মধ্যরাত : পর্ব-২১০

ড. তাইবুন নাহার রশীদ (কবিরত্ন), 

(গত পর্বের পর) : আজ মনে হয় এই পৃথিবীতে সুশান্তই ছিল আমার পরম সৃহৃদ। একমাত্র ভাই। স্নেহের ভালবাসার একান্ত আপনজন। সে চলে গিয়ে মনে হয় আমি সব হারিয়ে বসে আছি। আমার আজ আর কেহ নাই, কিছু নাই। আমার সব শক্তি, সব বিশ্বাস হারিয়ে গেল। আমার একটু অসুখ শুনলে সে উমাকে নিয়ে ছুটে আসত। সব দায় দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে আমাকে সারিয়ে তুলত। আমার মুখে একটু হাঁসি দেখার জন্য নিজের জীবন পর্যন্ত বিসর্জন দিত। আর আজ ? সে আমাকে এই পৃথিবীতে একা রেখে, উমাকে কার কাছে রেখে গেল ? সেকি তার ছোট ভাইর কাছে রেখে গেল ? এই এত বড় দায় দায়িত্ব আমার কাঁধে দিয়ে গেল। ভাবছিলাম, ভাবছিলাম বিয়ে সাদী করিনি, বেশ আছি। কখনও বাড়ীতে থাকব, কখনও গাছ তলায় থাকব। কখন দীনহীন ভিখারীর মত আমি পথে পথে ঘুরে বেড়াব। আমি অনেকক্ষণ আচ্ছন্নের মত পরে পরে কত কথা চোখ বুঝে ভাবছিলাম। সুশান্তর সঙ্গে সেই ইউনিভার্সিটির জীবন, দু’জনের বন্ধুত্ব দেখে সকলে বলত মানিক জোড়, কেউ কাউকে ছাড়া খেতাম না, কোথাও যেতাম না, আজ সুশান্ত আমাকে ছেড়ে চলে গেল।
বিজন আমার পাশে বসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল। প্রশান্ত-দা কিছু খান। আমি বললাম, আমার কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না। দেলা এসেছে, দোলাকে-উমাকে তোমরা কিছু খাওয়াবার চেষ্টা করো। কচ কোথায় ? এই যে দাদু, আমি বললাম- কচ সকলকে দেখ। তুমি নিজে খাওয়া-দাওয়া করো। আপনি খাবেন না দাদু ? আমি বললাম- মনটা আর একটু সুস্থ্য হোক, তখন খাব।
অনেক লোকজন ঘরে গিজ গিজ করছিল। দেলার মুখ খানা বড় ম্লান। চোখ দুটি ফোলা ফোলা। বেচারী অনেক কেঁদেছে। সুশান্ত ওকে খুব ভালবাসত। সুশান্তর নিজের কোন সন্তান-সন্ততি ছিল না। তাই দোলা আসার পর ওকে যেন আপন সন্তানের তুল্য ভালবাসত। অথচ দোলা সুশান্তকে দাদু বলে ডাকত। দোলার বিয়ের সময় আমি অসুস্থ্য ছিলাম, সুশান্তই সকল দায়-দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে দোলাকে কচের হাতে সম্প্রদান করেছে। বিয়ের সব কেনা-কাটা, গহনা থেকে শুরু করে বাসন-কোসন, লেপ-তোষক, গায় হলুদের তত্ব, কোনটা না সুশান্তর হাতে কেনা হয়নি। আজ সব কথা একে একে আমার মনের মধ্যে ঢুকে আমার মাথার মধ্যে তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে।
সুশান্ত, সুশান্ত, সুশান্ত বলে আমি আবার কেঁদে উঠলাম। অমিয় এসে বলল প্রশান্ত-দা আপনি যদি অমনি করেন তবে আমরা উমা-দি-কে সামলাতে পারবো না। আমি চুপ করবার জন্য মনস্থির করে ফেলালাম। তবু যেন মন বার বার বলে সুশান্ত আমাকে ফাঁকি দিয়ে চলে যাবে, আমার মন তা বিশ্বাস করতে পরেনি। বার বার মনে করেছি সুশান্ত হাসপাতাল থেকে সুস্থ্য হয়ে বাসায় ফিরে আসবে। কত লোক হাসপাতলে যায়। সকলেই আবার সুস্থ্য হয়ে হাঁসিমুখে বাসায় ফিরে আসে। সুশান্ত কেন সুস্থ্য হয়ে ফিরে এলনা। আমাকে ফাঁকি গিয়ে পরলোকে চলে গেল, হায় নিয়তি। দোলা এসে বলল দাদু, তুমি কিছু খাও। পেটে পিত্তি পরবে। আমি বললাম, তোমার উমাদি-কে কিছু খেতে দাও, খাওয়াবার চেষ্টা করো। দোলা বলল, বউদিরা চেষ্টা চালাচ্ছে। বিদ্যুৎ, অলক, সুশীল, ভার্সিটির প্রফেসারের বউরা সব আমার দুঃখের সময় এসে উপস্থিত। বৌরা সকলেই উমাকে সান্তনা দিচ্ছে, মানুষ কি চিরকাল বেঁচে থাকে ? আগে পরে, এক এক করে সকলকেই পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হয়। এমনি নানা কথা বলছে, উমা নিরবে নিখর নির্বাক।

(চলবে——-)

ফেসবুকে লাইক দিন

আমাদের সাইটের কোন বিষয়বস্তু অনুমতি ছাড়া কপি করা দণ্ডনীয় অপরাধ।