মধ্যরাত : পর্ব-১৯১

ড. তাইবুন নাহার রশীদ (কবিরত্ন),

(গত পর্বের পর) : রাত তখন ১১টার কাছে চলছে। সমুদ্রের রূপ দেখার মত তখন আমার মন প্রস্তুত ছিলনা। চাঁদটা অনেক অনেক সুন্দর হয়ে আমার পানে তাকিয়ে ছিল। ছোট ছোট তারাগুলি মিটি মিটি করে আমাকে আশ্বাস দিচ্ছিল। সমুদ্রের বিক্ষুব্ধ গর্জন আমার কানে এসে বাজছে, আমি দিগ বিদিগ শূণ্য হয়ে মোটর ছেড়ে চলে এলাম। মোটেলে ওদের রেখে সুশান্তর কাছে গেলাম, দেখলাম ও চোখ খুলে এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখছে। আর মাঝে মাঝে প্রশান্ত প্রশান্ত করে ডাকছে। আমি মুখের কাছে মুখ নিয়ে বললাম কিরে ? ও আমার হাত ধরে কেঁদে ফেলল। আমি এখানে কেন ? পরে বলব, তুই সুস্থ্য হ। আমি অনেকক্ষণ ওর কোকড়া কোকড়া চুলগুলির ভিতর আঙ্গুল চালাতে লাগলাম। দুঃখে কষ্টে ব্যথা বেদনায় আমার দু’চোখ দিয়ে ঝর ঝর করে জল গড়িয়ে পরছিল। সুশান্ত বলল, তুই কাঁদছিস ? আমি আর জোরে হু হু করে কেঁদে ফেললাম। তবু ওকে বললাম না, যে কচ-দোলাকে পাচ্ছিনা। চুক করলাম সুশান্তর দিকে চেয়ে ও অন্তত পক্ষে সুস্থ হয়ে উঠুক। রাতটা মোটেলে কাটিয়ে খুব ভোরে আমি আকাশ চৌধুরী আবার সমুদ্রের পাড় ধরে দোলা-কচের খোঁজ খবর করতে লাগলাম। পুলিশ অফিসে গিয়ে ওদের নাম-ধাম দিয়ে এলাম। কত লোক জনকে ইংলিশ ওদের ড্রেসক্রিপশন দিলাম, কিন্তু কেউই ওদের কথা বলতে পরেনা।
শেষ পর্যন্ত আস্তে আস্তে গাড়ী চালিয়ে চালিয়ে আমি সমুদ্রের কুলধরে যতদূর পর্যন্ত রাস্তা সাপের লেজের মত হয়ে বেঁকে বেঁকে কোন সীমাহীন অনন্ত অসীমে গিয়ে শেষ হয়েছে, সেই শেষ পর্যন্ত যাওয়ার প্রতিজ্ঞা নিয়ে এগিয়ে চললাম। সমুদ্রে তখন সুর্যটা সোনার থালার মত সমুদ্রের বুকে ছায়া ফেলছে, কুল কুল ধ্বনি তুলে সমুদ্রে জোয়ারের সুচনা হচ্ছে। দেখলাম কতগুলো জেলে স্প্রীড বোট নিয়ে মাছ ধরছে, আমি তাদের জিজ্ঞাসা করলাম। ওরা আমার কথা শুনে চিন্তা করে বলল, কাল সন্ধ্য হয় হয় দুটো ইন্ডিয়ান ছেলে-মেয়ে যাচ্ছিল। গভীর বনভূমি থেকে একটি ভাল্লুক আক্রমন করে তাদের দু’জনকে ছিন্ন-ভিন্ন করে ফেলে। এখানকার লোকেরা তাদের কোথায়, কোন হাসপাতালে দিয়েছে ওরা বলতে পারবে।
আমি দম বন্ধ হয়ে সব শুনে তাড়াতাড়ি এসে পুলিশকে ইনফরম করলাম। আবার মোটেলে এসে কুসুমকে সান্তনা দিলাম। বললাম, দোলা-কচের কিচু বর্ণনা পেয়েছি, ভগবানকে ডাকো। উমাকে সুশান্তর কাছে নিয়ে গেলাম। ক্যামেলিয়ার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম, দেখলাম ও চোখ তুলে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। দেবপ্রিয় কাছে বসে হাত বুলিয় দিচ্ছে, মাথার প্রকান্ড চুলগুলির মধ্যে। শুনলাম ক্যামেলিয়ার এখন বিপদের ধাক্কা কাটিয়ে উঠেছে, তবে সুস্থ্য হতে দু-চার দিন লাগবে। দেবপ্রিয় বলল, সুশান্ত বাবু কেমন আছেন ? ক্যামেলিয়া চমকে উঠল, সুশান্ত-সুশান্ত কি ? দেবপ্রিয় বলল, তেমন কিছু না। পরে বলব। ক্যামেলিয়া বলল প্রিয় এখন বল, দেবপ্রিয় বলল; আরও সুস্থ্য হও, পরে গল্প করব।
আমি উমাকে সুশান্তর কাছে রেখে আবার দোলা-কচের সন্ধানে বের হলাম। এখনও সুশান্তকে আমি ওদের সম্বন্ধে কিছু বলিনি। বলার অনেক সময় পাব। আগে ওরা সুস্থ্য হোক। উমা দেখলাম এ রুম, ও রুম করে ঘোরাঘুরি করছে। উমাকে চুপে চুপে বললাম, সুশান্তর কাছে, ক্যামেলিয়ার কাছে দোলা-কচের কথা বলবে না। সুশান্ত যে অসুস্থ্য সে কথা ক্যামেলিয়াকে বলো না। ওরা দু’জন এ সম্বন্ধে কিছুই জ্ঞাত না। আমি আবার উদভ্রান্তের মত, অসহায়ের মত, দোলার সন্ধানে বেরুলাম। কোথায় সেই জেলে দু’টোকেও আজ আর দেখছিনা। তবু সমুদ্রের কুল ধরে ঘুরছি, যদি কোন খোঁজ মিলে। সমুদ্রে তখন জোয়ার এসে জলগুলো ফুলে ফুলে তীরে এসে আছরে পরছে। উদ্দমতা-উচ্ছলতা কল কল আরও বেড়েছে। দৌড়ে দৌড়ে জলগুলি তীরে এসে আছড়ে পরছে। কোথায় এই জনহীন সমুদ্রের পাড়ে কোথা থেকে দোলা-কচকে খুঁজে বের করব। আমি কেঁদে ফেললাম, হায় ভগবান; তুমি সহায় হও।

(চলবে———–)

ফেসবুকে লাইক দিন

আমাদের সাইটের কোন বিষয়বস্তু অনুমতি ছাড়া কপি করা দণ্ডনীয় অপরাধ।