অগ্নিঝরা ২৪ মার্চ : অস্ত্র খালাস না করায় শ্রমিকদের হত্যা করে পাকিস্তানিরা

ডেস্ক রিপোর্ট ॥ একাত্তরের অগ্নিঝরা মার্চের ২৪তম দিন আজ। ১৯৭১ সালের এই দিনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের মধ্যকার পূর্বনির্ধারিত বৈঠকটি বাতিল হয়ে যায়। এদিকে করাচি থেকে ‘সোয়াত’ জাহাজে করে আনা পাঁচ হাজার ৬৩০ টন অস্ত্র নামাতে এদিন বাঙালি শ্রমিকরা অস্বীকৃতি জানান এবং প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।
অবরোধ করে রাখেন জাহাজটিকে। একপর্যায়ে পাকিস্তানি সৈন্যরা শ্রমিকদের ওপর নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে। সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুবরণ করেন বেশ কয়েকজন স্বাধীনতাকামী শ্রমিক। এছাড়া সৈয়দপুরে বিহারি ও পাকবাহিনী এদিন গণহত্যা চালায়।
এদিন বঙ্গবন্ধুর উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ ও ড. কামাল হোসেন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের উপদেষ্টাদের সঙ্গে এক বৈঠকে মিলিত হন। প্রায় তিন ঘণ্টার ওই বৈঠক শেষে তাজউদ্দীন আহমদ প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে বেরিয়ে উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, বৈঠকে আমরা প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে অবিলম্বে সংসদ অধিবেশন ডেকে পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানিয়েছি।
একাত্তরের এদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে আগত মিছিলকারীদের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রায় বিরামহীনভাবে ভাষণ দেন। তিনি বলেন, আর আলোচনা নয়, এবার ঘোষণা চাই। আগামীকালের (২৫ মার্চ, ১৯৭১) মধ্যে সমস্যার কোনো সমাধান না হলে বাঙালিরা নিজেদের পথ নিজেরা বেছে নেবে। আমরা সাড়ে সাত কোটি মানুষ আজ ঐক্যবদ্ধ।
কোনো ষড়যন্ত্রই আমাদের দাবিয়ে রাখতে পারবে না। সরকারের প্রতি হুশিয়ারি উচ্চারণ করে বঙ্গবন্ধু বলেন, বাংলার জনগণের ওপর কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়া হলে তা বরদাশত করা হবে না। তিনি বলেন, আমি কঠোর সংগ্রামের জন্য বেঁচে থাকব কিনা জানি না। আপনারা আন্দোলন চালিয়ে যাবেন। মানুষের মতো স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকব, নয়তো সংগ্রামে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাব।
একাত্তরের এদিন থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানি নেতারা একে একে ঢাকা ত্যাগ করতে শুরু করেন। পশ্চিম পাকিস্তানের ছোট ছোট পার্লামেন্টারি দলের সব নেতাই এদিন করাচির উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেন। ভুট্টোর সফরসঙ্গী ১৩ জনের সাতজনই এদিন ঢাকা ত্যাগ করেন।
এদিনও সারা বাংলাদেশে অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজসহ বিভিন্ন ভবনে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা ওড়ে পতপত করে। ইস্ট বেঙ্গল পাকিস্তান রাইফেলসের যশোর ট্রাংক রোডের অফিসেও এদিন ওড়ে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। এদিকে ইয়াহিয়া খানের আমন্ত্রণে পাকিস্তান থেকে খান আবদুল কাইয়ুম খান ঢাকায় আসেন। কাইয়ুম ঢাকা আসার পরই ইয়াহিয়া ও ভুট্টোর সঙ্গে এক বৈঠকে বসেন।
এদিকে এতদিন যারা দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছিলেন, তারাও বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের প্রতি পূর্ণ আস্থা ও সমর্থন ব্যক্ত করতে শুরু করেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নির্বিচার গুলি, আন্দোলনরত বাঙালির ওপর নির্যাতন, চরম দুর্ব্যবহার ও পাকিস্তানের পক্ষে অনুষ্ঠান প্রচারের চাপের মুখে ঢাকা টেলিভিশন কেন্দ্রের সর্বস্তরের বাঙালি শিল্পী-কলাকুশলী কাজ বর্জন করে কর্মস্থল ত্যাগ করেন। ফলে এদিন সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য ঢাকা টিভির সম্প্রচারও বন্ধ হয়ে যায়।
পূর্বপাকিস্তান রাইফেলসের সদর দফতর যশোরে বাঙালি অফিসাররা সর্বপ্রথম স্বাধীন বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত পতাকা উত্তোলন করেন। রাইফেলসের জওয়ানরা ‘জয় বাংলা-বাংলার জয়’- গান গাইতে গাইতে ফ্ল্যাগস্ট্যান্ডে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন এবং তারা স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকার প্রতি পূর্ণ সামরিক কায়দায় গার্ড অব অনার জানিয়ে ফ্ল্যাগ স্যালুট করেন। ভোলা ও বগুড়ায়ও রাইফেলসের জওয়ানরা নিজ নিজ ছাউনিতে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন।
এদিন পূর্বপাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়ন, সংবাদপত্র হকার্স ইউনিয়ন, ইপিআইডিসি, খাদ্য পরিদর্শক সমিতিসহ বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে আন্দোলন চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য একাত্মতা ব্যক্ত করে বলেন, চূড়ান্ত বিজয় না হওয়া পর্যন্ত আমরা আর কেউই নিজ নিজ অফিসে ফিরে যাব না। দেশকে শত্রুমুক্ত করেই কেবল স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে কর্মস্থলে যোগদান করব।
দেশের বিভিন্ন স্থানে রাইফেলস ব্যাটালিয়নে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের খবর দ্রুত পৌঁছে যায় সামরিক জান্তা জেনারেল ইয়াহিয়ার কাছে। নরঘাতক ইয়াহিয়া প্রতিশোধ আগুনে জ্বলে-পুড়ে ছারখার হয়ে গোপনে দেশের প্রতিটি সামরিক ছাউনিতে নির্দেশ পাঠায় যে, আর সময় দেয়া যাবে না। সুযোগ বুঝে বাঙালি নিধন কর্মসূচি ‘অপারেশন সার্চলাইট’ বাস্তবায়ন শুরু করতে হবে। ক্রুদ্ধ ইয়াহিয়া-টিক্কারা গোপন বৈঠক করে প্রতিটি ক্যান্টনমেন্টেও অপারেশন শুরু করার নির্দেশ জারি করে।
গোপনে তারা যোগাযোগ রক্ষা করতে থাকে স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের নেতা গোলাম আযম, মতিউর রহমান নিজামী, খান এ সবুর খান, মাওলানা ইউসুফ, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, কামারুজ্জামানদের সঙ্গে। এরই মধ্যে স্বাধীনতাবিরোধী এ চক্রটি রাজাকার-আলবদর বাহিনী গঠনের প্রস্তুতি গ্রহণের পাশাপাশি দেশজুড়ে প্রচারণা চালাতে থাকে যে, ভারতীয় হিন্দুবাদীরা ষড়যন্ত্র করে মুসলমানদের ঐক্য বিনষ্ট করতেই পূর্বপাকিস্তানের বিরুদ্ধে দুশমনি শুরু করেছে। আর আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিব ওই ষড়যন্ত্রের হোতা হিসেবে দেশবিরোধী কার্যকলাপে লিপ্ত হয়েছে।

ফেসবুকে লাইক দিন

আমাদের সাইটের কোন বিষয়বস্তু অনুমতি ছাড়া কপি করা দণ্ডনীয় অপরাধ।