ধর্ষণ বেশি হচ্ছে ঢাকায়, ২য় নারায়ণগঞ্জ ও তৃতীয় যৌথভাবে ময়মনসিংহ ও কুমিল্লা

গত এক বছরের ব্যবধানে ধর্ষণ বেড়ে দ্বিগুণ

গেল বছর ১ হাজার ৪১৩ জন নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। ২০১৮ সালে এই সংখ্যা ছিল ৭৩২ জন। এক বছরের ব্যবধানে ২০১৯ সালে ধর্ষণের ঘটনা বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। ধর্ষণ বৃদ্ধির এই চিত্রকে ভয়াবহ বলে উল্লেখ করেছে মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এবং মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন।
এদিকে গত বুধবার রাজধানীর সেগুনাবাগিচায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে (ডিআরইউ) এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, গেল বছর সারা দেশে ৪ হাজার ৩৮১ শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছে এক হাজারের বেশি শিশু আর হত্যার শিকার হয়েছে ৪৪৮ শিশু। সে হিসেবে প্রতি মাসে গড়ে ৮৪ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। যদিও প্রকৃত অপরাধের সংখ্যা আরো বেশি। দেশের ১৫টি জাতীয় দৈনিক পর্যালোচনা করে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে বলে সংস্থাটি জানিয়েছে।
অন্যদিকে আসকের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৮ সালে সারা দেশে ৭৩২ জনকে একক ও গণধর্ষণ এবং ১০৩ জনকে ধর্ষণ করার চেষ্টা করা হয়েছে। ধর্ষণের পরবর্তী হত্যা করা হয়েছে ৬৩ জনকে। ধর্ষণের কারণে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন সাতজন। এসব ঘটনায় মামলা হয়েছে ৫০৯টি, যা ঘটনার তুলনায় খুবই কম। আর গত বছর ১৪১৩ জনকে ধর্ষণ ও ২২৪ জন ধর্ষণ চেষ্টার শিকার হয়েছেন। তবে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্যানুযায়ী গত বছরে ধর্ষণ ঘটনার সংখ্যা আরো বেশি। তাদের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত বছরের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ১ হাজার ৫৩৭ জন নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছেন।
পরিসংখ্যান পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, ধর্ষণ কিংবা ধর্ষণচেষ্টার তুলনায় মামলার সংখ্যা অনেকাংশে কম। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরাও বলছেন, ঘটনার তুলনায় মামলা কম হয় আর মামলা হলেও নিষ্পত্তি হয় অনেক কম। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যেই ধর্ষণের ঘটনাগুলো প্রকাশ পায় কিংবা রিপোর্ট হয়, সেসব ঘটনার ক্ষেত্রে মামলা হয়। ভুক্তভোগী মামলা না করলে বা ধর্ষণের শিকার হওয়ার বিষয়টি প্রকাশ না পেলে সেটি আড়ালেই থেকে যায়।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক সালমা আলী বলেন, ধর্ষণের তুলনায় মামলার সংখ্যা কম হওয়ার প্রধান কারণ হলো ‘প্রকাশ’। ভুক্তভোগী চুলজ্জার ভয়ে, সমাজে তার স্থান হবে না বা ভবিষ্যতে বিয়ে হবে না-এই ভয়ে বিষয়টি প্রকাশ করতে চায় না। আমাদের সমাজে ধর্ষকের লজ্জা নেই, ধর্ষিতা লজ্জা পায়। পরিবার ও আক্রান্তকে বুঝতে হবে, এতে তাদের কোনো দায় নেই। আক্রান্ত ব্যক্তি নয়, অভিযুক্ত ব্যক্তিকে প্রমাণ করতে হবে, তিনি এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত নন। এ জন্য আইনেরও পরিবর্তন প্রয়োজন।
এদিকে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের হিসাব অনুযায়ী, গত বছর ৯০২ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। ২০১৮ সালে যার সংখ্যা ছিল মাত্র ৩৫৬। সবচেয়ে বেশি ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে ১৩ থেকে ১৮ বছর বয়সি শিশুরা। তাদের সংখ্যা মোট শিশু ধর্ষণের শতকরা ৪৮ ভাগ। শিশু ধর্ষণের হারে দ্বিতীয় পর্যায়ে আছে ৭ থেকে ১২ বছরের শিশু, যারা শতকরা ৩৯ ভাগ। শিশুদের বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে, চকলেট বা খাবারের লোভ দেখিয়ে, ভয় দেখিয়ে, মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে ও ঘরে একা পেয়ে ধর্ষণ করা হয়েছে। সবচেয়ে বেশি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে ঢাকা জেলায়। এরপর আছে নারায়ণগঞ্জ ও তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে যৌথভাবে ময়মনসিংহ ও কুমিল্লা।
মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পেডোফিলিয়া নামের মানসিক রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের শিশুদের প্রতি যৌন আকর্ষণ থাকে। কিছু ক্ষেত্রে যৌন নিপীড়নের এটিও একটি কারণ। তবে এটাই একমাত্র কারণ নয় বলে মনে করেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মোহিত কামাল। তিনি বলেন, শিশু ধর্ষণের পেছনে মানুষের মূল্যবোধ-নৈতিকতার অবয়, পর্নোগ্রাফি, মাদকের প্রভাবও রয়েছে। পাশাপাশি, শিশুদের প্রতিরোধ ক্ষমতাও কম। আসকের হিসাব বলছে, ২০১৮ সালে ছয় বছরের নিচে বয়স এমন ৫১ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। আর ৭ থেকে ১২ বয়সি রয়েছে ১০৪ জন। গত বছর এ সংখ্যাও বেড়েছে দ্বিগুণ। গত বছর ছয় বছরের নিচে ১১৮ জন এবং ৭-১২ বয়সি ২১০ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এসব ঘটনায়ও মামলা হয়েছে কম। তবে হত্যা ও আত্মহত্যার ঘটনায় মামলার হার তুলনামূলক বেশি।
এর কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিবারে এ ধরনের ঘটনা লুকিয়ে রাখার প্রবণতা প্রকট। ধর্ষণের শিকার শিশুর শারীরিক অবস্থা গুরুতর না হলে বা হত্যা-আত্মহত্যার ঘটনা না ঘটলে সাধারণত আইনি সহায়তা নেওয়া হয় না। প্রভাবশালী ব্যক্তিরাই বেশির ভাগ সময় এ ধরনের অপরাধের সঙ্গে যুক্ত থাকে। তাদের ভয়ে পরিবার মামলা করতে সাহস পায় না। আবার মামলা করলেও আপস করে ফেলতে হয়। সাক্ষী সুরক্ষা আইন না থাকায় সাক্ষীও পাওয়া যায় না। এ বিষয়ে পুলিশ সদর দফতরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) মো. সোহেল রানা বলেন, পুলিশ ধর্ষণ মামলা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দেখে। ধর্ষণ মামলা দায়ের, তদন্ত ও চার্জশিট দেওয়ার ক্ষেত্রে শতভাগ সততা থাকে। ধর্ষণ মামলার চার্জশিট দেওয়ার সংখ্যাও অনেক বেশি।
বুধবার বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে সার্বিক নির্যাতন কমলেও শিশুদের ওপর যৌন নির্যাতন আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। ২০১৯ সালে ৪ হাজার ৩৮১ শিশু নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ২ হাজার ৮৮টি শিশুর অপমৃত্যু ও ১ হাজার ৩৮৩ শিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে। শিশু নির্যাতন ও সহিংসতা কমলেও যৌন নির্যাতনের হার ৭০ দশমিক ৩৪ শতাংশ বেড়েছে।
প্রতিবেদনে শিশু নির্যাতনকে ৬টি ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়েছে। এগুলো হলো-অপমৃত্যু, যৌন নির্যাতন, অপহরণ, নির্যাতন ও সহিংসতা, আঘাতে মৃত্যু ও বাল্যবিবাহ।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৫ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ৩ হাজার ১৩৬ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। গড়ে প্রতি মাসে ৫২টির বেশি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এসব ঘটনায় হওয়া মামলার মধ্যে গত ৫ বছরে মাত্র ১৬৪ মামলার রায় হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, নোয়াখালী, ময়মনসিংহ ও গাজীপুরে। এরই মধ্যে সবচেয়ে বেশি তথা ১১৬ জন শিশু ঢাকায় ধর্ষণের শিকার হয়। গত ৫ বছরের মধ্যে ২০১৯ সালে শিশু হত্যার ঘটনা ছিল সবচেয়ে বেশি। ২০১৯ সালে ৪৪৮ শিশুকে হত্যা করা হয়েছে। যেখানে ২০১৮ সালে এ সংখ্যা ছিল ৪১৮।
পরিসংখ্যানে আরো বলা হয়, ২০১৯ সালে মাত্র ২৪টি শিশু হত্যা মামলা এবং ২৭টি শিশু ধর্ষণ মামলার রায়ের সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। বিচারহীনতা ও বিচারের দীর্ঘসূত্রতার কারণে এমন সহিংসতা বাড়ছে বলে মন্তব্য করা হয়েছে।

ফেসবুকে লাইক দিন

আমাদের সাইটের কোন বিষয়বস্তু অনুমতি ছাড়া কপি করা দণ্ডনীয় অপরাধ।