেলাম। অনুরোধ করায় একসঙ্গেই রাতের ডিনার সবাই মিলে করলাম। মৌসুমী আর রাইতাই মেনু ঠিক করেছে।

ফেরার সময় মৌসুমী জোর করেই বলল, কাল যাওয়ার সময় সকালে আমার বাসায় নাশতা করে যাবেন। ৮টা-৯টার মধ্যে বের হতে হবে জানালে বললেন, ‘আমি তার আগেই সব রেডি রাখব। ড্রাইভার সমির দাশ আমার বাসা চেনে।’ আলোচনায় গরম ভাত, ডিম ভাজি, ঘন ডাল ঠিক হলো। ফারুক ভাই কৃষিমেলা থেকে আনা তালবেগুনের ভাজি যোগ করল। সমীর ঠিকই সকাল ৯টার মধ্যেই ফারুক ভাইয়ের বাসায় নিয়ে গেল। রাইতা ঘুমে না সজাগ ছিল মনে নেই। পুরো বাঙালি খানা। মজা করে খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম। দেড় ঘণ্টার ট্যাক্সিপথে কলকাতা এয়ারপোর্টের উদ্দেশে। ফারুক ভাই, ভাবি, আবার যেন তাদের ভাবি (আমার বেগম)সহ বেড়াতে আসি, তাদের বাসায় উঠি এবং থাকার নিমন্ত্রণ জানিয়ে হাত উঁচিয়ে বিদায় দিলেন। বিদায় কল্যাণী! বিদায় নদীয়া!

লেখক : গুসি আন্তর্জাতিক শান্তি পুরস্কার বিজয়ী সমাজকর্মী ও কলামিস্ট

সূত্র- ইত্তেফাক

ফেসবুকে লাইক দিন

আমাদের সাইটের কোন বিষয়বস্তু অনুমতি ছাড়া কপি করা দণ্ডনীয় অপরাধ।