উৎসব সার্বজনীন, তবে এমপিও শিক্ষকদের সঙ্গে বৈষম্য কেন ?

উৎসব সার্বজনীন। এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের ঈদ উপলক্ষে বোনাস মূল বেতনের ২৫ শতাংশ প্রদান করা হয়। এতে ১৬ হাজার টাকা স্কেলের একজন শিক্ষকের বোনাস ৪ হাজার টাকা। এই যৎসামান্য অর্থে একটি পরিবারের ঈদ উৎসব কতটা দুরূহ ব্যাপার তা সহজেই অনুমেয়। এছাড়া ৫দশ টাকা চিকিৎসা ভাতা, বাড়ি ভাড়া ১ হাজার টাকা দেয়া হয়। মাসিক বেতন ভাতার পরিবর্তে দেওয়া হয় অনুদান সহায়তা। সরকারি বেসরকারি বৈষম্য বিলোপ সাধনে, এমপিও ভুক্ত শিক্ষকদের দাবি শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণ। এ দাবি শিক্ষক শিক্ষার্থী, অভিভাবক সহ সকলের। সকল দলমতের মতের শিক্ষক সংগঠনগুলোর ও মূল দাবি শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণ।
শিক্ষাকে বেসরকারিকরণ করে বাণিজ্যিকীকরণ করা হয়েছে। বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে সরকারি নিয়ন্ত্রণ না থাকায় প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের ইচ্ছামত শিক্ষার্থীদের নিকট থেকে বেতন ও চাঁদা আদায় করে থাকে। তাতে করে প্রান্তিক অসচ্ছল জনগোষ্ঠীর অভিভাবকরা শিক্ষার্থীদের শিক্ষার ব্যয়ভার নির্বাহ করতে পারেন না, ফলে শিক্ষা বঞ্চিত হচ্ছে ও ঝরে পড়ছে লক্ষ শিক্ষার্থী। প্রতিষ্ঠানের আর্থিক ব্যবস্থাপনায় ও বিভিন্ন অসংগতি রয়েছে। শিক্ষা পণ্য নয়, শিক্ষা সেবা এবং প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক অধিকারও বটে। সময়ের দাবি মানোন্নত শিক্ষা ও ঝরেপড়া রোধে এখনই শিক্ষার সার্বিক দায়িত্ব রাষ্ট্রকেই নিতে হবে।
দীর্ঘদিনের পুরাতন শিক্ষক সংগঠনগুলো শিক্ষকদের বঞ্চনা বৈষম্য দূরীকরণে দর্শকের ভূমিকায় অবতীর্ণ। সংগঠনগুলো শিক্ষকদের ন্যায়সংগত যৌক্তিক অধিকারের দাবি দাওয়া আদায়ের বিষয়ে যেমনি উদাসীন তেমনি নিরুৎসাহিত। শিক্ষক নেতারা এখন নিজ নিজ সংগঠনের ও পদ পদবি নিয়েই ব্যস্ত। তারা শিক্ষকদের স্বার্থের বিষয়ে আগের মতো গুরুত্ব দেন না। সরকারের আমলারা যেসব তথ্য দিয়ে সরকারের নীতিনির্ধারকদের বিভ্রান্ত করেন, তার বিপরীতে সঠিক তথ্য-উপাত্ত শিক্ষক নেতারাও দিতে পারেন না। তাই শিক্ষকদের ন্যায্য দাবিও নীতিনির্ধারকরা স্বপ্রণোদিত হয়ে মেনে নেয় না। শিক্ষক সংগঠনগুলোর ৯০% নেতারা অবসরপ্রাপ্ত ও অশিক্ষক। শিক্ষকদের দাবিদাওয়ায় নেতৃবৃন্দের স্বার্থ সংশ্লিষ্টতা না থাকায় স্বভাবতই নিস্ক্রিয় থাকেন। এ সব কারণেই শিক্ষকদের আন্দোলন এখন শিক্ষকদের স্বার্থের চেয়ে নেতাদের পদ-পদবি ও সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তি এবং দলীয় মনোনয়ন নিশ্চিতের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
দেশের মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাব্যবস্থার ৯৭ শতাংশ পরিচালিত হয়ে থাকে এমপিও ব্যবস্থাপনায়। মাত্র তিন শতাংশ শিক্ষা পরিচালনা করে সরকারি নিয়ন্ত্রণে। সরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা সরকারি নিয়মানুসারে সকল সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকেন। অপরদিকে বেসরকারি শিক্ষকদেরকে সরকারি অন্যান্য ভাতা বিহীন মূল বেতন পেয়ে থাকেন। দেশে এমপিও শিক্ষক সংখ্যা হচ্ছে প্রায় পাঁচ লক্ষাধিক। এই বিপুল পরিমাণ শিক্ষক কর্মচারীরা নাম মাত্র বেতন-ভাতা পেয়ে থাকেন, যা দিয়ে পরিবারের ভরণপোষণ করা খুবই কষ্টকর। অথচ এমপিওভুক্ত শিক্ষকরাই দেশের মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাব্যবস্থাকে টিকিয়ে রেখেছেন। এমপিওভুক্ত শিক্ষক কর্মচারীদের রাষ্ট্রীয়ভাবে বৈষম্য সৃষ্টি করে নীতিনির্ধারকরা ঠকানো হচ্ছে এর সমূহ সমাধান করা জরুরি।
শিক্ষার মান বিচারে সব ক’টি সূচকের বিবেচনায় বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই শীর্ষে। পাবলিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ, শিক্ষার্থীদের সংখ্যা, জিপিএ-এর মান, পাসের হার সব দিকেই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা এগিয়ে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের ছাপিয়ে সরকারি স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা কখনোই শীর্ষে যেতে পারেনি। অথচ সরকার ও নীতিনির্ধারকেরা সব সময়ই মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করার কথা বলে যাচ্ছেন। কিন্তু সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের মধ্যে আকাশ-পাতাল বেতন-ভাতার বৈষম্য রেখে মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। সরকারকেই এসব বৈষম্যের অবসান ঘটিয়ে সুনির্দিষ্ট নীতিমালার আলোকে জাতীয়করণের উদ্যোগ নিতে হবে। শিক্ষাব্যবস্থায় বৈষম্য বিভাজন সৃষ্টি করে কখনোই মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না। আর সময় নষ্ট না করে এমপিও শিক্ষাব্যবস্থাকে জাতীয়করণ করে শিক্ষার দায়িত্ব ও নিয়ন্ত্রণ রাষ্ট্রকেই নিতে হবে।
শিক্ষায় এখন যে নৈরাজ্য চলছে, তা দিয়ে মানসম্পন্ন শিক্ষা তো দূরের কথা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনাই দুরূহ হয়ে পড়ছে। শিক্ষায় বৈষম্য সৃষ্টি এবং শিক্ষকদের সঙ্গে বিমাতাসূলভ আচরণ করছে শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা। শিক্ষকদের বঞ্চিত করে মানসম্পন্ন শিক্ষা আশা করাটা দূরাশা মাত্র। নির্দিষ্ট নীতিমালা বিহীন বিচ্ছিন্নভাবে সরকারিকরণের ফলে বৈষম্য আরো প্রকট হচ্ছে। অগ্রাধিকার পাবে এমন যোগ্য প্রতিষ্ঠানকে বাদ দিয়ে, রাজনৈতিক বিবেচনায় ও অনৈতিক লেনদেনের মাধ্যমে জাতীয়করণ করার ফলে, সরকারি সিদ্ধান্তে শিক্ষক অভিভাবক সহ সংশ্লিষ্ট এলকার জনগণও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন।
এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা, পূর্ণাঙ্গ বাড়ি ভাড়া ও চিকিৎসা ভাতার দাবি দীর্ঘ দিনের। পবিত্র ঈদ উৎসব সবার। সরকারি-বেসরকারি সকল দায়দায়িত্ব, বিধিবিধান, কর্ম ঘন্টা, পাঠ্যপুস্তক, পাঠ্যক্রম, পাঠ্যসূচী ও পরীক্ষা পদ্ধতি একই। অথচ এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা বঞ্চিত করে বৈষম্য সৃষ্টি করা হয়েছ। শিক্ষকদের পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতাসহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধা বঞ্চিত করে নীতিনির্ধারকরা এমপিওভুক্ত শিক্ষক কর্মচারীদের সাথে চরম বিমাতাসুলভ আচরণ করছে। ২০০৯ থেকে ২০২০ বর্তমান সরকারের ১২ বছর সময়ে এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বৈষম্য নিরসনের কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি, বরং নতুন নতুন বৈষম্য সৃষ্টি করা হয়েছে।
বাংলাদেশ বেসরকারি শিক্ষক কর্মচারি ফোরামের পক্ষ থেকে এমপিওভুক্ত শিক্ষক কর্মচারীদের সকল বৈষম্য দূরীকরণে দ্রুত উদ্যোগ ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের জোর দাবি জানাচ্ছি। শিক্ষক ফোরাম মনে করে, শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্য সৃষ্টির কারণেই শিক্ষাব্যবস্থার যতো বিশৃঙ্খলার উদ্ভব হয়েছে। বিদ্যমান শিক্ষাব্যবস্থার মানোন্নয়ন ও শৃঙ্খলা ফেরাতে, একমাত্র এমপিও শিক্ষা জাতীয়করণের মাধ্যমেই সম্ভব।

মোঃ সাইদুল হাসান সেলিম
সভাপতি
বাংলাদেশ বেসরকারি শিক্ষক কর্মচারী ফোরাম।

ফেসবুকে লাইক দিন

আমাদের সাইটের কোন বিষয়বস্তু অনুমতি ছাড়া কপি করা দণ্ডনীয় অপরাধ।