আমার ছোট বেলা

ড. তাইবুন নাহার রশীদ

(গত সংখ্যার পর) একটি গান গাও তো মা, এখনই ত গিয়ে আবার মক্কেল নিয়ে বসতে হবে। বৈঠকখানায় যাবার আগে বলতেন তিনি। সেই ফিরতে রাত ১২টা বাজবে। অনেক রাতে বাবা বৈঠকখানা থেকে ফিরে আসতেন। আমার বয়স তখন ১০ বছর, ঘুমে ঢুলঢুলু হয়ে বসে থাকতাম। কখন বাবাকে কাছে বসে খাইয়ে দাইয়ে সারা ঘরদোর খুজে দেখে শুতে হবে। এই ছোট বয়সেও যেন আমার মাথার উপর এক গুরু দায়িত্বভার বহন করে আমি অহনিশি দাড়িয়ে আছি আমার মা বাবার সেবা শুশ্রুষা ও যতেœর জন্য। বাবা অনেক রাতে ফিরতেন, তখন রাত ১২টা কি ১টা হবে। মা তখন রোগ শয্যায় ক্লান্ত হয়ে হয়তঃ একটু চোখের পাতা এক করেছেন।
আমি তখন বাবাকে কাছে বসে এটা ওটা পাতে তুলে দিয়ে মায়ের মত স্নেহ আদর করে খাইয়ে দরজা জানালা বন্ধ করে লোহার সিন্দুকের চাবি আবার গদির নিচে থেকে অন্য জায়ঘায় সরিয়ে রেখে শুতে যেতাম। খুব ভোরে ফজরের নামাজের আজান হওয়ার মাত্রই বাবা ঘুমে থেকে উঠে নামাজ পড়ে এসে বাবা আমাদের দু’বোনকে ডেকে তুলতেন। যদি আলস্য করে ঘুমিয়ে থেকেছি, বাবার সরু বোতলে বেতের লাঠির একটা দন্ড আমাদের গা স্পর্শ করত।
বাবা বলতেন, এ তবু, এই আম্মু তোরা শীঘ্রি বাইরে বেড়িয়ে আয় শরীর ভাল থাকবে। কোথায় বেড়ানো বেড়ানোর নামে ঘুম থেকে উঠেছ হিন্দু প্রতিবেশীর বাড়ীর ফুল চুরি করে এনে বাসায় বসে বসে মালা গাঁথতাম। তখন সেই ছোটবেলায় বুঝতে পারিনি হাটা চলাফেরা করা স্বাস্থ্যে রজন্য কত মূল্যবান। বিকাল বেলা বাবা কোর্ট থেকে ফিরে দেখতেন আমি শুয়ে শুয়ে গল্পের বই পড়ছি। বাবা খুব বকতেন। বলতে যাও ব্যাডমিন্টন খেল, স্কিপিং কর, ফুটবল নিয়ে খেল, না হয় হাটা-চলা কর। কিন্তু আমার অসম্ভব বই পড়ার নেশা ছিল, অনেক রাত পর্যন্ত জেগে জেগে হারিকেন জ্বালিয়ে বই পড়তাম। বাবা কোর্ট থেকে ফিরে এসে বলতেন তবু কই ? মা বলতেন, এই দ্যাখেন গিয়ে আইনে পড়ছে। বাবা বলতেন, আহা তোমাকে দেখাশুনা করার জন্য মেয়েটা পড়াশুনা ছাড়িয়ে দিলাম আর তুমি বলছ, আইন পড়ছে। পড়াশুনা না করলে কি নিয়ে থাকবে ?
ছোটবেলায় কোনদিন আমাদের বৈকখানায় আমরা পড়াশুনা করতে পারিনি। অন্য উকিল সাহেবরা বাসায় গিয়ে পন্ডিত-মাষ্টারের কাছে পড়াশুনা করেছি। তখনকার দিনের বি.এ, এম.এ পাশ। ভাল ব্রাহ্মণ মাষ্টার পন্ডিতদের কাছে লেখাপড়া করেছি। যতদিন স্কুলে পড়েছি ততদিন বাবা আমাদের দু’বোনের জন্য বড় বড় বিদ্বান লোক দিয়ে আমাদের পড়াশুনা করিয়েছেন।
কোরআন শরীফ ৩-৪ বার পড়েছি। খতম করেছি তাও কোরআনে হাফেজ দিয়ে। বড় বড় গানের মাস্টার রেখে বাবা আমাকেও আমার বোনকে গানের তালিম দিয়েছেন।

ফেসবুকে লাইক দিন

আমাদের সাইটের কোন বিষয়বস্তু অনুমতি ছাড়া কপি করা দণ্ডনীয় অপরাধ।