অবশেষ দুই ডাকাত ধরে পুলিশে দিল জনতা

মনপুরায় পুলিশ-জনতা যৌথ অভিযান ॥ বেরিয়ে আসছে থলের বিড়াল

ফলো-আপ

নজরুল ইসলাম মামুন, মনপুরা ॥ ভোলার মনপুরায় বিচ্ছিন্ন চরে পুলিশ-জনতার যৌথ অভিযানে চরে অবরুদ্ধ ৬ ডাকাত ধরতে গিয়ে পুলিশ বিপুল অর্থের বিনিময় পালিয়ে যাওয়ার সহযোগিতার অভিযোগে পর এবার ডাকাত সহ সর্দার ইউপি সদস্য ফারুক মেম্বারকে বাঁচাতে মরিয়া পুলিশসহ প্রভাবশালী মহল। এদিকে ঘটনার পরপর ডাকাতসহ সর্দার ইউপি সদস্যকে আসামী করে মামলা দিতে থানায় গেলেও মামলা নেয়নি ওসি এমন অভিযোগ ডাকাতে ৩ গরু লুট করে নিয়ে যাওয়া গরুর মালিক নবীরের। তিনি আরও অভিযোগ করেন রোববার রাত ১ টা পর্যন্ত ওসি থানায় বসিয়ে রাখলোও মামলা নেয়নি।
অবশেষে সোমবার বিকেল সাড়ে ৫ টায় পুলিশের সহযোগিতায় পালিয়ে যাওয়া ৬ ডাকাতের মধ্যে দুই ডাকাত ধরে পুলিশে দিল জনতা। সোমবার সন্ধ্যা ৭ টায় গড়িয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত ডাকাত সহ সর্দার ইউপি সদস্যের বিরুদ্ধে থানায় মামলা হয়নি জানিয়েছেন ওসি মোঃ জহিরুল ইসলাম। তবে মামলা প্রক্রিয়াধীন বলে জানিয়েছেন তিনি। পুলিশকে ধরিয়ে দেওয়া দুই ডাকাত হলেন, মোঃ বাবুল ও রাকিব। এদের দুইজনের বাড়ি উপজেলার হাজীরহাট ইউনিয়নের চরফৈজুদ্দিন গ্রামে।
এদিকে বিচ্ছিন্ন চরে পুলিশ-জনতা অভিযানে অবরুদ্ধ ৬ ডাকাতকে বিপুল অর্থের বিনিময় পুলিশ পালিয়ে যেতে সুযোগ করে দেওয়া ও পরে ডাকাতসহ সর্দার ইউপি সদস্য ফারুক মেম্বারকে বাঁচাতে পুলিশসহ প্রভাবশালীমহল মরিয়া এমন তথ্য ও ভিডিও ফুটেজ এই প্রতিবাদকের কাছে সংরক্ষিত আছে।
ঘটনার তথ্য ও ভিডিও ফুটেজ পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ডাকাতির ঘটনা ঘটে শনিবার রাত সোয়া ১টায়। সংঘবদ্ধ ডাকাতরা উপজেলার হাজীরহাট ইউনিয়নের সোনার চরে গরু লুট করে ট্রলারে নিয়ে যায়। পরে রাত দেড়টায় তপন চন্দ্র দাস মুঠোফোনে হাজীরহাট ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নিজাম উদ্দিন হাওলাদারকে মুঠোফোনে ডাকাতির ঘটনাটি জানায়। তখন চেয়ারম্যান ঢাকার মিরপুর-১০ অবস্থান করছিল। পরে চেয়ারম্যান ডাকাতির ঘটনাটি মুঠোফোনে ওসিকে অবহিত করে পুলিশের সহযোগিতা চায়। ওসি চেয়ারম্যানের কাছে ট্রলারসহ লোকজনের সহযোগিতা চায়। পরে চেয়ারম্যান মুঠোফোনে স্থানীয় ইউপি সদস্যসহ অন্যান্যের সহযোগিতায় ট্রলার, স্পীডবোটে লোকজন উঠিয়ে ওসিকে জানায়। পরে ওসি দুইজন এস.আই ও দুই কনস্টেবলকে কোন অস্ত্র ছাড়া লাঠি নিয়ে ডাকাত ধরতে মেঘনায় পাঠায়। পরে পুলিশ-জনতার ধাওয়া খেয়ে ডাকাত সদস্যরা ট্রলার সুজন মেম্বারের চরে রেখে ওই চরের ভিতরে অবস্থান নেয়। তখন ট্রলারে থাকা লোকজন ও চার পুলিশ সদস্য পুরো চরটি ঘেরাও করে। এরই মধ্যে চেয়ারম্যানকে চর ঘেরাও করা লোকজনের মধ্যে প্রফুল্ল চন্দ্র দাস মুঠোফোনে জানিয়েছেন পুলিশের সাথে কোন অস্ত্র নেই, তারা দুইটি লাঠি নিয়ে এসেছে। তখনই চেয়ারম্যান ওসিকে ফোন দিয়ে অস্ত্রে সজ্জ্বিত আরও পুলিশের ফোর্স চরে পাঠাতে অনুরোধ করে এবং তিনি ঢাকা থেকে প্রাইভেট কার ভাড়া করে নোয়াখালী, পরে স্পীডবোট যোগে সকালে ওই চরে যাবে। এছাড়াও ডাকাত না ধরে তিনি (চেয়ারম্যান) না আসা পর্যন্ত অবস্থান করতে অনুরোধ করেন।
পরে চেয়ারম্যান ১নং ওয়ার্ডের ফারুক মেম্বার (যিনি ডাকাত সর্দার হিসাবে অভিযুক্ত) লোকজনসহ ট্রলারের ব্যবস্থা করতে মুঠোফোনে বারবার কল করলেও ফোন ধরেনি। কিন্তু অভিযুক্ত ডাকাত সর্দার ফারুক মেম্বার ওসিকে ফোন দিয়ে জানান তিনি ট্রলার ভর্তি লোকজনসহ নাইবের হাট মেঘনার পাড়ে অবস্থান করছে। ওসি ফারুক মেম্বারকে মুঠোফোনে জানান অস্ত্রে সজ্জ্বিত এস.আই লুৎফুর ও এসআই সুবাসকে পাঠাচ্ছেন। তিনি যেন পুলিশ ব্যতিত চরে ট্রলার না পাঠায়। কিন্তু অভিযুক্ত ফারুক মেম্বার পুলিশ আসার অগেই ট্রলার চরে পাঠিয়ে দেন। কিন্তু তিনি চরে যাননি। পুলিশের দুই এস.আই ট্রলারে ছেড়ে চলে যাওয়ার চরে যেতে পারেনি। এরপরই চরে ঘেরাও অবস্থানরত ৬ ডাকাতকে পালিয়ে যেতে শুরু হয় ফারুক মেম্বারের তদবির। তিনি পুলিশের দুই এস.আই লুৎফুর ও সুবাসের মারফতে ওসিকে ম্যানেজ করতে বিপুল অংকের অর্থের প্রলোভন দেন। একপর্যায়ে রাতেই ওই দুই এসআই ফারুক মেম্বারের প্রস্তাব নিয়ে থানায় আসে। এভাবে দুই এস.আই শনিবার রাতে নদীরঘাটে তিনবার মিলিত হয়ে রফাদফা করে। পরে রোববার সকালে চরে চরে অবস্থারত চার পুলিশ ডাকাত ধরতে না গিয়ে উল্টো চর ঘেরাও করা লোকজনকে জোর করে মূল ভূখন্ডে নিয়ে আসে।
রোববার সকাল ৭ টায় চেয়ারম্যান কার করে নোয়াখালী হয়ে স্পীডবোট করে মনপুরা আসার পথে ডাকাত না ধরে চর থেকে লোকজন পুলিশ চলে এসেছে জানতে পেরে মুঠোফোনে ওসি, ওই দুই এস.আই সাথে বাহাস (তর্ক-বিতর্ক) শুরু করে। পরে চেয়ারম্যান মনপুরার নাইবের হাট এস দেখে ডাকাতদের ফেলে যাওয়া ট্রলার নদীরপাড়ে রয়েছে ও উদ্ধার হওয়া ৩ গরু নদীরপাড়ে বাঁধা অবস্থায় রেখে পুলিশ থানায় চলে যায়।
এরপরই চেয়ারম্যান নাইবের হাট বাজারে বসে দুই থেকে তিনশত লোকজনকে কেন চর ঘেরাও করা ডাকাত না ধরে চলে আসার কারণ জানান, তারা সবাই জানান পুলিশ জোর করেই তাদের নিয়ে এসেছে। এর মধ্যে চর ঘেরাও করা অবস্থায় প্রফূল্ল চন্দ্র দাসকে মুঠোফোনে ফারুক মেম্বার জানান তোরা চরে না থেকে চলে আসতে হুমকী দেন। তখন চেয়ারম্যান উপস্থিত লোকজনের সামনে ফারুক মেম্বারকে বারবার ফোন দিলেও তিন ফোন রিসিভ করেনি এবং ফের কল করেনি। তবে এত লোকজনের মধ্যে ফারুক মেম্বার প্রফুল্ল চন্দ্র দাসের মুঠোফোনে ফোন দেন দুইবার। তখন চেয়ারম্যান বলেন আমার ফোন মেম্বার ধরেনা, কিন্তু প্রফুল্লকে ফোন দেয়, যাতে চরে থেকে লোকজন নিয়ে আসার সাথে ফারুক মেম্বার হুমকী দেয় ঘটনাটি চেয়ারম্যানকে না বলে।
এরপর চেয়ারম্যান ঘটনা বিভিন্ন পর্যায়ে অবহিত করতে শুরু করে এবং নদীর পাড়ে ডাকাতদের বোট ও উদ্ধার হওয়া ৩টি গরু নদীর পাড়ে রেখে পুলিশ চলে যাওয়া ঘটনাটি অবহিত করে। পরে রোববার দুপুর সাড়ে ৩টায় ওসি সহ অন্যান্য সদস্যরা ডাকাতদের বোট সিজ করে ও উদ্ধার হওয়া তিনটি গরু থানায় নিয়ে যায়। উপরোক্ত তথ্য হাজীরহাট ইউপি চেয়ারম্যান নিজামউদ্দিন হাওলাদার ও ওসি জহিরুল ইসলাম সত্য বলে স্বীকার করলেও ওসি ডাকাত পালানো ও ফারুক মেম্বারের সাথে বিপুল অংকের লেনদেনের বিষয়টি মিথ্যা বলে জানান।
এরপরই রোববার বিকেল থেকে মামলা নিয়ে ও ডাকাত সর্দার অভিযুক্ত ফারুক মেম্বারকে বাচাঁতে আওয়ামীলীগের এক প্রভাবশালী নেতার প্রত্যক্ষ মদদে চলে নতুন মিশন। সন্ধ্যার পর মামলা করতে থানায় গেলেও বাদীর মামলা নিবে কিন্তু আসামীরা থাকতে হবে অজ্ঞাত। কোনভাবে ফারুক মেম্বারকে আসামী করা যাবে না। ফারুক মেম্বারকে আসামী করলে মামলা নেওয়া যাবে না বলে জানান ওসি।
এ ব্যাপারে হাজীরহাট ইউপি চেয়ারম্যান নিজাম উদ্দিন হাওলাদার জানান, মনপুরার উপজেলার বিভিন্ন স্থান থেকে গরিবের একের পর এক গরু ডাকাতরা নিয়ে যায়। বিষয়টি জনপ্রতিনিধিসহ প্রশাসন ও স্থানীয়দের মধ্যে হতাশা বিরাজ করছে। আর সেখানে গরুসহ ডাকাত চরে ঘেরাও করার পর পুলিশের সহযোগিতায় পালিয়ে যায়। এরপরও ডাকাত সর্দার প্রমাণিত ফারুক মেম্বারকে আসামী করলে মামলা ওসি নিবে না। এতে কি প্রমাণ হয় আপনারা বলেন।
এ ব্যাপারে মনপুরা থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোঃ জহিরুল ইসলাম জানান, পুলিশের সহযোগিতা থেকে ডাকতরা চর থেকে পালিয়ে যাওয়ার বিষয়টি মিথ্যা। তখন এই প্রতিবেদক চরে পুলিশ ডাকাত ধরতে কেন অস্ত্রের পরিবর্তে লাঠি নিয়ে গেল এমন প্রশ্নে ওসি বিষয়টি এড়িয়ে যান। এছাড়াও মামলা নিতে কোন চাপ, ফারুক মেম্বারকে আসামী করে মামলা না নেওয়া সহ ও দুইদিন দেরী হওয়ার বিষয়টি তদন্তের নামে ব্যাখ্যা দেন। তবে তিনি ঘটনার জড়িত দুই ডাকাত সোমবার বিকেলে আটক করা হয়েছে বলে জানান তিনি।

ফেসবুকে লাইক দিন

আমাদের সাইটের কোন বিষয়বস্তু অনুমতি ছাড়া কপি করা দণ্ডনীয় অপরাধ।