টেকসই নগর ও সবুজায়ন: বাংলাদেশের সম্ভাবনা বিকাশে নীতি সহায়তা

কৃষিবিদ মোঃ শহিদুল্লাহ্, অতিরিক্ত উপপরিচালক, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খামারবাড়ি, ঢাকা। ফাইল ছবি।

বিশ্বের অন্যান্য দেশের মত পাল্লা দিয়ে বাংলাদেশে নগরায়ন বাড়ছে, মানুষ প্রয়োজনের তাগিদে শহরমুখী হচ্ছে; জাতিসংঘের তথ্য মতে ২০৫০ সাল নাগাদ প্রতি ১০ জনে ৭ জন লোক শহরে বসবাস করবে যেখানে বর্তমানে মোট বৈশ্বিক জনসংখ্যার অর্ধেক নগরে বাস করে। বর্তমানে দেশের মোট জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশ শহরে বসবাস করে এবং শহরে জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে; জীবন-ধারণের প্রয়োজনে নগরমুখী হওয়া দোষের কিছু নয়; সুস্থ সাভাবিক জীবন-ধারণের অন্যতম উপাদান বিশুদ্ধ বাতাস, খোলা প্রান্তর, খেলার মাঠ, সবুজের সমারোহ, শিশুদের বিনোদনের জন্য পার্ক, পরিচ্ছন্ন পরিবেশ কি বাংলাদেশে বর্ধিত নগরায়নে নিশ্চিত হচ্ছে? উন্নত দেশের শহরগুলিতে দেখা যায় বিস্তীর্ন খোলা প্রান্তর, পার্ক, খেলার মাঠ, গাছ-পালায় আচ্ছাদিত পাখ-পাখালির সমারোহে সবুজে মোড়ানো আধুনিকতা ও প্রকৃতির মিশেল। বাংলাদেশের বাস্তবতায় আমরা হয়তো উন্নত দেশের মত আমাদের নগর শহরগুলিতে জমিতে গাছ লাগিয়ে সবুজায়ন করতে পারবো না; কারন শহরের সুস্থ পরিবেশের জন্য সুপারিশকৃত শতকরা ২৫ ভাগ ভূমি গাছ-গাছালিতে আচ্ছাদিত করার মত খালি জায়গা নাই; দুঃখজনক হলে ও সত্যি পুরান ঢাকায় সবুজ এর পরিমান মাত্র ৫% ও নতুন ঢাকায় তা মাত্র ১২%। বর্ধিষ্ণু এই নগরের টেকসই নগরায়ন তাহলে কিভাবে নিশ্চিত করা যাবে? বাংলাদেশে ভূমি স্বল্পতা ও জনসংখ্যার আধিক্যের কারনে সমতলক্ষেত্রিক সবুজায়ন সম্ভব নয় সেহেতু ভার্টিক্যালি সবুজায়নের বিকল্প নাই; শুধুমাত্র ঢাকা শহরেই চার লক্ষাধিক বিল্ডিং রয়েছে যেখানে প্রায় দশ হাজার হেক্টর খালি ছাদ আছে।

জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষমাত্রায় ১১ নং লক্ষ্যে ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই নগর নিশ্চিত করার টার্গেট করা হয়েছে। নগরের টেকসই উন্নয়নের অন্যতম শর্ত হলো সবুজ পরিবেশ যেখানে বিশুদ্ধ বাতাস ও জৈব বৈচিত্র্য ভরপুর থাকবে এবং স্থানীয় খাদ্য চাহিদা স্থানীয় উৎপাদনের মাধ্যমে মেটানো যায়। কংক্রিটের সমতল ছাদগুলো হতে পারে ঢাকাসহ ও অন্যান্য শহরেরর বিশুদ্ধ বাতাস ও নিরাপদ সতেজ শাক-সবজি ও ফলমূলের আধার; ছাদগুলো পরিকল্পিত সবুজায়নের মাধ্যমে নগরীতে সবুজায়নের বিদ্যমান ঘাটতি মেটানো সম্ভব এবং ছাদে স্থাপিত বাগানসমূহ শহরের খাদ্য ঘাটতি অনেকাংশে পূরণ করবে। ঢাকা শহরে ছাদবাগান শখ থেকে এখন নিত্য প্রয়োজনীয় ব্যাপারে পরিনত হয়েছে। নগরবাসী যদিও কিছু মাত্রায় ছাদবাগান করছে, কিন্তু বিদ্যমান সম্ভাবনার তুলনায় তা খুবই অপ্রতুল। খানা আয়-ব্যয় জরিপ ২০১৬ অনুসারে বাংলাদেশের শতকরা ২৫.৭৩ ভাগ বিল্ডিং এর ছাদ সমতল ও কংক্রিট ( আরসিসি) ঢালাইকৃত, ছাদবাগান করার জন্য এধরণের স্থাপনা খুবই সহায়ক।

ছাদবাগানের সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন শুধুমাত্র বিল্ডিং ও ফ্ল্যাটের মালিকের উপর নির্ভর করে না, সরকারের গৃহীত নীতি ও বিধি-বিধান ছাদবাগান সম্প্রসারণে অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। উদাহরনস্বরুপ, টরেন্টো সিটি কাউন্সিল ২০০৯ সালে “গ্রিন রুফ” নামে একটি পরিপূর্ন উপ-আইন প্রণয়ন করে যেখানে গ্রিন রুফ নির্মান স্ট্যান্ডার্ড, প্রযুক্তিগত পরামর্শ টিম, অপরাধ ও জরিমানাসহ পরিপূর্ণ গাইডলাইন দেয়া আছে। এই আইন অনুযায়ী নতুন আবাসিক, বানিজ্যিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক বিল্ডিংসমূহের ছাদে অবশ্যই একটি অংশ বৃক্ষরাজি দিয়ে সবুজায়ন করতে হবে। জাপানে ও এরকম বাধ্যবাধকতা রয়েছে; মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র “লিডারশীপ ইন এর্নাজি এন্ড এনভায়রনমেন্টাল ডিজাইন” নামক বানিজ্যিক বিল্ডিং এর জন্য রেটিং সিস্টেম চালু করেছে যেখানে বিল্ডিং স্থাপনের কারণে পরিবেশ ও সবুজের বিনষ্টতার ক্ষতিপূরণ হিসেবে বিল্ডিং এর ছাদে সবুজায়ন ও রেইন ওয়াটার হার্ভেস্ট সিস্টেম রাখার বিধান রয়েছে। সাংহাই, চায়নাতে হাই-টেক নগর কৃষির মাধ্যমে সিটিতে উৎপাদিত সবজির মাধ্যমে স্থানীয় চাহিদা মেটানো হচ্ছে। সিঙ্গাপুর সুউচ্চ ভবনগুলিতে স্কাই ফার্মিং মাধ্যমে প্রয়োজনীয় শাক-সবজির চাহিদা মেটানোর উদ্যেগ নিয়েছে; এমনকি, নগর কৃষি ও সবুজায়ন নিশ্চিত করতে সেদেশ “আরবান রি-ডেভেলপমেন্ট অথরিটি” নামে সরকারি প্রতিষ্ঠান চালু করেছে।

বাংলাদেশে ছাদবাগান স্থাপনে প্রণোদনার ঘাটতি রয়েছে; দেশের প্রচলিত বিল্ডিং কোড বা অন্য কোন বিধি-বিধান দ্বারা বিল্ডিং এর ছাদে গাছ-পালা দিয়ে সবুজায়নের ব্যাপারে বিল্ডিং মালিকদের প্রতি কোন বাধ্যবাধকতা রাখা হয় নাই। আবার, বিল্ডিং এর একাধিক মালিকানা ফ্ল্যাট মালিকদের ছাদবাগান স্থাপনে ঐক্যমতে পৌছতে দেয় না, সেজন্য অনেক ছাদে কোন ফ্ল্যাট মালিক চাইলেও বাগান করতে পারে না, ছাদ খালি পড়ে থাকে। ফ্ল্যাট মালিকদের বিরোধের কারণে কখনো কখনো প্রতিষ্ঠিত ছাদবাগান দুঃখজনক ভাবে কেটে ফেলতে দেখা যায়। ভবন মালিকগন অনেক সময় ভাড়াটিয়াদের ছাদে প্রবেশাধিকার বা বাগান করার সুযোগ দেয় না; সেজন্য কোন ভাড়াটিয়ার ইচ্ছা থাকলেও ছাদবাগান করতে পারে না; ঢাকা শহরে ছাদবাগান স্থাপনে বাধাসমূহের মধ্যে অন্যতম হলো মানসম্মত বীজ ও চারার প্রাপ্যতা, মাটি, কম্পোস্ট ও গোবর, বাগানে ব্যবহৃত যন্ত্রসামগ্রীর অভাব, প্রশিক্ষণের অভাব এবং প্রযুক্তিগত তথ্য এবং পরামর্শের ঘাটতি। নগরীতে বিদ্যমান মেট্রোপলিটন কৃষি অফিসসমূহের অপর্যাপ্ত জনবল এবং লজিস্টিক সহায়তার ঘাটতি নগরবাসীদের ছাদবাগান সর্ম্পকিত পরামর্শমূলক সেবা প্রদানে একটি প্রধান প্রতিবন্ধক।

সম্প্রতি কৃষি অধিদপ্তর নগর কৃষির উপর ঢাকা শহরে একটি পাইলট প্রকল্প চালু করেছে যার মাধ্যমে স্বল্প পরিসরে কিছু প্রদর্শনী ছাদবাগান, রেইন ওয়াটার হার্ভেস্ট স্থাপনা নির্মান, ড্রিপ ইরিগেশন ব্যবস্থা চালুকরণ ও খামারজাত সার তৈরীর প্রদর্শনী বাস্তবায়ন ও কিছু প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করছে। দেশের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ছাদবাগানের উপর সম্প্রতি কিছু গবেষণা কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। ঢাকা সিটি কর্পোরেশন ছাদবাগানীদের হোল্ডিং ট্যাক্স কমানোর মৌখিক ঘোষনা দিয়েছে, কিন্তু এখনো বাস্তবায়ন করে নাই। জাতীয় কৃষি নীতি, ২০১৮ ছাদবাগানকে মূল কৃষিধারায় অর্ন্তভুক্ত করা ও বানিজ্যিকীকরণে সহায়তা প্রদানের কথা বলা হয়েছে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে ছাদবাগানের কাংখিত সম্ভাবনার সুফল পেতে হলে নগর কৃষিকে নগর পরিকল্পনায় অর্ন্তভুক্তকরণ, স্বতন্ত্র নগর কৃষি/ ছাদ কৃষি নীতিমালা প্রণয়ন, ছাদবাগান স্থাপনে/ ও সুরক্ষায় আইনী বাধ্যবাধকতা প্রর্বতন, ছাদবাগানে উৎপাদিত ফল,শাক-সবজি নগরীর সুপারশপ গুলোতে বাজারজাতকরণের ব্যবস্থাকরণ, সিটি কর্পোরেশনসমূহে নগরকৃষি বিভাগ চালুকরণ, প্রয়োজনে নগরীর ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান যেমন রাজউক, সিটি কর্পোরেশন, গনপূর্ত ও কৃষি অধিদপ্তরের সাথে কার্যকরী সমন্বয়ের জন্য “নগর সবুজায়ন কর্তৃপক্ষ” প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে।

লেখক: কৃষিবিদ মোঃ শহিদুল্লাহ্, অতিরিক্ত উপপরিচালক, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খামারবাড়ি, ঢাকা। shahidullah29_dae@yahoo.com

ফেসবুকে লাইক দিন

আমাদের সাইটের কোন বিষয়বস্তু অনুমতি ছাড়া কপি করা দণ্ডনীয় অপরাধ।