সর্বশেষঃ

৭ ই জুন ৬ দফা দিবস

১৯৬৫ পাক ভারত যুদ্ধের মধ্য দিয়ে পূর্ব বাংলার জনগণের আত্ম উপলব্ধি ঘটে যে, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা বলতে কিছুই ছিল না তা এই যুদ্ধে স্পষ্ট হয়ে উঠে। শুধুমাত্র ভারতের দয়ার কারণে পূর্বপাকিস্তান ভারতীয় দখল থেকে বেচে যায়। ১৭দিন পর ঐ যুদ্ধে প্রশাসনিক দিক দিয়েও পূর্বপাকিস্তান কেন্দ্র থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পরেছিল। যার ফলে তৎপরবর্তী পূর্ব পাকিস্তানের আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসন এর দাবী উত্থাপন একটি মোক্ষম সময় বলে বিবেচিত হয়।
১৯৬৫ সালের যুদ্ধের পরপরই স্বায়ত্বশাসন প্রবক্তাদের অন্যতম শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেন যে, পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্বশাসন এর দাবী যৌক্তিক ও ন্যায় সংগত। শুধু ঘোষণা প্রদান করেই শেখ মুজিব ক্ষান্ত হন নাই। তিনি স্বায়ত্বশাসনের দাবী আদায় এর লক্ষে ৬ দফা কর্মসূচী প্রণয়ন করেন।
১৯৬৫ সালের ৫ ও ৬ ফেব্রুয়ারী লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধীদল সমূহের নেতৃবৃন্দ এর বৈঠকে ঐতিহাসিক ৬ দফা কর্মসূচী উপস্থাপন করেন। শেখ মুজিব ৬ দফা কর্মসূচী উপস্থাপন করেন ৬ ফেব্রুয়ারী, ৭ই ফেব্রুয়ারী ঢাকার সংবাদপত্রে এ বিষয় সংক্ষিপ্ত বিবরণ ছাপা হয়। ৬ দফা সম্পর্কে পূর্ব বাংলার প্রধান আওয়ামীলীগ নেতাদের অধিকাংশ কিছুই জানতেন না। তরুণ আওয়ামীলীগ নেতৃবৃন্দ এই দাবীর প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানায়। আওয়ামীলীগ ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে অনুমোদন হওয়ার পূর্বেই ২১ শে ফেব্রুয়ারী ১৯৬৫ পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামীলীগ এর ব্যানারে শেখ মুজিবুর রহমান এর নামে “আমাদের বাচার দাবী ৬ দফা” এই শিরোনামে লিফলেট বিলি করা হয়।
উক্ত লিফলেটে ৬ দফা দাবীর পুর্নাঙ্গ বিশ্লেষণ দেয়া হয়। (১) ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব এর ভিত্তিতে পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র রচনা করতে হবে। পাকিস্তানকে ফেডারেল রাষ্ট্র ব্যবস্থার গড়ে তুলতে হবে। পার্লামেন্টারী পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। প্রাপ্ত বয়স্কদের ভোটাধিকার এর ভিত্তিতে আইন সভার সদস্য নির্বাচন করতে হবে। আইন সভা সার্বভৌম হবে।
(২) কেন্দ্রের ফেডারেল সরকারের হাতে থাকবে শুধু দেশ রক্ষা ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। অবশিষ্ট মন্ত্রণাল প্রদেশ এর উপর ন্যাস্ত থাকবে।
(৩) পাকিস্তানের দুই অংশের জন্য দুইটি পৃথক অথচ সহজ লেনদেনের দুই মুদ্রা ব্যবস্থা অথবা ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক এর মাধ্যমে এক মুদ্রা থাকলেও দুইটি আঞ্চলিক রিজার্ভ ব্যাংক এর মাধ্যমে তা নিয়ন্ত্রণ করার কথা বলা হয়।
(৪) খাজনা, টেক্স ধার্জ্য ও আদায় আঞ্চলিক সরকারের হাতে ন্যাস্ত করার কথা বলা হয়।
(৫) বৈদেশিক মুদ্রা আহরণ ও নিয়ন্ত্রণে আঞ্চলিক সরকারের হাতে রেখে, নির্ধারিত হারে দুই অঞ্চল থেকে উপার্জিত বৈদেশিক মুদ্রার একটি অংশ ফেডারেল সরকারের হাতে প্রদান করার কথা বলা হয় এবং তা থেকেই ফেডারেল সরকার তার নির্বাহ করবে। বৈদেশিক বাণিজ্য মূলত: ফেডারেল সরকারের হাতে রাখার কথা বলা হয়।
(৬) প্রদেশ এর জন্য মিলিশিয়া বা প্যারা মিলেটারী বাহিনী আঞ্চলিক সরকারের নিয়ন্ত্রণ গঠিত ও পরিচালতি হবে।
এই ছয় দফা দাবী সম্বলিত দাবীনামা তৎকালীন আওয়ামীলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির অধিকাংশ নেতা সভাপতি আব্দুর রশিদ তর্কবাগিশ, আব্দুস সালাম খান, কুমিল্লার আব্দুর রহমান, যশোরের মশিউর রহমান ও রওশন আলী সহ প্রধান নেতাদের এক বিরাট অংশ এর বিরোধীতা করেন।
১৩ ফেব্রুয়ারী ছাত্রলীগ সভাপতি সৈয়দ মোজাহারুল হক বাকি ও সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক ৬ দফা দাবীর প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানান। চট্টগ্রাম থেকে আওয়ামীলীগ নেতা এম. এ জলিল, এম. এ হান্নান এর সমর্থনে বাক্তব্য রাখেন।
১৯৬৬ সালের ১২ মার্চ ঢাকার রমনা গ্রিনে মৌলিক গণতান্ত্রিদের এক জমায়েথ তৎকালীন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান হুশিয়ারী উচ্চারণ করে বলেন যে, আওয়ামীলীগের ৬ দফা দাবী পাকিস্তানের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের উপর হুমকি স্বরুপ। তিনি শেখ মুজিব এর এই ৬ দফা আন্দোলনকে কঠোর হস্তে দমন করার হুমকি প্রদান করেন।
১৯৬৬ সালের ২৩ মার্চ আওয়ামীলীগের ওয়ার্কিং কমিটির এক সভায় ৬ দফা অনুমোদন এর জন্য পেশ করা হয়। দলের সভাপতি স্বয়ং আব্দুর রশিদ তর্কবাগিশ সহ বেশ কয়েকজন নেতা এর বিরোধীতা করেন, অবশেষে উক্ত সভায় পরবর্তী কাউন্সিলে অনুমোদন নেয়ার শর্তে ওয়ার্কিং কমিটি ৬ দফা দাবী অনুমোদন করেন। অনুমোদন এর আগেই দলের সভাপতি জনাব আব্দুর রশিদ তর্কবাগিশ সভাস্থল ত্যাগ করেন। তৎস্থানে দলের সহ-সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম সভাপতিত্ব করেন।
১৯৬৬ সালের ১৮ মার্চ মতিঝিল হোটেল ইডেনে আওয়ামীলীগের কাউন্সিল অধিবেশন বসে। সভাপতি তর্কবাগিশ অনুপস্থিত থাকেন। উক্ত কাউন্সিলে বিপুল সমর্থনে ৬ দফা দাবী অনুমোদিত হয়। ১৯ মার্চ সর্বসম্মত সিদ্ধান্তক্রমে শেখ মুজিবুর রহমানকে দলের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। তজউদ্দিন আহম্মেদ সাধারণ সম্পাদক হন। ১৯৬৬ সালের ২০ শে মার্চ ঢাকার পল্টন ময়দানে ৬ দফার সমর্থনে প্রথম জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। তৎপরবর্তীতে শেখ মুজিব ৬ দফার সমর্থনে প্রতি জেলায় জেলায় জনসংযোগ শুরু করেন। অতি অল্প সময়ের মধ্যে ৬ দফা দাবী বাংলার প্রতিটি ঘরে ঘরে পৌছে যায়। শেখ মুজিব প্রতিটি সভাতেই জনগণকে দ্রুত আত্মত্যাগ এর জন্য প্রস্তুত হতে বলেন। ২০ মার্চ এর পর শেখ মুজিব গণসংযোগ করার সময় পেয়েছিলেন মাত্র ৫ সপ্তাহ। সর্বমোট ৩৫ দিন ৬ দফার পক্ষে বক্তব্য রাখার সযোগ পান শেখ মুজিবুর রহমান।
অপর দিকে ঢাকার পল্টন ময়দানের জনসভায় দাড়িয়ে জুলফিকার আলী ভূট্টো চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন শেখ মুজিবকে। শেখ মুজিব তার চ্যালেঞ্জকে সানন্দে গ্রহণ করেন। কিন্তু ভূট্টো চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার আর এগিয়ে আসেন নাই। ১৯৬৬ সালে ২০ শে এপ্রিল যশোরের এক জনসভা থেকে শেখ মুজিবকে প্রথম গ্রেফতার করা হয়। অবশ্য সাথে সাথে জজকোর্ট জামীন দিয়ে দেয়। ২২ শে এপ্রিল শেখ মুজিবকে তার ধানমন্ডি বাসভবন থেকে গ্রেফতার করে সিলেট নিয়ে যাওয়া হয়। ২৩ শে এপ্রিল সিলেট জজকোর্ট জামিন মঞ্জুর করেন। সাথে সাথে ময়মনসিং এর দায়ের করা অপর একটি মামলার গ্রেফতার করে ময়মনসিং নিয়ে যাওয়া হয়। ২৫ শে এপ্রিল ময়মনসিং আদালত জামিন মঞ্জুর করে।
১৯৬৬ সালের ২৬ এপ্রিল তিনি ঢাকায় ফিরে এসে সারাদেশে ৬ দফা প্রচার বাড়িয়ে দেন। ছাত্রলীগ ভিন্নভাবে প্রচার কাজ জোরদার করে তোলে। এমনিভাবে তিনি নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে সারাদেশে প্রচার কাজ অব্যাহত রাখেন। ১৯৬৬ সালের ৮ মে নারায়নগঞ্জে এক বিশাল জনসভা করেন। এটাই ছিল ৬ দফার দাবীতে তার শেষ জনসভা। ঐ দিনই তার ৩২ নং ধানমন্ডির বাড়ী থেকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। একই সময় তাজউদ্দিন আহম্মেদ সহ অধিকাংশ কেন্দ্রিয় নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করা হয়। সারাদেশে পুলিশ এর তান্ডব শুরু হয়। পাকিস্তান দেশ রক্ষা ডিপিআর আইনে জেলা মহকুমা লেভেল এর নেতাদের একের পর এক গ্রেফতার করা হয়।
১৯৬৬ সালের ৭ জুন ৬ দফা দাবী আদায়ে শেখ মুজিব সহ সকল রাজবন্দিদের মুক্তির দাবীতে আওয়ামীলীগ এর আহ্বানে সারাদেশে প্রথম হরতাল আহ্বান করা হয়। হরতালে সারাদেশ অচল হয়ে পরে। সারাদেশে মিছিল বিক্ষোভে পুলিশ এর লাঠিচার্জ, গুলি, কাদানো গ্যাস নিক্ষেপ এর ফলে তেজগা এর শ্রমিক নেতা মনু মিয়া সহ ১০ জন নিহত হন। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খান গুলি বন্দুক দিয়ে শত চেষ্টা করেও ৬ দফা আন্দোলনকে স্থীমিত করতে সক্ষম হন নাই। অবশেষে ১৯৬৮ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারী এক সরকারী প্রেস নোটে জানানো হয় যে, ভারতীয় হাই কমিশনের ফাষ্ট সেক্রেটারী মিষ্টার ওঝার সাথে যোগসাজোস করে পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন করার পরিকল্পনা নিয়ে শেখ মুজিব সহ অন্যদের বিরুদ্ধে শিঘ্রই ব্যবস্থা নিবেন সরকার। এই ষড়যন্ত্র মামলায় সেনা, নৌ-বাহিনী, বিমানবাহিনী সহ ১৯ জন সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়।
ইতিহাসে এটাই আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নামে খ্যাত। মামলার শিরোনাম ছিল রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিব। ১৯৬৮ সালে ঢাকা সেন্ট্রাল জেল থেকে শেখ মুজিবকে মুক্তি দিয়ে, জেল গেইটেই উক্ত মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে তাকে ঢাকা সেনানিবাসে নিয়ে যাওয়া হয়। শুরু হয় ঢাকা সেনানিবাসে রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিব এর মামলা তথা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। এরই মধ্যে ১৯৬৮ সালের ১০ ফেব্রুয়ারী শেখ মুজিব সহ আগরতলা মামলার সকল অভিযুক্তদের মুক্তির দাবীতে দেশের সকল শহর বন্দরে বিক্ষোভ মিছিল বের করা হয়। আন্দোলন এর বিভিন্ন পর্যায় এসে ৬ দফা সংবলিত ১১ দফার ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। ৬ দফা ও ১১ দফার ভিত্তিতে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ এর নেতৃত্বে ২৪ ফেব্রুয়ারী গণঅভ্যুত্থান সুচিত হয়। আন্দোলনের ব্যাপকতায় অবশেষে ১৯৬৯ সালের ২২ শে ফেব্রুয়ারী শেখ মুজিব সহ সকল বন্দিদের মুক্তি দেয়া হয়।
ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ মুক্ত শেখ মুজিবকে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে গণসংর্ধ্বনা প্রদান করে। উক্ত সভায় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ এর পক্ষ থেকে শেখ মুজিবকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে বরণ করে নেয়া হয়। উক্ত জন সমুদ্রে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন, ৬ দফা বাংগালির মুক্তির সনদ। ৬ দফার ব্যাপারে কোন আপোষ নাই।

লেখক : ফজুলল কাদের মজনু মোল্লা
সভাপতি
ভোলা জেলা আওয়ামীলীগ।

ফেসবুকে লাইক দিন

আমাদের সাইটের কোন বিষয়বস্তু অনুমতি ছাড়া কপি করা দণ্ডনীয় অপরাধ।