সর্বশেষঃ

এসডিজি লক্ষমাত্রা অর্জন হতে পরে ব্যহত

ভোলার চর অঞ্চলে বসবাসরত জনগোষ্ঠীর মানবেতর জীবন

বর্তমান ভোলা একদা বৃহত্তর বরিশাল জেলার একটি মহকুমা ছিল। ১৮৫৪ সালে দ্বীপটি মহকুমায় উন্নীত হয়। ১৯৮৪ সালে মহকুমা থেকে জেলার মর্যাদা পায়। আয়াতন ৩৪০৩.৪৮ বর্গ কিমি। হিমালয় থেকে নেমে আসা ৩টি প্রধান নদী পদ্মা, মেঘনা ও ব্রহ্মপুত্র বাহিত পলি দিয়ে মোহনায় গড়ে উঠেছে এ দ্বীপ। সমুদ্র সমতল থেকে এর গড় উচ্চতা ১২ ফুটের মতো। নৃ-তত্ত্ব ও ভূ-তত্ত্ববিদরা মনে করেন পূর্ব দিকে মেঘনা ও পশ্চিম দিকে তেঁতুলিয়া নদী বঙ্গোপসাগরের মোহনায় এসে গতিবেগ হারিয়ে ফেলে। ফলে এ শামত্ম স্থানটিতে কালক্রমে পলি ও নদীতে বয়ে আসা বর্জ্য জমা হয়ে আজকের ভোলা নামক দ্বীপটির জন্ম।
ভোলার জন্ম খুব বেশি দিনের নয়। আনুমানিক ১২৩৫ সালের দিকে দ্বীপটি গড়ে ওঠতে শুরু করে। এখানে প্রথম চর পরা শুরু হয়, ১২৩৫ সালের দিকে এবং ১৩০০সালের দিকে চাষাবাদ শুরু হয়। কালাক্রমে জেলার ভুখন্ডটি মেঘনা ও তেঁতুলিয়ার ভাঙ্গনে পরে শত শত মানুষ গৃহহীন হয়ে পরে। পরবর্তীতে ঢালচর, তাড়ুয়া ও চর কুকরী মুকরী নামে অসংখ্য চর জেগে ওঠে। ধীরে ধীরে এখানকার জনগোষ্ঠী নুতন করে বসবাস শুরু করে। তাদের আর্থ-সামজিক অবস্থা এবং জীবন-যাত্রা প্রতিনিয়ত মানবেতরভাবে অতিক্রম করছে। একেকটা দুর্যোগ আসে আর গ্রাম আরও ক্ষয়ে যায়। সেই ক্ষয়গ্রস্ত গ্রাম তখন আর তার মানুষগুলোকে ধরে রাখতে পারে না, তখন তারা হয় নিজ জন্মস্থান ত্যাগ করে চলে যেতে হয় অন্যত্র। যাদের কাছে ঘর হইতে আঙ্গিনাই বিদেশ মনে হতো, তারাও শহর-নগর-বন্দরে ভিড় জমায় অন্নের খোজে। ভাসতে ভাসতে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তাদের শেষ ঠিকানা বস্তি ও ফুটপাতে এসে দাঁড়ায়। তখন আর বোঝার উপায় থাকে না, ঘর-ফসল-মাঠ-বৃক্ষ-এদের পতন, গ্রামের পতন, কৃষির পতন।
আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী একান্ত ইচ্ছার কারণে কৃষি ক্ষেত্রে আমরা অনেক এগিয়ে গেছি এর মূলে রয়েছে চর অঞ্চলের কৃষকদের হাড়ভাঙ্গা খাটুনি। কিন্তু প্রত্যন্ত অঞ্চলে এ সকল মানুষ এখনও নানাবিধ সুযোগ সুবিধার বাইরে। একদিন ভোলার চর কুকরি মুকরি বনের মধ্য দিয়ে হাঁটতে গিয়ে দেখা পেলাম একটি কুঁড়েঘর। সেখানে কথা হয় জান্নাত বেগম (৩৫) এর সাথে।
চরের নানা বিষয়ে প্রশ্ন করতেই কান্নায় জড়িত কন্ঠে জন্নাত বলেন, ঝড় বাদল আইলে আমাগো অনেক কষ্টের মইধ্যে থাকতে হয়। জন্মের দুই দিনের মাথায় আমার সন্তান বিনা চিকিৎসায় মারা গেছে। কোন চিকিৎসা পাই নাই ডায়রিয়া হলে মরণ ছাড়া আমাগো উপায় নাই। খেয়া পার হয়ে শহর পর্যন্ত যেতে অনেক রোগী পথেই মারা যায়। অভাব অনটনের সংসারে কেউ অসুস্থ্য হলে চিকিৎসা খরচ মিটাতে বছরের খোরাক ঘরের চাউল বেঁচে দিতে হয়। নদীতে মাছ শিকার করতে গিয়ে সাগরে ডুবে স্বামী মারা গেছে তিন বছর আগে।
একটু এগিয়ে গিয়ে কথা হয় ওই চরের বাসিন্দা সখিনা বেগম এর সাথে। কেমন আছেন জানতে চাইলে সখিনা বেগম অসহায়ত্ব নিয়ে তাকিয়ে রইলেন। হঠাৎ আবেগ জড়িত কন্ঠে বললেন, এক বছর আগে নদীতে নাও বাইতে গিয়ে স্বামী মারা গেছে। স্বামী মারা যাওয়ার পর এনজিও আলারা একটা ঘর করে দিছে। ৩ মেয়ে, ১ ছেলে নিয়ে অভাব অনটনে কাটছে আমাগো সংসার। বড় মেয়ের জামাই ডায়রিয়ায় মারা যাওয়ার পর সে এখন আমার সংসারে আছে। তার ভরণ-পোষন আমার করতে হয়। মেয়ের শ্বশুরবাড়ির লোকজন তাকে আমার ঘাড়ে চেপে দিয়েছে। তারা আমার মেয়ের খোজ খবর নেয় না। দুই বছর আগে পুত্র সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন। চিকিৎসার অভাবে জন্মের কয়েকদিনের মাথায় সেই সন্তানটি মারা যায়।
চর কুকরি মুকরি ১২ হাজার ১শ’ ১৪ জন জনসংখ্যার বসতি। এখানকার বেশিরভাগ মানুষই সুবিধা বঞ্চিত। সাগর মোহনায় অবস্থিত চর থেকে চর কচ্ছপিয়া হয়ে চরফ্যাশন উপজেলা পর্যন্ত উত্তাল সাগর খেয়া পার হতে সময় লাগে দুই ঘন্টা। বর্ষাকালে ঝড় বাতাসে তাও বন্ধ থাকে। চিকিৎসা সেবার কোন ব্যবস্থা নেই এই চরে। বিনা চিকিৎসায় অনেক মানুষ মারা যায়। শিক্ষা ব্যবস্থার তেমন কোন ব্যবস্থা নেই এখানে। শিশুরা পঞ্চম শ্রেণীর উপরে কোন শিক্ষা লাভ করতে পারে না। রাস্তাঘাটের তেমন কোন নির্দশন নেই এই চরে। এই এলাকায় এমন অনেকে ছেলে মেয়ে আছে যাদের মেধা আছে। বাবা-মাও চায় তাদের মানুষ করতে। কিন্তু প্রকৃতির বিরূপ আচরণের কারণে তারা তা পেরে উঠছে না। হয়তো তিন চার বছর পরিশ্রম করে কিছু অর্থ জমিয়ে নিজের ঘরটি ঠিক করেছে। ছেলে মেয়েদের খাবার যোগাড় করছে। হঠাৎ কাল বৈশাখীর ছোবল কিংবা জলোচ্ছ্বাসে তাদের এই সামান্য সম্বলটি ভেঙে চুরমার করে দেয়। ওই পরিবারগুলো আবার সেই দারিদ্রের বিত্তে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। প্রকৃতপক্ষে তাদের জন্য কিছু একটা করা অতীব জরুরী। ভোলা একটি দ্বীপজেলা এখানে অনেকগুলো চর আছে।
ভোলা জেলা সদরটিও একটি চর ছিল। আজ থেকে ৮০০ থেকে ৯০০ বছর আগে। এখন একটি জেলায় পরিণত হয়েছে। নদীভাঙনের শিকার কয়েক হাজার মানুষের আশ্রয়স্থল এখন মেঘনা নদীর মাঝে জেগে ওঠা একটি চর। বাসিন্দারা এর নাম দিয়েছেন ‘ভোলার চর’। এই বাসিন্দারা চরটিতে স্থানীয় হয়ে উঠেছেন ১৫ থেকে ১৬ বছর ধরে। চরটিতে আসায় তাঁদের শুধু জায়গারই পরিবর্তন হয়েছে। নিত্যকার জীবনের দুর্ভোগ থেকেই গেছে। চরে মানুষের সংখ্যা প্রায় ৫ হাজার। ধারণার ভিত্তিতে স্থানীয় বাসিন্দারা এ তথ্য দিয়েছেন। জনসংখ্যার সঠিক হিসাব নেই প্রশাসনের কাছে। ভোলা সদর উপজেলার অন্তর্ভুক্ত চরটিতে রাজাপুর ইউনিয়ন থেকে ট্রলারে করে যেতে প্রায় এক ঘণ্টা লাগে। সাধারণভাবে শান্তিপূর্ণ একটি জনবসতি মনে হলেও বিপরীতটা জানা গেল মানুষের সঙ্গে কথা বলে। ট্রলারে করে দূর্বৃত্তদের যাতায়াত আছে এই চরে। তারাই এই চরের শাসন নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেন। জমির মালিকানা দাবি করে বাসিন্দাদের কাছ থেকে টাকা আদায় করেন, না দিলে কেটে নিয়ে যান খেতের ফসল ও গবাদিপশু। মূল ভূখন্ড থেকে দূরে হওয়ায় চরটির বাসিন্দারা উপজেলা প্রশাসন বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছেও নালিশ দিতে পারেন না।
চরের বাসিন্দা মোজাম্মেল হোসেন বলেন, রাজাপুর ইউনিয়নের ভাঙ্গনকবলিত মানুষ ১৫ থেকে ১৬ বছর আগে চরে এসে হোগলাপাতা, খড়, বাজালি বন পরিষ্কার করে বসবাস শুরু করেন। ভাঙনের কারণে এ চর ভোলা থেকে অনেক দূরে। তবে বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জ ও লক্ষ্মীপুরের কাছে। স্থানীয় জোতদার ছাড়াও পাশের দুই জেলার লোকজন মাঝেমধ্যে চরে হামলা চালিয়ে সম্পদ লুট করেন। সরকারকে চরের জমির বাৎসরিক খাজনা দিতে হয় না। কিন্তু ভূমিদস্যুরা চরে বসবাসকারীদের কাছে থেকে বসবাস, ফসল উৎপাদন, গবাদিপশু পালনের জন্য বাৎসরিক চাঁদা নেয়। চাঁদা না দিলে ডাকাত দিয়ে হামলা, ঘরবাড়ি ভাঙচুর, খেতের ফসল, গবাদিপশু লুট করা হয়।
মজিদ মাতাব্বর, স্থানীয় বাসিন্দা, আরেক বাসিন্দা শরিফ উদ্দিন বলেন, বছরে দুটি ফসল উৎপাদন হয়। ফসল উৎপাদনের সময়ই মূলত হামলার ঘটনা বেশি ঘটে। চরটি ভোলা, মেহেন্দিগঞ্জ নাকি লক্ষ্মীপুরের, তা নিয়ে মূল ভূখন্ডের প্রভাবশালীদের মধ্যে বিরোধ আছে। সে বিরোধের জেরেও চরে এসে হামলার ঘটনা ঘটে। এসব বিরোধকে কেন্দ্র করে চরবাসী নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। দিনে দিনে জমিতে ফসলের আবাদ যত বাড়ছে, তাঁদের সমর্থকদের হামলাও তত বাড়ছে।
এ ছাড়া চরের জেলেরাও দূর্বৃত্তদের কাছে গলদা-বাগদা চিংড়ির রেণু বিক্রি করতে বাধ্য হন। মূল ভূখন্ডে একটি রেণুর দাম পাঁচ টাকা হলেও চরে জেলেদের সে রেণু এক টাকায় বিক্রি করতে বাধ্য করা হয়। চরের জমি সরকারি। কয়েকজন মালিকানা দাবি করে রীতিমত সন্ত্রাসী কার্যকলাপ চালাচ্ছেন। এরকম ভোলা জলার চারদিকে রয়েছে জেগে ওঠা অসংখ্য চর ভোলা সদর উপজেলায়- বাঘমারা, কোড়ালিয়া, গাগুরিয়ার চর, ভেদুরিয়া, রাজপুর, নতুন চর, সুলতানাবাদ, রামদাসপুর, মাঝির চর। দৌলতখান উপজেলায়-মদনপুর, চর হোসেন, নেয়ামতপুর, ভবানীপুর, হাজিপুর, মাঝের চর। বোরহানউদ্দিন উপজেলায়- চর গংগাপুর, চর লতিফ। তজুমদ্দিন উপজেলায়- মহেষখালী, চর জহিরউদ্দিন, চর মোজাম্মেল, চর তজাম্মেল, বাসন ভাঙ্গা, পাতার চর। মনপুরা উপজেলায়, কলাতরীর চর, চরসীতারম, চর নিজাম, ঢালচর, বদনার চর। লালমোহন উপজেলায়- মঙ্গল সিকদার, নতুন চর, চরকচুয়া, কচুখালীর চর, চর শাহাজল। চরফ্যাশন উপজেলায়-ঢালচর, চর পাতিলা, চর কুকরী মুকরী, সিকদার চর, চর মোতাহার, চর শাহাজল, ড্যামচর, চর মিজান, চর পিয়াল, ঠেলার চর, চর হাসিনা, দারভাঙ্গারচর, চর ফারুকী, চর লিউলিন, চর ভাসন, চর ময়েজ, চর মানিকা।
এ সকল এলাকার অর্থনৈতিক অবস্থা এরকম বিরাজ করলেও তাদের সামজিক অবস্থার নেই কোন উন্নতি। নেই স্যানিটেশন, সুপেয় পানি ব্যবস্থা থেকে শুরু করে স্বাভাবিক জীবন ধারণের সুযোগ-সুবিধা। গর্বভতী মায়েদের নেই কোন ব্যবস্থা। তাই এখানে মাতৃমৃত্যুর হারও অনেক বেশী, সন্তানে প্রসবকালীন চিকিৎিসার অভাবে মা ও শিশু মৃত্যুর ঘটনাা নিয়মিত ঘটছেই। উন্নত চিকিৎসার জন্য যোগাযোগের নেই কোন ব্যবস্থা। বন্যা জলোচ্ছ্বাসের সময় মৃত্যুঝঁকি নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে। বন্যা জলোচ্ছ্বাসের সময় তাদের জীবন রক্ষার্থে কোন ব্যবস্থা নেই।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ডিজিটাল বাংলাদেশকে ২০৪১ সালে স্মার্ট বাংলাদেশে পরিণত করার ঘোষণা দিয়ে সে লক্ষে কাজ করে আসছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশটি এমডিজি লক্ষমাত্রা অর্জন করেছে। ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজির লক্ষমাত্রা দারিদ্র্য নির্মূল, সুস্বাস্থ, মানসম্পন্ন শিক্ষা বিশুদ্ধ পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন, জলবায়ু বিষয়ক পদক্ষেপ সূচকগুলোর অর্জন করতে হলে চরবাসীর উন্নয়নে সরকারের সুনির্দিষ্ট ও সুসংগঠিত কর্মসূচী গ্রহণ করা উচিত।

মোঃ বিল্লাল হোসেন
শিক্ষক, গবেষক ও সাংবাদিক
০১৭১৭২৪৯৮৪৫, sun.bhola.bd@gmail.com

 

ফেসবুকে লাইক দিন

আমাদের সাইটের কোন বিষয়বস্তু অনুমতি ছাড়া কপি করা দণ্ডনীয় অপরাধ।