সর্বশেষঃ

ভারতে চলছে ঘৃণা, জাতিবিদ্বেষ, অন্ধবিশ্বাস, ক্ষুধা ও দারিদ্রের মহামারি

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ইন্ডিয়া বোর্ডের চেয়ারম্যান আকার প্যাটেল বলেছেন, “ভারত সরকার বেছে বেছে এবং ভয়ঙ্করভাবে মুসলমানদের বিরুদ্ধে দমন-পীড়ন করছে যারা তাদের মুখোমুখি বৈষম্যের বিরুদ্ধে কথা বলার এবং শান্তিপূর্ণভাবে তাদের ভিন্নমত প্রকাশ করার সাহস করে।
সোশ্যাল মিডিয়ায় অসংখ্য ভিডিও ভাইরাল হয়েছে যাতে ভারতের বিভিন্ন শহরে মুসলিম বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে ব্যাপক পুলিশি বর্বরতা দেখানো হয়েছে এবং পুলিশ হেফাজতে গুরুতর মারধর এবং শুক্রবার থেকে গ্রেপ্তার হওয়া শতাধিক পরিবারের বাড়ি ভেঙে ফেলার হুমকি দেওয়া হয়েছে। ভারতে চলছে ঘৃণা, জাতিবিদ্বেষ, অন্ধবিশ্বাস, ক্ষুধা ও দারিদ্রের মহামারি। করোনা ভাইরাস ভারতের বিদ্যমান সকল ধরনের বৈষম্যকে বিশ্বের দরবারে সম্পূর্ণ নগ্ন করে ছেড়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারতে চরম অর্থনৈতিক সংকটকে আড়াল করতেই ধর্মীয় পরিচয়ের রাজনীতিকে সামনে নিয়ে আসা হয়েছে। তবে এ কথা ভুলে গেলে চলবে না যে, বিজেপির মতাদর্শিক উগ্র হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ বা আরএসএস, যার সদস্য সংখ্যা ২০১৬ সালে ৬০ লক্ষ ছাড়িয়েছে। আরএসএসের অভীষ্ট ও কৌশল অনেক পুরনো।
প্রখ্যাত ভারতীয় লেখক অরুন্ধতী রায় বলেন, ‘ভারতীয় মুসলমানদের সাথে মোদী সরকারের আচরণ ও করোনা মহামারিকে ব্যবহারের কৌশল লক্ষ্য করেন, দেখবেন তা অবিকল ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানীতে ইহুদীদের প্রতি ব্যবহৃত ভাষা ও মতাদর্শের অনুরূপ। ঠিক যেভাবে ইহুদীদের ঘেটোর ভেতর আটকে ফেলা হয়েছিল, তাদের জীবনাচরণকে কলঙ্কিত করা হয়েছিল, টাইফাসের মহামারিকে ব্যবহার করে তাদের অপবাদ, অপমান ও অপদস্ত করা হয়েছিল, ঠিক একই কৌশল ভারতে মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করা হচ্ছে।
অরুন্ধতী ভারতের এই ফ্যাসিবাদী আদর্শের দিকে দ্রুত এগিয়ে যাওয়াকে বিশ্বসমাজের নজরদারীতে রাখবার আহ্বান জানান এবং একে গণহত্যা দিকে মোড় নিতে যাচ্ছে বলে বিশ্বসমাজকে হুঁশিয়ার করে দেন (রায়, ২০২০)। তিনি আরও বলেন, এ কেবল করোনার মহামারি নয়, এ ঘৃণা, জাতিবিদ্বেষ, অন্ধবিশ্বাস, ক্ষুধা ও দারিদ্রের মহামারিও। করোনা ভাইরাস ভারতের বিদ্যমান সকল ধরনের বৈষম্যকে বিশ্বের দরবারে সম্পূর্ণ নগ্ন করে ছেড়েছে। মহামারি ছড়িয়ে পড়বার ঠিক আগে নাগরিক আইন সংশোধনীর বিরুদ্ধে গত বছরের ডিসেম্বর থেকে গড়ে ওঠা প্রতিবাদে সামিল দিল্লীর মুসলমাদের উপর সহিংসতায় রাষ্ট্রীয় ইন্ধন এবং সহযোগিতার প্রচুর সাক্ষ্য পাওয়া গেছে। মিডিয়া এই হামলাকে ‘দাঙ্গা’ বলে প্রচার করতে সচেষ্ট ছিল।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞানী ও শিক্ষক সায়েমা খাতুন এক প্রবন্ধে লিখেছেন, ভারতের এনআরসির প্রতিক্রিয়া সামাল দিতে ৯ ডিসেম্বর ২০১৯ এ ভারতীয় লোকসভায় সিএএ পাস করা হয় যাতে স্পষ্ট করে পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও বাংলাদেশে থেকে আগত হিন্দু, খৃষ্টান, বৌদ্ধ, জৈন, শিখ ও পার্সী- এই ৬ টি ধর্মসম্প্রদায়ের সংখ্যালঘুদের ভারতীয় নাগরিকত্ব দেয়ার কথা বলা হয়েছে, কেবল মুসলমানদের বাদ দেয়া হয়েছে। এমন আইন করা হয়েছে যে, বাংলাদেশী নাগরিক ভারত ভ্রমণ করবার সময় ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে হিন্দু হলে প্রতিদিন তাকে যে জরিমানা গুণতে হবে, মুসলমান হলে তা হবে বহুগুণ বেশী। মুসলমান-বিদ্বেষী এই আইনী পরিকাঠামোর সংস্কার ভারতীয় সংবিধানের ১৪ নম্বর ধারার পরিপন্থী, যেখানে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে যে, ‘‘Indian constitution prohibits the state from denying to any person equality before the law or the equal protection of the laws within the territory of India.’’

এনআরসির ফলে আসামের ১৯ লক্ষ হিন্দু-মুসলমান বাঙালীর রাষ্ট্রহীন হয়ে পড়বার সম্ভাবনা, নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে না পারা মানুষের জন্যে ডিটেনশন ক্যাম্প তৈরি করা, প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশের জন্যে অশুভ বার্তা বহন করে। এক আসামেই এখন ১০ টা ডিটেনশন ক্যাম্প প্রস্তুত আছে, নাগরিকত্ব অস্বীকৃত মানুষদের জন্য তৈরি হচ্ছে আরও জেলখানা। আসামে বিদেশী বললে ‘বাংলাদেশ থেকে আগত অবৈধ অভিবাসী’ বোঝানো হচ্ছে। এতে যে বাংলাদেশকে জড়ানো হয়েছে তা স্পষ্ট এবং তাতে করে বাংলাদেশ যে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের এই আইনের এক অংশীজন হয়ে পড়েছে তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। এনআরসি এবং সিএএর মাধ্যমে ভারত রাষ্ট্র হিসেবে ধর্ম পরিচয় নির্বিশেষে সকল নাগরিকের সমান অধিকারের সাংবিধানিক মূলনীতি এবং ভারতের প্রতিষ্ঠাকারীদের সেকুলার আদর্শের মৌলিক বদল ঘটিয়ে উচ্চবর্ণ হিন্দু ও ধনীদের কর্পোরেট স্বার্থের সংরক্ষণকারী রাষ্ট্রে রূপান্তরের প্রাতিষ্ঠানিক প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে।
এনআরসি এবং সিএএর মাধ্যমে ভারত রাষ্ট্র হিসেবে ধর্ম পরিচয় নির্বিশেষে সকল নাগরিকের সমান অধিকারের সাংবিধানিক মূলনীতি এবং ভারতের প্রতিষ্ঠাকারীদের সেকুলার আদর্শের মৌলিক বদল ঘটিয়ে উচ্চবর্ণ হিন্দু ও ধনীদের কর্পোরেট স্বার্থের সংরক্ষণকারী রাষ্ট্রে রূপান্তরের প্রাতিষ্ঠানিক প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে। প্রতিবেশী রাষ্ট্রের এই ফ্যাসিবাদী রূপান্তর বাংলাদেশের এবং গোটা দক্ষিণ এশিয়ার জন্যে এক অশনি সংকেত।
ইসলামী শরীয়তভিত্তিক রাষ্ট্রের ধারণাকে ঠিক একই কারণে এই ধর্ম নিরপেক্ষতা ও বিশ্বজনীন মানবাধিকারের দৃষ্টিকোণ থেকে প্রত্যাখ্যান করা হয়। ভারত জুড়ে নজীরবিহীন প্রতিবাদ- প্রতিরোধের মূল জায়গাটা এখানেই যে, রাষ্ট্রের মৌল চেতনার মধ্যে ধর্মীয় পরিচয় রাষ্ট্রের জন্য কোন সুবিধা দেয়া বা না দেয়ার নির্ধারক হতে পারে না।

ফেসবুকে লাইক দিন

আমাদের সাইটের কোন বিষয়বস্তু অনুমতি ছাড়া কপি করা দণ্ডনীয় অপরাধ।