সর্বশেষঃ

ভোলা কলেজের সোনালী দিন : পর্ব-০৩

(গত পর্বের পর) : আমাদের সময়ে সর্ব প্রথম স্টাডিজ ট্যুরের আয়োজন করা হয়। প্রাথমিক ভাবে বাণিজ্য বিভাগের ছাত্রদের নিয়ে পরিকল্পনা থাকলেও বিজ্ঞানের ছাত্ররা প্রিন্সিপাল জাকির হোসেন স্যারকে বিশেষভাবে অনুরোধ করলে পরে তিনি আমাদের ঐদলে অন্তর্ভুক্ত করেন। এর প্রেক্ষিতে বাণিজ্য ও বিজ্ঞান বিভাগের ছাএরা বাণিজ্য বিভাগের মিজান স্যারের তত্বাবধানে এই ট্যুরে যোগদেই। এই ট্যুরে আমাদের সাথে ছিল মনোয়ার, শামসুল আলম, সুফিয়ার রহমান ফারুক, দিলিপ কুমার নাগ, শাহজাহান মানিক, আবদুল লতিফ, জাহাংগীর সহ মোট ২০ জন। যাত্রা প্রস্তুতি শেষে প্রথমে আমরা ভোলা থেকে ঢাকায় এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলে উঠি। ঐ দিনই রাত্রেই আমরা সিলেটের উদ্দেশ্যে ট্রেনে করে ঢাকা ত্যাগ করি। সিলেটে প্রথমে আমরা হজরত শাহজালালের মাজার জিয়ারত করি এরপর আমরা রওনা হই শ্রিমংগল টি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের উদ্দেশ্যে। শ্রীমংগলে আমাদের থাকার জন্য টি রিসার্চ ইনস্টিটিউট তাদের বাংলো ব্যাবহার করতে দেন এবং খাবারেরও ব্যাবস্হা করেন। টি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সন্মানিত ডাইরেক্টর জেনারেল আমাদের সাথে তাদের কনফারেন্স রুমে সাক্ষাৎ দান করেন এবং টি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের কার্যক্রম ব্যাখা করেন।

আমাদের মধ্যে ইতিপূর্বে কারোই চা বাগান ও তার সৌন্দর্য দেখার সৌভাগ্য হয়নি। আমরা সবাই নৌসর্গিক সৌন্দর্যে বিমোহিত হই। পরবর্তীতে আমাদের চা প্রক্রিয়াজাত পর্যবেক্ষণের জন্য ফিনলের একটি চা কারখানায় নিয়ে যাওয়া হয়। তিনকূরি কাচা পাতা থেকে কি ভাবে পর্যায়ক্রমে ফিনিস্ড চা উৎপাদন হয়, পুরো প্রক্রিয়াটা আমাদের দেখানো হয়। মিজান স্যারের দক্ষ ব্যাবস্থাপনায় ও নেতৃত্বে আমাদের এই ট্যুর প্রানবন্ত হয়ে উঠে, কোথায়ও আমরা কোন অসুবিধার সন্মুখিন হইনি। ঐদিন বিকালে আমরা ফেঞ্চুগঞ্জ সার কারখানা পরিদর্শনে যাই। কারখানা ব্যাবস্থাপক আমাদের সাদরে গ্রহন করেন এবং সাথে থেকে কারখানার প্রথম থেকে ফিনিস্ড প্রডাক্ট পর্যন্ত সমগ্র প্রক্রিয়া দেখিয়ে ও বুঝিয়ে দেন। এরপর আমরা আসি মৌলবিবাজার, সেখানে একটা আনারস বাগান পরিদর্শন করি। পরদিন সিলেট থেকে আমরা চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা হই এবং চট্টগ্রামে কমার্স কলেজে আমাদের থাকার ব্যাবস্থা হয়।
চট্টগ্রামে আমরা বায়েজিদ বোস্তামির দরগাহ পরিদর্শনে যাই, সে বিশাল আকারের কাছিম প্রত্যক্ষ করি। ঐ দিন বিকালে আমরা চট্টগ্রাম স্টিলমিল পরিদর্শনে যাই। স্টিলমিলের তৎকালীন এমডি একজন অবসর প্রাপ্ত পশ্চিম পাকিস্তানী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, তিনি সহ অন্যান ব্যাবস্হাপকরা আমাদের সাদরে গ্রহন করেন। কনফারেন্স রুমে ডায়াগ্রামের মাধ্যমে কারখানার সকল কর্মকান্ড আমাদের মাঝে তুলে ধরেন। আমাদেরকে স্টিলমিলে বিকেলের চা নাস্তা সার্ভ করা হয়। ওখান থেকে আমরা পতেঙ্গা সি বীচে যাই ও বিকেলের সূর্যাস্ত উপভোগ করি। পরদিন বিকালে আমাদের কক্সবাজার যাওয়ার প্রগাম। ঐদিন সকাল ১০ টায় আমরা বদ্দারহাটে ইস্পাহানি জুট মিল পরিদর্শনে যাই এবং পাট থেকে বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ব্যাগ ও অন্যান পন্য তৈরী হয় তা প্রতক্ষ করি। বিকেল ৪টায় চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজারের উদ্দেশে পিআইয়ের প্লেনে করে রওনা করি।
১৯৬৮ সাল, আমরা ছাএরা এর আগে কখনো প্লেনে উঠার সৌভাগ্য বা অভিজ্ঞতা ছিলনা। ভাড়া ওয়ান ওয়ে ১৮. ০০ টাকা এবং রিটার্ন টিকেট হলে ৩৫.০০ টাকা। যাক, প্লেনে উঠে সিট বেল্ট কিভাবে বাধতে হয় এয়ার হোস্টেস আমাদের দেখিয়ে দিল। ৫৫ মিনিটের জার্নি, এর মধ্যে চকলেট নিয়ে এলো এয়ার হোস্টেস, আমরা মুঠো ভরে পকেটে ঢুকালাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই ল্যান্ডিংয়ের বাতি জ্বলে উঠলো, কক্সবাজার এসে গেছি, আবার সিটব্যাল্ট বাধার পালা। আমাদের জন্য মিজান স্যার আগেই দুইটি কটেজ বুকিং করে রেখে ছিল, আমরা ছাএরা সেখানে উঠলাম। জীবনে প্রথম কক্সবাজার, যার যার ব্যাগ রেখেই ছুটলাম সীবিচের দিকে। সে সময়ে বীচ অনেক নিরিবিলি ছিলো, ছিলো নিরাপদ, এখনকার মতো এতো জনসমাগম ছিলোনা। বীচে সকালে দেখা যেতো হরেক রকমের রং গিন ঝিনুক, স্টার ফিস। দুই দিন এতো আনন্দে ছিলাম, কখন যে দুই দিন কেটে গেলো বুঝতেও পারলাম না।
কৈশরের শেষ যৌবনের প্রারম্ভে সব কিছুতেই আনন্দ, অত্যান্ত সাধারণ বিষয়ে হেঁসে গড়িয়ে পরা, সময়টাই ওরকম। দ্বিতীয় দিন রামুতে বৌদ্ধ বিহার দেখতে গেলাম। তৃতীয় দিন বিকেলে প্লেনে করে আমরা চট্টগ্রাম এসে পৌছলাম। ঐদিনই আমরা সন্ধ্যায় জাহাজে করে চট্টগ্রাম থেকে রওনা হয়ে ভোর রাতে ভোলার চকিঘাটা এসে পৌছলাম। সমস্ত ট্যুরটি চমৎকার, পরিকল্পনা মাফিক ও আনন্দঘন হওয়ার পেছনে মিজান স্যারের কৃতিত্ব আমরা সবসময়ই মনে রেখেছি। আমাদের দেখাদেখি মানবিক শাখাও ঐ সময়ে আবু তাহের স্যারের তত্বাবধানে একটা স্টাডি ট্যুর সম্পন্ন করে। জাকির স্যারের মতো একজন মেধা সম্পন্ন প্রিন্সিপাল যদি কোন কলেজে থাকে, যে নেতৃত্ব দেয়ায় অগ্রগামী, ছাত্রদের ও শিক্ষকদের প্রতি সহযোগীতায় ও সহমর্মিতায় উদ্বুদ্ধ, তার কলেজ অনেক উন্নতিতে পৌছবে এটাই স্বাভাবিক। তারই পদাংক অনুসরণ করে ঐ সময়ে ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষকদের মধ্যে এক স্নেহের এক নিবিড় সম্পর্ক সৃস্টি হয়ে ছিলো।

 (চলবে———)

 

 

মাহফুজুর  রহমান বাচ্চু

সাবেক শিক্ষার্থী

 ভোলা সরকারী কলেজ, ভোলা।

 

ফেসবুকে লাইক দিন

আমাদের সাইটের কোন বিষয়বস্তু অনুমতি ছাড়া কপি করা দণ্ডনীয় অপরাধ।