প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে ডেল্টা কাউন্সিল গঠন ও পরিকল্পনা গ্রহণ প্রসঙ্গে

বাংলাদেশ ডেল্টাপ্লান-২১০০ বাস্তবায়নের জন্য প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে “ডেল্টা কাউন্সিল” গঠন করা হয়েছে। আমরা জানি বাংলাদেশ একটি গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ রাষ্ট্র। নদী মাতৃক বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে ২৩০টি ছ্টো বড় নদী বয়ে চলেছে। তার মধ্যে বাংলাদেশের উপকূলীয় সমুদ্র তটরেখার দৈর্ঘ ৭১০ কিলোমিটার। এই বিশাল তটরেখায় বসবাস করে ৩ কোটি ৪৮ লাখ এর মতো মানুষ। বাংলাদেশের উপকূল এলাকা সংকট ও সম্ভাবনাময় অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত। এখানে ঘূর্ণিঝড়, সামুদ্রিক জ্বলোচ্ছ্বাস যেমন বেশি, তেমনি অর্থনৈতিক সম্ভাবনা রয়েছে প্রচুর। সমগ্র দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে রপ্তানি বাণিজ্য এর ক্ষেত্রে এই উপকূল অঞ্চলকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। এছাড়া মুল ভূ-খন্ড দিয়ে বাংলাদেশের প্রধান নদী পদ্মা, মেঘনা, ব্রহ্মপুত্র নদী দিয়ে হিমালয় থেকে নেমে আসা পানি বর্ষার মৌসূমে প্রবাহিত হওয়ার ফলে বাংলাদেশে প্রতি বছর বন্যার প্রকোপের শিকার হতে হয়। বাংলাদেশে সাধারণত তিন ধরনের বন্যার প্রকোপ দেখা যায়। মৌসূমী বন্যা, আঞ্চলিক বন্যা, সামুদ্রিক অতি জোয়ারের ফলে প্লাবন এর বন্যা।
বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ২৬ হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকা বন্যায় প্লাবিত হয়। বন্যা পরিস্থিতির স্থায়ী সমাধানের জন্য এখন পর্যন্ত কার্যকরী কোন পদক্ষেপ লক্ষ্য করা যায় নাই। ২০১৮ সালের ৪ঠা সেপ্টেম্বর, বন্যা নদী ভাঙ্গন, নদী ব্যবস্থাপনা ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও নিস্কাশন ব্যবস্থাপনার দীর্ঘ মেয়াদী কৌশল হিসাবে আলোচিত “ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০ অনুমোদন দেয় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ, (এনইসি) প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে। ডেল্টা প্লান নামে পরিচিত শত বছরের এই মহাপরিকল্পনার অধিনে আপাতত ২০৩০ সালের মধ্যে বাস্তবায়নযোগ্য ৩০টি প্রকল্প হাতে নিয়েছে বর্তমান সরকার। উক্ত পদক্ষেপগুলি গ্রহণ করার ক্ষেত্রে যাচাই-বাছ্ইা ও মতামত নেয়ার জন্য প্রতি জেলা থেকে সরকার কর্তৃক মনোনিত সমাজ ভিত্তিক ও রাজনৈতিক ধ্যান-জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা সম্পন্ন একজন ব্যক্তি নিয়ে একটি ডেল্টা প্লানিং কাউন্সিল গঠন করা যায় কিনা তা ভেবে দেখার জন্য প্রস্তাব রইলো। এই বিশাল মহা বড় এর প্লান প্রোগ্রাম প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে এই কাউন্সিল একটি ভালো ভূমিকা পালন করতে পারে। আমরা ইতিপূর্বে পাকিস্তান আমলে আমাদের দেশের বন্যা নিয়ন্ত্রণ এর স্থায়ী ব্যবস্থা নেয়ার জন্য ক্রগ মিশন গঠন এর কথা জেনেছি। উক্ত মিশন বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য স্থায়ী সমাধানের জন্য বিশেষত পর্যায় মতামত নিয়ে রিপোর্ট প্রদান করেন এবং উক্ত রিপোর্ট এর ভিত্তিতে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার প্রস্তাব করেন। কিন্তু রিপোর্ট কাগজে কলমেই থেকৈছে, তা সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়নের কোন পদক্ষেপ লক্ষ করা যায় নাই। বিশেষ উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশের সম্প্রসারিত অর্থনীতি ও অপরদিকে সামাজিক উন্নয়নে পানির ভূমিকা অপরিহার্য গুরুত্বপূর্ণ।
১৯৫৭ সালে ক্রগ মিশনের রিপোর্টে বলা হয় যে, এদেশের মতো এতো অধিক বড় বড় নদী বিধৌত অঞ্চল বিশ্বে আর কোথাও নেই। দুইটি বৃহৎ আন্তর্জাতিক নদী গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র বাংলাদেশের মুল কেন্দ্রস্থল দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এই নদীগুলি বিপুল সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে চলছে। বলা চলে এই নদীগুলি সম্পূর্ণভাবে অনিয়ন্ত্রিত ড্রেজিং ও বড় বড় নির্মিত ব্রীজ এর কাঠামোতে যদি পানি নিয়ন্ত্রণের গেইট যোগ করা হতো, তা হলে, নদীর ¯্রােতধারা নদীর মাঝামাঝি দিয়ে প্রবাহিত করা যেত। তাতে করে নদীর নাব্যতা সংকট থাকতো না। এমনকি তীর ভাঙ্গার হাত থেকে বেচে যেত বিপুল পরিমান ভূমী। অনিয়ন্ত্রিত নদীর কারণে ভাঙ্গা গড়ার প্রতিনিয়তই চলছে। এর ফলে নদীর মাঝে যাতায়াত পথে ডুবোচর সৃষ্টি হচ্ছে, নদীকূলে এসে আঘাত করছে। প্রতি বর্ষা মৌসূমে উপর থেকে তিব্র ভেঙ্গে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল দেশের উপরিভাগে ও উপকূলিয় এলাকার নিন্মভাগে সর্বগ্রাসী বন্য আর প্রলংকারী ও ঘূর্ণি বার্তার ফলে বিপুল পরিমান ক্ষয়-ক্ষতি হয়। অধুনা দেখা ঢলের পানির সাথে ব্যাপক পলি, বালি আসার ফলে নদীতে ত্রুত চর জাগছে। প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে নৌ-পথ এর, বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বঙ্গোপসাগর এর দিগে দেয় আসা পানি প্রবাহ, উপচে পরছে উপকূলীয় অঞ্চল। মেঘনা, যমুনা, গঙ্গা, পদ্মা নদীর পানির প্রবাহ প্রতি বছর বঙ্গোপসাগরে ১১৭ কোটি কিউবিক ঘনফুট পানি নেমে যায়। উপরের এই পানি বাংলাদেশের স্থলভাগের ৩৪ ফুট পর্যন্ত নিমজ্জিত করার জন্য যথেষ্ট। এই পানি বৃহত্তম অংশই অনিয়ন্ত্রিত।
আমরা জানি ১৯৬০ সালে উপকূল ভাগে বেড়ীবাধের কাজ শুরু হয়। সেই সময় বেড়ীবাধের উচ্চতা ছিল ১৬ ফিট, স্লোপ ছিল ৫৮ ফিট। দেশ স্বাধীন এর পর ১৯৭২ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ভোলাতে এসে দৌলতখান উপজেলার জিরো পয়েন্টে প্রথম অসমাপ্ত বেড়ীবাধের কাজ উদ্বোধন করেন। সেই সময় এর বাধ এর উচ্চতাও ছিল ১৬ ফিট। ৭০ এর প্রলংকরী ঘূর্ণিঝড় এর ফলে সাগর এর জলোচ্ছ্বাস এই ১৬ ফিট উচ্চতার বাধ অতিক্রম করে পানি ভিতরে ঢুকে বিপুল পরিমান জানমালের ক্ষতি সাধন করেছিল। বর্তমানে আগের উচ্চতার বেড়ীবাধ আর নাই বল্লেই চলে, কারণ নদীকূলের বেড়ীবাধ নদী ভাঙ্গনের ফলে সম্পূর্ণ বিলিন হয়ে যায়। এমতাবস্থায় প্রথমত : বেড়ীবাধ নির্মাণ করার আগে নদী শাসন এর জন্য সম্পূর্ণ নদীর পারে ব্লক, জিওব্যাগ এর বস্তা দিয়ে তীর সংরক্ষণ করতে হবে।
দ্বিতীয়ত : ১৬ ফিট উচ্চতার বেড়ীবাধ নির্মাণ করতে হবে। বাধেল ব্লকে কংক্রিট এর স্লাব স্থাপন করতে হবে।
তৃতীয়ত : নদী অনুশাসন এর জন্য ছোট ছোট শাখা নদীগুলিতে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে সার্ভের মাধ্যমে আড়া আড়ি বাধ দিয়ে মূলনদীর প্রবাহ সোজা করতে হবে। একে করে ভূমী পুনরুদ্ধার হবে। বিপুল লোকের কর্মসংস্থান ও ফসল উৎপাদন হবে।
চতুর্তত : নদীর পানির প্রবাহকে দ্রুততর করার জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন সাগর মোহনায় ভরাট হয়ে যাওয়া মাটি, চর ড্রেজিং এর মাধ্যমে নাব্যতা তৈরী করে দিতে হবে। এতে করে ¯্রােত এর তিব্রতা বৃদ্ধি পেয়ে সাগরে উপচে পরা পানি প্রবল বেগে নেমে যেতে সুবিধা হবে। এতে করে বন্যা সমস্যা কমে যাবে এবং আরো একটি লাভ হবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। নদীর মোহনায় ¯্রােত এর বেগ বেশি থাকলে উজানে ইলিশের গতি নদীতে ধাবমান হবে এবং মাছের বংশ বৃদ্ধিতে সুযোগ ঘটবে। আমরা স্থানীয় অভিজ্ঞতা থেকে জানি, উজান বা তীব্র ¯্রােত না থাকলে ইলিশ মাছ নদীতে আসে না।
পঞ্চমত : পদ্মা, যমুনা, মেঘনা, ব্রহ্মপুত্র নদীর মাঝে জেগে ওঠা চর সম্পূর্ণ কেটে তুলে নিতে হবে। এই ক্ষেত্রে প্রাইভেট ড্রেজার কোম্পানীকে যদি দায়িত্ব দেয়া যায়। তাহলে তারা কেটে নেয়া মাটি, বালি বিক্রি করে খরচ তুলে নিয়ে ব্যবসা করতে পারবে। সরকারের অপচয় রোধ হবে। বর্তমান উন্নয়ন অভিযাত্রার বাড়ী, ঘর শিল্প কর-কারখানা সহ বিভিন্ন সরকারের মেঘা প্রজেক্টে বালি, মাটির প্রচুর চাহিদা আছে। সরকারের নীতিমালা না থাকার কারণে নদীর যত্রতত্র স্থানীয় বল কেটে ড্রেজার এর মালিকগণ বালি, মাটি তুলে অবৈধ ভাবে ব্যবসা করে লাভবান হচ্ছেন।
অন্যদিকে প্রতি বছর বঙ্গোপসাগরে নদীর প্রবাহিত পলি মাটির প্রবাহ এর ফলে সাগর বক্ষে বিশাল বিশাল চর জেগে উঠেছে। এর যেমন সম্ভাবনা আছে এবং প্রতিকুলতাও আছে। সমীক্ষা ও পর্যালোচনার মাধ্যমে দেখতে হবে এর উপযোগিতা চাইতে পরিবেশ ক্ষতির পরিমান বেশি কিনা। কারণ এই বিপুল বালি মাটি সাগর বক্ষে গিয়ে চর সৃষ্টির ফলে তাতে উপকূলে অবস্থিত আমাদের বন্দর সমূহ নাব্যতা সংকট এর কারণে অচল হয়ে পরে কিনা। কারণ বন্দরগুলি উপকূল এর মুল ভূ-খন্ড ঘেষে স্থাপিত হয়েছে। অপরদিকে সম্ভাবনার বড় দিক হলো, উপকূলের জেগে ওঠা চরে বনায়ন করতে পারলে ইকোলজিকাল এমব্যালেন্স চেক দিতে পারবে। এতে করে প্রতি বছর সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস থেকে মুল ভূ-খন্ড রক্ষা পাবে। এছাড়া চাষাবাদ, গবাদি পশুর চারণ ক্ষেত্র হিসেবে পাওয়া যাবে জেগে ওঠা ভূমিকে।
এছাড়া সরকার জলবায়ু পরিবতনে ভূমিহীন ছিন্নমুল মানুষ এর জন্য কক্সবাজার এর মতো জলবায়ু পরিবর্তন বহুতল বিশিষ্ট আশ্রায়ন প্রকল্প করে দিতে পারে। তাদেরকে কর্মসংস্থান ও ঋণ এর মাধ্যমে স্বাবলম্ভি করে তোলা যাবে। আমাদের দেশে এখনো না খেয়ে থাকা মানুষ এর সংখ্যা ৪০ লাখেরও অধিক। ডেল্টাপ্লান ২১০০ বাস্তবায়নে এটা একটা সুদুর প্রসারী পদক্ষেপ হতে পারে।

লেখক : ফজলুল কাদের মজনু
সভাপতি
ভোলা জেলা আওয়ামীলীগ।

ফেসবুকে লাইক দিন

আমাদের সাইটের কোন বিষয়বস্তু অনুমতি ছাড়া কপি করা দণ্ডনীয় অপরাধ।