শোষণ আর নির্যাতনের কবলে তজুমদ্দিনের চর মোজাম্মেলের ৩০ হাজার মানুষ !

স্থায়ী পুলিশ ক্যাম্পের দাবি।
নিরব নৈরাজ্য কায়েম করছে জবরদখলদাররা।
মানুষগুলোর মনের চাঁপা কষ্টগুলো বলাও যেন মহাপাপ।
এখানে আইনের কোন শাসন নেই।
চেয়ারম্যান কর্তৃক নির্দিষ্ট ব্লোক লিডাররাই চরের আইন আদালত।
ধর্ষণ বলেন ক্যান বায়াজি (বাবাজি) এইটাকে মহাব্বত বলেন।


চর মোজাম্মেল হইলো চেয়ারম্যানেগো কৈলজা। কুড়ি বছর হইল চর জাইগলো, ঝুড় জঙ্গলে ভরা আছিল, দুইডা ভাত পেডে দেওনের লাই সব ছাপ কইরা আবাদ করি, গরু, ছাগল, মুরকা পাইলা সুখে শান্তিতেই আছিলাম হঠাৎ কইরা খোদার ঠাডা পড়ছে এই চরে। বাহিনীগো কু-দৃষ্টির কারনে ঘরে ধান, চাউল, গরু, ছাগল রাখতে পারিনা। অগো ডরে ১০-১২ বছর হইলেই লেদা (নাবালিকা) মাইয়াগোরে তরে (তজুমুদ্দিনে) পাডাই দেই। জায়গা জমি নাই, হের লাইগ্গা চরে পইরা রইছি। বিচার দেওনের কোন যাগা নাই, যদি একটা পুলিশ ক্যাম্প থাকতো তাইলে শেখ মুজিবের মাইয়ার লাই দোয়া করতাম। এমন আক্ষেপ নিয়েই কথাগুলো বলছেন ভোলা তজুমুদ্দিন উপজেলার চাঁদপুর ইউনিয়নের ৬ নং ওয়ার্ড চর মোজাম্মেলের (পরিচয় গোপনের শর্তে) ৭০ উর্ধ্বো এক বৃদ্ধ।
চর মোজাম্মেল, শোষণ, শাসন, নিপীড়ণ আর নির্যাতনের ভরা ভোলার একটি দুর্গম চর। ভোলা তজুমুদ্দিন উপজেলার চাঁদপুর ইউনিয়নের একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। খাদ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান এবং নিরাপত্তার মৌলিক অধিকারগুলো এখানে রুপকথার গল্পের মত। ১৯৫০ সালে ভারতীয় উপমাহাদেশ থেকে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর জমিদারী প্রথা বিলুপ্ত হলেও একবিংশ শতাব্দিতে এসেও ভোলার তজুমুদ্দিনের চর মোজাম্মেলে ১৭৯০ সালে আদলে গড়ে উঠা ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পনীর প্রেতাত্মারা চরের ৩০ হাজার মানুষের উপর ভর করেছে। ধর্ষণ, লুটপাট, জবরদখলদাররা একধরনের নিরব নৈরাজ্য কায়েম করছে এখানে। স্বাধীনতার ৫০ বছরে এসেও পরাধীনতার এক নিরব শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হতে পারেনি এখানের মানুষগুলো।
অনুসন্ধানে গিয়ে জানা যায়, ভোলা তজুমুদ্দিন উপজেলার চাঁদপুর ইউনিয়ন থেকে ছিটকে পড়া মেঘনার কোল ঘেষে জেগে উঠা প্রায় সারে ৭ হাজার বর্গমাইলের একটি চর। ২০ বছরে পূর্ব এই চরে জীবন ও জীবিকার তাগিদে নোয়াখালী ও ভোলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের কৃষকরা বসতী স্থাপন করেন। দেশের অর্থনীতির বিশাল সম্ভনাময় একটি বিস্তৃর্ণ এলাকা। সোনালী ফসল, পুকুরের মাছ গবাদী পুশুতে যেন থৈ-থৈ করে। তার পরেও চরের মানুষের মনে সুখ নেই। চারদিকে যেন খেটে খাওয়া মানুষের মাঝে নিরব সুনশান অবস্থা বিরাজ করছে। অপরিচিত কোন পর্যটক বা গনমাধ্যম কর্মীদের দেখলেই যেন একটু মুক্তির স্বপন দেখেন। কেউ কাছে আসেনা, চারদিকে তথাকথিত ব্লোক লিডারদের শকুনের দৃষ্টি। এই মানুষগুলোর মনের চাঁপা কষ্টগুলো বলাও যেন মহাপাপ। জোরপূর্বক বসত ঘরের ঢুকে বাবা মায়ের সামনে মেয়েদের ধর্ষন আবার মেয়েদের সামনে মা’কে ধর্ষণ। অপহরনকরা, গোয়ালের গরু, ছাগল পুকুরের মাছ চোখের সামনেই নিমেষেই শেষ হয়ে যাওয়া। ১০ থেকে ১২ বছরের শিশুদের বিয়ে দিয়ে মা’বাবা যেন হাফ ছেড়ে বাঁচে। তাই এই চরের মানুষ অত্যাচারীদের ভাষা জানলেও এখানে প্রতিবাদের ভাষা কেউ জানেনা বা জানতে চায়না।
অভিযোগে জানা যায়, প্রতি ব্লোকে বছরে দেড় লাখ টাকা করে চাঁদা দিতে হবে ব্লোক লিডারদের। গরু-ছাগল-পুকুরের মাছ আবাদি জমি ও বসতঘর বিক্রি করলে প্রতি লাখে হাজার ৩০, প্রতিবাটে চাষাবাদে ২ হাজার ৫’শত টাকা, জমি চাষে টিলার প্রতি ১২ হাজার টাকা, প্রতিমন ধানে ৪ কেজী, ধান মড়ানি ৩ কেজি হারে চাঁদা দিতে হবে। এছাড়া এক বাটে মসজিদের নামে ৪ হাজার ৫’শত করে চাঁদা দিতে হবে। ধর্ষণ, জমি-জমার বিরোধ, মনমালিন্যর সালিশ প্রতি ১০ হাজার টাকা অগ্রীম জমা দিতে হবে। এখানে আইনের কোন শাসন নেই। চেয়ারম্যান কর্তৃক নির্দিষ্ট ব্লোক লিডাররাই চরের আইন আদালত। তাদের মুখের বাণীই আইন হিসেবে মানা হয়। এই ধরনের ৩৬ জন ব্লোক লিডার আছেন চরে। তার মধ্যে অজিউল্লাহ ফরাজী (৬৫), হান্নান ফরাজী (৪০), ইদ্রীস সারেং (৫৫) নিরব লিডার (৫০), ছালাউদ্দিন লিডার (৫০), আব্বাস লিডার (৫৫), দুধর্ষ আব্বাস হাং (৬০), রুহুল আমিন লিডার (৫০), হেলাল লিডার (৬০), ইমান হোসন টুনু (৫৫), আলাউদ্দিন খলিফা (৬০), আনোয়ার নেতা (৪৫), শরীফ নেতা (৪৫) অন্যতম। এরা বছরের চর মোজাম্মেল থেকে প্রায় ১০ কোটি টাকার চাঁদা তোলার বন্দোবস্ত নেন চাঁদপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান থেকে। তাছাড়া চেয়ারম্যান ও তার ব্লোক লিডাররা সরকারি গুচ্ছগ্রামের প্রায় ৩৮টি পুকুর থেকে গুচ্ছগ্রামের উপকার ভোগীদের উৎখাত করে নিজেরাই ভোগ করছেন্।
কথাগুলো অকপটে শিকার করেন, দর্জি কান্দি ও হানু হাওলাদার ব্লোকের সিরাজ (৪০) ও গিয়াস উদ্দিন (৩৫)। তারা বলেন, কৃষকের ফসল, জমির চাঁদা, ধর্ষণের বিচার, গুচ্ছগ্রামের পুকুরের মাছ চেয়ারম্যান ও তার নির্ধারিত ব্লোক লিডারদের মাঝে বন্টন করা হয়। এখানে কেউ টু শব্দও করতে পারেনা। করলেই চর থেকে উৎখাত।
এখানে ধর্ষণকে মহাব্বত বলা হয়। ৫ ও ৭ বছরের শিশু ধর্ষণকারি ইসলামের (৭০) সাথে কথা হলে তিনি বলেন, ধর্ষণ বলেন ক্যান বায়াজি (বাবাজি) এইটাকে মহাব্বত বলেন। ধর্ষণের সালিশ করেন ব্লোক লিডাররা। ধর্ষকের কাছ থেকে ২০ থেকে ৫০ হাজার টাকা আদায় করে নিজেরা ভাগ বাটোয়ারা করে খান, ধর্ষিতা ও তার পরিবারের জন্য কোন পূর্ণবাসনের ব্যবস্থা করা হয় না। ব্লোক লিডাররা নিজেরা ধর্ষণ ও লুটপাট করলে কোন বিচার হওয়ার সুযোগ থাকেনা।
প্রকৃতিক দুর্যোগে সরকারি ত্রাণ, ভিজিডি, ভিজিএফ, বয়স্কভাতা, বিধবা ভাতা, মাতৃকালিন ভাতা, দুগ্ধকালিন ভাতা এই চরের মানুষের কাছে পৌছায় না। নাম প্রকাশ না করার শর্তে খেটে খাওয়া মানুষের সাথে এই প্রতিবেদক আলাপ করলে তারা বলেন, দুইডা ঢাইল ভাত খাইয়া বাঁইচা থাওনের লাই এই চরে আছি। এক যুগ ধইরা ব্লোক লিডারেগো অত্যাচার সইতাছি। অনেক কষ্টকরে এই চরডারে পরিস্কার করছি। যাওনের যায়গা থাকলে অনেক আগেই চইলা যাইতাম। চরে একটা পুলিশ ক্যাম্প হইলে মনে অয় খানিকটা নিস্তার পাইতাম।
এই বিষয়গুলো নিয়ে কথা হয় ব্লোক লিডার অজিউল্লাহ ফরাজী, ইমান হোসেন টুনু, ইদ্রিস সারেং এর সাথে। তারা বলেন, চরের বিষয়ে চেয়ারম্যান যে সিদ্ধান্ত নেন, আমরা সেটাকে বাস্তবায়ন করি, যেটা পারিনা সেটা চেয়ারম্যান নিজেই করেন।
কথা হয় চাঁদপুর ইউপি চেয়রম্যান সহিদুল্যাহ কিরনের সাথে। তিনি তার বিরুদ্ধে সকল অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, যত পারেন নিউজ করেন; আমি চর মোজাম্মেলে কোন অন্যায় করিনা। তাছাড়া আমার ভাল মন্দের বিচার করবেন আমার এমপি, অন্য কেউ নয়।

ফেসবুকে লাইক দিন

আমাদের সাইটের কোন বিষয়বস্তু অনুমতি ছাড়া কপি করা দণ্ডনীয় অপরাধ।