অবক্ষয় রাজনৈতিক দলে

ক্যাসিনো-মাদকের ব্যবসা পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ এবং চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজির মাধ্যমে যারা শত শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন তাদের হঠাৎ উত্থানের গল্প এখন দেশজুড়ে আলোচনায়। এসব অপকর্মের সঙ্গে জড়িতদের জীবন বৃত্তান্ত পর্যালোচনা করলে অভিন্ন যে চিত্র ফুটে ওঠে, তা হচ্ছে এরা কেউই আদর্শিক রাজনীতির ধারক নয়। কমবেশি সব সরকারের আমলে ঘুরে-ফিরে এরাই কিংবা যাদের হাত ধরে এদের উত্থান তারা টাকার বিনিময়ে ক্ষমতাসীন দলের পদ-পদবি কিনে অপকর্ম অব্যাহত রাখেন। আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টিসহ (জাপা) উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক দলের সাংগঠনিক পদ-পদবি কেনা-বেচার বাণিজ্য এখন ওপেনসিক্রেট। পদ কিনে জার্সি বদলে রাতারাতি তারা বনে যান ক্ষমতাসীন দলের কথিত প্রভাবশালী নেতা। ঢাকা মহানগর ছাড়িয়ে এই পদ কেনা-বেচার বাণিজ্য জেলা-উপজেলা থেকে শুরু করে ওয়ার্ড-ইউনিট পর্যন্ত বিস্তৃত। রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও বিশিষ্টজনেরা বলছেন, এটা সামগ্রিক রাজনীতির বড় অবক্ষয়।
ক্যাসিনো, মাদক, টেন্ডারবাজি ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে চলমান অভিযানে আলোচিত ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী স¤্রাট, সহ-সভাপতি এনামুল হক আরমান, যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মোমিনুল হক সাঈদ ও সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া, যুবলীগের কেন্দ্রীয় সমবায় বিষয়ক সম্পাদক জি কে শামীম, কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় নেতা শফিকুল আলম ফিরোজ ওরফে কালা ফিরোজ এবং মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক লোকমান হোসেন ভূঁইয়া হালআমলে ‘আওয়ামী লীগ নেতা’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন। তবে এদের কারোরই রাজনীতির জন্মদল আওয়ামী লীগ নয়। আওয়ামী লীগের আগে এদের কেউ ফ্রিডম পার্টি, কেউবা যুক্ত ছিলেন বিএনপিতে। বর্তমানে আরেক আলোচিত জাতীয় সংসদের হুইপ সামশুল হক চৌধুরীও বিএনপির যুবদল থেকে এরশাদের জাপা হয়ে আওয়ামী লীগে ভিড়েছেন। তাদের প্রত্যেকের বিষয়েই খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজনীতিতে খোলস পাল্টে তারা হঠাৎ আওয়ামী লীগের নেতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। তাদের ঘনিষ্ঠজনদের দাবি, শুধু সাধারণ সদস্য পদ নয়, অর্থের বিনিময়ে তারা বাগিয়ে নিয়েছেন ক্ষমতাসীন দলের উল্লেখযোগ্য পদ। এই পদকে পুঁজি করেই একেকজন একেকটা রাজত্ব গড়েছেন। সেই রাজত্বে ক্যাসিনো, মাদক ও টেন্ডারবাজির রমরমা বাণিজ্য।
আওয়ামী লীগ : টানা প্রায় পৌনে ১১ বছর ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই সময়ে প্রায় ৫৫ হাজার বিরোধী ক্ষমতাদর্শী আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনগুলোতে ঢুকে পড়েছে। যাদের মধ্যে শুধু বিএনপি বা জাপা নয়, জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মী এবং একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী পরিবারের সদস্যও রয়েছে। অনুপ্রবেশকারীদের এই তালিকা জমা পড়েছে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার কাছে। আওয়ামী লীগের অঙ্গ-সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতীম সংগঠনগুলোর দায়িত্বশীল বহু সূত্র জানায়, অপকর্মের উদ্দেশে অনুপ্রবেশকারীদের অনেকেই টাকার বিনিময়ে বড় পদবি কিনেছেন। সেই পদবি আর টাকার প্রভাব খাটিয়ে নির্বিঘ্নে তারা ক্যাসিনো, মাদকের ব্যবসা, টেন্ডারবাজি ও চাঁদাবাজিসহ নানা অপকর্ম চালিয়েছেন বা এখনও চালাচ্ছেন।
বিষয়টি দলের জন্য অশনি সংকেত- সাংগঠনিক ও গোয়েন্দা রিপোর্টে এমন তথ্য উঠে আসায় সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে বিতর্কিত অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ শুরু হয়েছে। চলছে শুদ্ধি অভিযান। সূত্র জানায়, অনুপ্রবেশকারীদের তালিকা হাতে পাওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘অপরাধ যে করবে, অন্যায় যে করবে; সে কোন দল করে, কী করে তা আমি কখনো দেখবো না। আমার দৃষ্টিতে যে অপরাধী সে অপরাধীই। দলের লেবাস লাগিয়ে দুর্নীতিবাজ ও অপরাধীরা পার পাবে না।’
সূত্রের দাবি-যুবলীগ, ছাত্রলীগ, শ্রমিক লীগ, কৃষক লীগসহ আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনগুলোতে নির্দিষ্ট পদের জন্য নির্দিষ্ট টাকা নির্ধারণ করা আছে। আর এই সুযোগে অনুপ্রবেশকারী ৫৫ হাজার বিরোধী ক্ষমতাদর্শীর অনেকে টাকার বিনিময়ে দলের গুরুত্বপূর্ণ পদও পেয়েছেন। যুবলীগের সদস্য পদ পেতে ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা ব্যয় করতে হয়। অভিযোগ রয়েছে, কেন্দ্রীয় যুবলীগ প্রেসিডিয়ামের কোনো কোনো পদ বিক্রি হয়েছে ৫০ লাখ থেকে শুরু করে দেড় কোটি টাকায়। যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের কোনো কোনো পদ বিক্রি হয়েছে ৩০ থেকে ৫০ লাখ টাকায়। সম্পাদকীয় কোনো কোনো পদ বিক্রি হয়েছে ২০-৩০ লাখ টাকায়। কান পাতলে শোনা যায়, যুবলীগের মাঠ পর্যায়ের কমিটিতে টাকা ছাড়া স্থান মেলে না। সম্মেলনের মাধ্যমে নতুন নেতৃত্ব নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এ বাণিজ্য চলে এবং এখনো তা অব্যাহত রয়েছে। পূর্ণাঙ্গ জেলা কমিটি থেকে শুরু করে উপজেলা, মহানগর, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড শাখা কমিটির প্রতিটিতেই চলে পদ বাণিজ্যের খেলা।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বে একটি টিম সম্প্রতি কক্সবাজার ও সিলেট সফর করেন। এ দুই স্থানে সফরকালে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘দল ও সরকারের ভাবমূর্তি ঠিক রাখতে দলকে আগাছামুক্ত করতে শুদ্ধি অভিযান শুরু হয়েছে। যত বড় নেতাই হোক কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। টেন্ডারবাজ, দুর্নীতিবাজ, সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজরা সাবধান হয়ে যাও, শেখ হাসিনার অ্যাকশন শুরু হয়ে গেছে।’
বিএনপি ১৯৯১-৯৬ এবং ২০০১-২০০৬, বিএনপি সরকারের এই দুই মেয়াদেও ঢাকাসহ সারাদেশে ব্যাপক হারে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি এবং মাদক-জুয়ার কারবার হয়েছে। বিশেষ করে ২০০১-০৬ সাল মেয়াদে দুর্নীতি, টেন্ডারবাজি ও সন্ত্রাস-চাঁদাবাজির মাত্রা অতীতের সকল রেকর্ড ছাড়িয়ে যায়। যার কারণে দুর্নীতি আর অর্থপাচারের অভিযোগ দেশজুড়ে আলোচনার শীর্ষে ছিল এই সময়। যা বিএনপি সরকারের শেষদিকে এসে সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। তখনও সরকারি একেকটি ভবনের টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করতো একেকটি বাহিনী। কাবগুলোতে জুয়া-মাদকের নিয়ন্ত্রণ ছিল বিভিন্ন নামের বাহিনীর হাতে। তখনও যারা এসব অপকর্মের নিয়ন্ত্রক ছিল, তাদের জীবন বৃত্তান্তও খতিয়ে দেখলে দেখা যায়, তারাও বিভিন্ন সময়ে অন্য দল থেকে বিএনপিতে ভিড়েছিল। মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে বিএনপি ও দলটির অঙ্গ-সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতীম সংগঠনের পদ-পবদি কিনে ক্যাসিনো-মাদকের ব্যবসাসহ টেন্ডারবাজি ও চাঁদাবাজিতে মেতেছিল।
যেই জি কে শামীম, খালেদ, ফিরোজ, সাঈদ ও লোকমানকে চলমান অভিযানে গ্রেফতার করা হয়েছে তারা বিএনপির আমলেও এসব অপকর্মে জড়িত ছিল। বিশেষ করে, বিএনপি সরকারের আমলেও গণপূর্ত ভবনের টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করতো জি কে শামীম। বিএনপি আমলেই মোসাদ্দেক হোসেন ফালুর হাত ধরে মোহামেডান কাবের কর্তা বনেন লোকমান। আর হুইপ সামশুল হক চৌধুরীর উত্থানও বিএনপির হাত ধরেই।
যুবদল ও ছাত্রদলে পদবাণিজ্যের প্রতিবাদে সাম্প্রতিক সময়ে একাধিকবার বিক্ষোভ হয়েছে নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে। দিনের পর দিন দুই গ্রুপের মারামারিতে রক্তও ঝরেছে। টাকা দিয়ে পদ কিনতে না পেরে পদবঞ্চিতরা বহুবার বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে তালা দিয়েছে। সর্বশেষ ৩০ ডিসেম্বরের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও টাকার বিনিময়ে মনোনয়ন বিক্রির হরদম অভিযোগ ওঠে বিএনপির ভেতরেই।
জাতীয় পার্টি (জাপা) টাকার বিনিময়ে প্রেসিডিয়াম সদস্য পদসহ যে কোনো পদবি কেনা যায় এরশাদের জাপায়। এরশাদের জমানায় এরকম অভিযোগ ছিল অহরহ। এরশাদের মৃত্যুর কয়েকদিন আগে হঠাৎ আটজনকে একত্রে প্রেসিডিয়াম সদস্য করার পর অভিযোগ উঠেছিল কয়েকজনকে ¯্রফে টাকার বিনিময়ে প্রেসিডিয়াম সদস্য করা হয়েছে। টাকার বিনিময়ে সংসদ সদস্য বানানোর ঘটনা জাপায় সবার মুখে মুখে। সর্বশেষ সংসদের সংরক্ষিত মহিলা আসনে একজনকে লিখিত চুক্তি করে টাকার বিনিময়ে মনোনয়ন দেওয়ার ঘটনায় দলটিতে তোলপাড় হয়।
চলমান অভিযানের মধ্যেই দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন জাপার প্রেসিডিয়াম সদস্য শফিকুল ইসলাম সেন্টু। নেপাল থেকে তুখোড় জুয়াড়ীদের রাজধানীর কলাবাগান কাবে নিয়ে আসতেন এই সেন্টু। এছাড়া বনানীতেও একটি মদের বার চালাতেন মোহাম্মদপুরের ওয়ার্ড কাউন্সিলর সেন্টু। টাকার বিনিময়ে হঠাত্ জাপার প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সংসদ সদস্য হয়েছেন কারা ? জাপার যে কাউকে এই প্রশ্ন করলে এক নিশ্বাসে নাম বলে দিতে পারবেন তারা। জাপার কারা কারা ক্যাসিনো-মাদকের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত এই প্রশ্ন করলেও ঝটপট উত্তর মিলবে জাপার বহু নেতার মুখ থেকে।

ফেসবুকে লাইক দিন

আমাদের সাইটের কোন বিষয়বস্তু অনুমতি ছাড়া কপি করা দণ্ডনীয় অপরাধ।