হারাদিন ধরি লাইনে আছি, উহাস, কিছু খাইতে পারিনা, বাইর হইলে যদি সিরিয়াল মিস করি

দালালদের বেপরোয়ায় অরক্ষিত পাসপোর্ট অফিস!

ভবনের সামনে মটর সাইকেল ও ব্যাটারী চালিত ইজি বাইকের সারি। একাধিক কম্পিউটার ও চায়ের দোকান। প্রচুর মানুষের সমাগম। হঠাৎ করে কেউ দেখলে মনে করবে এখানে পণ্য বিক্রির হাট বসেছে। আবার কেউ বলছে এটা দালাল মোর্চার হাট, এখানে পাসপোর্টের ফরম ফিলাপ করার জন্য দালালদের শরণাপন্ন হন। অল্প খরচে দ্রুত কাজ। বিষয়টি ওপেন সিক্রেট হলেও দেখার কেউ নেই।
অফিস সূত্র বলছে, দালালদের কারণেই নাকি অরিক্ষত ভোলা আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস। অসংখ্য মানুষ তাদের ক্ষোভ আর হাহাকারের কথা বলছেন প্রতিনিয়ত। দালালদের দৌরাত্ম্য, স্থানীয় বখাটেদের আধিপত্য, অফিস কম্পাউন্ডের আশপাশে ব্যাঙ্গের ছাতার মত গড়ে উঠা দোকান ঘর যেন দালালদের আতুরালয়। অন্যদিকে ভোলা শহরের বিভিন্ন মার্কেট, হোটেল, ফ্লাট বাড়িতে নিজেদেরে পাসপোর্ট অফিসের এজেন্ট বলে প্রচারনা করে সর্বশান্ত করছে এক শ্রেনীর প্রতারকরা।
ভোলা আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস একটি সরকারি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। যে প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমের সাথে সংশ্লিষ্ট সরকারের রেমিটেন্স, স্বাস্থ্য সেবা ও শিক্ষা ব্যাবস্থা জড়িত। এখানে অনলাইনে ফরম পূরণের কথা বলে পাসপোর্ট অফিসের দালাল চক্র নিজেদের পাসপোর্ট অফিসের এজেন্ট বলে সেবা প্রত্যাশীদের আকৃষ্ট করে হাতিয়ে নিচ্ছেন হাজার হাজার টাকা। নির্ভুল ফরম পুরনের শর্ত থাকলেও এই চক্রটি ইচ্ছা করে পাসপোর্ট ফরমে ভুল তথ্য দিয়ে সেবা প্রত্যাশীদের হয়রানী করছেন মাসের পর মাস। নিদারুণ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সেবা প্রত্যাশীরা। সময়মত পাসপোর্ট হাতে না পাওয়ার কারণে অনেকেই উন্নত চিকিৎসার অভাবে মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়ছেন। রেমিটেন্স যোদ্ধারা সময়মত কাজে যোগদান না করার কারণে বেকার হচ্ছেন প্রতিনিয়ত। উচ্চ শিক্ষার মোহ থকে বেরিয়ে আসছেন অনেক মেধাবী সন্তান। ভুক্তভোগীরা বলছেন সকল দায় জেলা আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের। তাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদেই দালাল মোর্চা তৈরী হয়েছে।
ভোলা চরফ্যাশনের মোঃ ইব্রাহীম বলছেন, দালাল ছাড়া এখানে কোন কাজ করা যায়না। অফিসের সাথে সরাসরি কাজ করতে গেলে পাসপোর্ট কবে হাতে পাবো তার সময় কর্মকর্তারা দেয় না। দালালদের টাকা বেশী দিলে কাজ দ্রুত হয়। কম দিলে হয়রানির শিকার হতে হয়।
তজুমুদ্দিন উপজেলা থেকে আসা ছালাউদ্দিন বলছেন, পাগলা কুত্তায় কামরাইলে পাসপোর্ট অফিসে আইবা। আনোয়ার বলছেন, এত কষ্ট জানলে কোনদিন আইতামনা ভোলা পাসপোর্ট অফিসে। হারাদিন ধরি লাইনে আছি, উহাস, কিছু খাইতে পারিনা, বাইর হইলে যদি সিরিয়াল মিস করি লাই, তাই ডরে লাইন ছারতাম পারিতাছিনা।
লালমোহনের জসিম উদ্দিন বলছেন, মুখে একগ্লাস পানি দিতে পারিনাই, এর মধ্যে সময় শেষ। তারা ৫ টার পরে আর কোন কাজ করবেনা। মেজাজটা খুব খারাপ, তার জন্য নিজের কপালে নিজেই জুতার বারি দিতে মন চায়, কেন পাসপোর্ট’র জন্য এই অফিসটায় আসলাম।
চরফ্যাশনের আব্দুল মান্নান বলছেন, দ্রুত পাসপোর্ট হাতে পাওয়ার জন্য দালালকে নির্ধারিত ফিসের চেয়ে ৬ হাজার টাকা বেশি দিলাম। বলছিল ৭ দিনের মধ্যে ভিসা হাতে দিবে, কিন্তু হইলোনা। দালাল বলছে অফিসে যান আপনার পাসপোর্ট হইছে, কিন্তু এই পর্যন্ত ৯ বার চরফ্যাশন থেকে ভোলা পাসপোর্ট অফিসে আসতেছি আর চরফ্যাশন যাইতেছি কোন খবর নাই। শুধু বলছে সময় হলে চলে আসবে। আব্দুল মান্নানের মত অনেক মানুষের চাঁপা কান্না লুকিয়ে আছে ভোলা আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে।
ফিঙ্গার প্রিন্টের জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা ভোলা সদরের আরিফ হোসেন বলেন, ‘সকাল ৮টা থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে আছি, কিন্তু সামনে এগোচ্ছেই না। খুব মন্থরগতিতে কাজ চলছে। এভাবে চলতে থাকলে সারাদিনেও এই লাইন শেষ হবে না।
দোতলায় পরিচালকের কার্যালয়ের সামনে গিয়েও দেখা যায় দীর্ঘ লাইন। এই লাইনে দাড়ানো সবাই নানা অভিযোগ অভিযোগ করছেন। তাদের একজন দেলোয়ার হোসেন। মাস দেড়েক আগে পাসপোর্টের আবেদন জমা দিয়েছিলেন। নির্ধারিত তারিখ পেরিয়ে গেলেও তার পাসপোর্ট আসেনি। পাসপোর্ট বিতরণ কাউন্টারের লোকজনকে খুঁজে পাওয়া যায়না। আবার খুঁজে পেলেও কোনো সদুত্তর দেয় না। মনে হয় যেন আমরা এই দেশে রোহিঙ্গা।
ভোলা আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের পরিচালক জাহাঙ্গীর আলমের সাথে কথা হলে তিনি ক্ষোভের সাথে বলেন, এই চক্রটি অফিসের আনাছে কানাছে ব্যাঙ্গের ছাঁতার মত ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। মাননীয় জেলা প্রশাসকের আইনশৃঙ্খলা সভায় ও আমি ব্যক্তিগত ভাবে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করার জন্য আবেদন করি। ওনারা কয়েকবার এসেছেন, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। যদি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ভোলা জেলা আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসটির সংরক্ষিত সীমানা নির্ধারণ করে আইনী নোটিশ জারি পাসপোর্ট অফিসের সামনের চক্রগুলোকে উৎখাত করতে পারতেন, তাহলে পাসপোর্ট অফিসে আসা সেবা প্রত্যাশীরা কখনোই পাসপোর্ট জটিলতায় ভুগতোনো। আজ থাকলো ধারাবাহিক প্রতিবেদনের ১ম পর্ব। পরবর্তী প্রতিবেদন সম্পর্কে জানতে চোখ রাখুন আমাদের সাথেই।

ফেসবুকে লাইক দিন

আমাদের সাইটের কোন বিষয়বস্তু অনুমতি ছাড়া কপি করা দণ্ডনীয় অপরাধ।