আওয়ামীলীগে বিভেদ, বিএনপিতে বিভক্তি

এইচ এম নাহিদ ॥ পূর্বে মেঘনা ও পশ্চিমে তেঁতুলিয়া নদী। আর দক্ষিণ-পশ্চিমে বুড়া গৌরাঙ্গ নদী। উত্তরে লালমোহন উপজেলা। দক্ষিণে রয়েছে অবারিত জলরাশির বঙ্গোপসাগর। দেশের ভৌগলিক অবস্থানের দিক থেকে দেশের সর্ববৃহত্তম একটি সংসদীয় আসন। চরফ্যাশন ও মনপুরা উপজেলা নিয়ে গঠিত ভোলা-৪ জাতীয় সংসদের ১১৮ নং এ আসনটি। ১৯৮২ সালে গঠিত হয়। ১টি পৌরসভা ও ২৫ টি ইউনিয়ন নিয়ে বিস্তৃত। ভোটার সংখ্যা ৩,৬৮,৫৫৩ জন। প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ প্রচুর সম্ভবনাময় একটি অঞ্চল। ১৯৩০ সালের দিকে ব্রিটিশরা এই অঞ্চলটির ৮০ শতাংশ এলাকা পরিকল্পিত ভাবে তৈরী করেছেন। যার উপর ভর করে বর্তমান জনপ্রতিনিধিরা অঞ্চলটিতে অবকাঠামোগত উন্নয়ন করেছেন। ঠিক তেমনি ভাবে উন্নয়নের পাশাপাশি হয়েছে ব্যাপক পরিকল্পিত দুর্নীতি। মহান স্বাধীনতার পর থেকে এ আসনে কোনো দলের একক আধিপত্য ছিল না। ১ বার জাতীয় পার্টি, ৫ বার আওয়ামীলীগ ও ৩ বার বিএনপির সংসদ সদস্য নাজিম উদ্দিন আলম এখান থেকে নির্বাচিত হয়েছেন। ২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনে বিএনপি এই আসনটি হারায়। চরফ্যাশন-মনপুরার মানুষ বিএনপির এই পরাজয়ে তাদের দুঃশাসনের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ায় স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলেছেন।
সুত্রমতে, ২০০১ সালে নাজিম উদ্দিন আলম সংসদ সদস্য হয়ে এলাকায় সা¤্রাজ্যবাদী রাজনীতি ও লুটপাটের রাজত্ব কায়েম করেন। নির্বাচিত হওয়ার পর দীর্ঘ ২ মাস যাবৎ আওয়ামীলীগের কর্মী-সমর্থক বিশেষ করে সংখ্যালঘু পরিবারের উপর নির্যাতন চালায়। যোগাযোগ ব্যবস্থা খারাপ থাকার কারণে অনেক ক্ষেত্রে প্রশাসনের লোকজন এমনকি সংবাদ কর্মীরাও নির্যাতনের সঠিক তথ্য সংগ্রহ করতে পারে নাই। বাড়ীঘর লুটপাট, চাঁদাদাবী এমনকি নারী ধর্ষণের অজস্র ঘটনা ঘটে। এসবের অধিকাংশই পুলিশের নথিভুক্ত হয় নাই। ভুক্তভুগীরা ভয়ে কোন অভিযোগ পর্যন্ত করেন নাই। প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে লোক লজ্জা ও সামাজিকভাবে হেয় হওয়ার ভয়ে পরিবারের মহিলারা ধর্ষিত হওয়ার পরও আইনের আশ্রয় নেয়নি বা বিষয়গুলি গোপন রেখেছেন।
২০০৮ সাল থেকে আসনটি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দখলে। বর্তমান সংসদ চরফ্যাশন উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি আব্দুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকব। তিনি টানা ৩ বার সংসদ থেকে এই আসনটিতে ব্যাপক উন্নয়ন করেছেন। পাশাপাশি তার এত উন্নয়নকে সামনে রেখে তার বিরুদ্ধে ব্যাপক দুর্নীতিরও অভিযোগ রয়েছে। অপরিকল্পিত উন্নয়ন, টেন্ডার বাণিজ্য, কমিশন বাণিজ্যসহ নানান অভিযোগ স্থানীয়দের। তারা বলছেন, দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার কারণে বর্তমান সংসদ ব্যাপক হারে বেপরোয়া হয়েছেন। প্রতিষ্ঠা করেছেন একক আধিপত্ব। তিনি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে সমূলে বিনাশ করে চরফ্যাশন-মনপুরায় একক সা¤্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছেন। তার এহেন মনবঞ্চনায় বঞ্চিত হয়েছেন আওয়ামীলীগের ত্যাগী নেতা-কর্মীদের একাংশ। দীর্ঘ দিনের দলীয় বঞ্চনা ও ক্ষোভ থেকে রুপ নিয়েছে বিভক্তির। এটি আরও প্রকাশ্যে এসেছে আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের অবসরপ্রাপ্ত সচিব এবং ঢাকা অফিসার্স ক্লাবের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক মেজবাহ উদ্দিনের প্রার্থী হওয়ার ঘোষণায়। তাঁর এ ঘোষণায় নতুন করে হিসাব করেছেন চরফ্যাশন ও মনপুরা উপজেলার স্থানীয় রাজনৈতিক কর্মী ও সাধারণ ভোটাররা। তারা বলছেন, বিএনপি রাজনৈতিক মাঠে ফাঁকা থাকায় এমনটা হয়েছে।
সুত্র বলছে, আওয়ামীলীগের শীর্ষ মহল এমপি জ্যাকবের এই উত্থানকে ভালভাবে গ্রহন করেননি। অনেক কিতর্কিত ঘটনায় তার উপর হাই কমান্ড ক্ষিপ্ত। সেই দ্বারাবাহিকতায় দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে গ্রীণ সিগনাল পেয়ে মাঠে নেমেছেন অবসরপ্রাপ্ত সচিব মেজবাহ উদ্দিন। এবার বর্তমান সংসদ আব্দুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকবের বিপরীতে চরফ্যাশন-মনপুরা থেকে তিনি মনোনয়ন চাইবেন।
এ দিকে দলীয় কোন্দলের কারণে সুবিধাজনক অবস্থানে নেই বিএনপি। দীর্ঘ দিন আসনটিতে সাংগঠনিক কার্যক্রম স্থবির হয়ে আছে। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সংগঠনটি একাধিক ধারায় বিভক্ত হয়েছে। সাধারণ কর্মী সমর্থকরা বলছেন, চরফ্যাশন-মনপুরায় বিএনপি নিজেদের কোন্দল মেটাতে না পারলে আগামী নির্বাচনে ঝুঁকির মধ্যে থাকবে। এই আসনটি থেকে দলটির মনোনয়ন চাইবেন সাবেক সংসদ নাজিম উদ্দিন আলম, তাঁর বিপরীতে মনোনয়ন চাইবেন বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির নির্বাহী সদস্য নুরুল ইসলাম নয়ন। এছাড়াও বিএনপি থেকে মনোনয়ন চাইবেন আইনজীবী মো. ছিদ্দিকুল্লাহ মিয়া, ব্যবসায়ী লায়ন নজরুল ইসলাম চৌধুরী।
জাতীয় পার্টি থেকে কেফায়েত উল্লাহ নজীব, চরফ্যাশন উপজেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি মনিরুজ্জামান শহীদ, আব্দুল মান্নান, মফিজ মিয়া ও ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন থেকে মোঃ আলাউদ্দিন হাজি, এ্যাডভোকেট মাওলানা মহিবুল্লাহ মিয়া এবার এ আসনে মনোনয়ন চাইবেন।
জেলার ৪ টি আসনের সার্বিক বিষয় নিয়ে কথা হয় জেলা আওয়ামীলীগের যুগ্ম সম্পাদক এনামুল হক আরজু বলেন, ভোলার ৪টি আসনই আওয়ামীলীগের ঘাটি। এখানে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে যা বিএনপি জামায়াতের দুঃশাসনের আমলে কিউ চিন্তাও করতে পারেনি। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ভোলার সব কটি আসনেই আওয়ামীলীগ বিপুল ভোটে বিজয়ী হবেন। নেত্রী যাকে মনোনয়ন দিবেন আমরা তাকে বিজয়ী করার জন্য কাজ করবো। কিছু ভুল বুঝাবুঝি থাকতে পারে তবে তা সমাধান হয়ে যাবে।
এক প্রশ্নের জবাবে আরজু বলেন, জাতীয় নেতা তোফায়েল আহামেদ’র এই আসনে কোন বিভক্তি নেই। যারা করার চেষ্টা করবে বুঝতে হবে তাদের কোন অস্থিত্ব নেই। যতদিন তোফায়েল আহমেদ নিঃশ্বাস নিবেন ততদিন ভোলায় তার বিকল্প চিন্তা করা বোকামি। এবারও তিনিই নির্বাচন করবেন এবং বিশাল ব্যাবধানে বিজয়ী হবেন।
জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি সভাপতি ফজলুল কাদের মজনু মোল্লা বলেন, সাংগঠনিক ভাবে ভোলায় আওয়ামীলীগ অনেক শক্তিশালী। একটি বড় দলে কিছু মত পার্থক্য থাকবে এটাই স্বাভাবিক দলের বৃহত্তর স্বার্থে আবার এটা সমাধানও হয়ে যাবে। আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে নেত্রী যাকে মনোনয়ন দিবেন তাকেই ভোলার মানুষ নির্বাচিত করবেন। তিনি বলেন, শ্রদ্বেয় নেতা তোফায়েল আহমেদ’র এখন বয়স হয়েছে। নির্বাচন করার শক্তি তিনি হারিয়ে ফেলেছেন। তাই আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে আমি নেত্রীর কাছে মনোনয়ন চাইবো। ইনশায়াল্লাহ নেত্রী আমাকে খালি হাতে ফিরাবেন না।
এক প্রশ্নের জবাবে মজনু বলেন, বিএনপি আন্দোলন করে অন্যায় আবদার কখনো পূরণ করতে পারবেনা। আন্দোলন করার জন্য যেই ধরনের পলিটিক্যাল মুভমেন্ট দরকার সেটার অভিজ্ঞতা বিএনপির নেই। এই ধরনের আন্দোলন একমাত্র আওয়ামীলীগের আছে। তাছাড়া যাদের কোন জনসমর্থন নাই তারা কি ভাবে দাবী আদায় করবে। তাদের মুল বিষয় নির্বাচন নয়, টাকা কামানোর ধান্ধা, লন্ডন থেকে বসে রাজনীতি করা আর দেশে বসে রাজনীতি করা এক নয়। গত নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে নমীনেশন বাণিজ্য হয়েছে এবারও এর ব্যাতিক্রম হবেনা। এই অজুহাতে ভোলায় আন্দোলনের নামে কোন বিশৃঙ্খলা হলে তার কঠিন জবাব দেয়া হবে।
জেলা বিএনপির আহবায়ক গোলাম নবী আলমগীর ও সদস্য সচীব রাইসুল আলম একই সুরে বলেন, ভোলা জেলা বিএনপি সকল ভুল বুঝাবুঝি ভুলে জেলার ৪টি আসনেই বিএনপি এখন ঐক্যবদ্ধ আছে। শেখ হাসিনার পতন নিশ্চিত না করা পর্যন্ত বিএনপির নেতা-কর্মীরা ঘরে ফিরবেনা। দাবী আদায় হলে বিএনপি নির্বাচনে যাবে। সেই ক্ষেত্রে দলের হাইকমান্ড যাকে মনোনয়ন দিবেন বিএনপি তার পক্ষেই কাজ করবে।
রাইসুল আলম এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ভোলা সদর আসনে গোলাম নবী আলমগীর আমাদের মনোনীত প্রার্থী। যদি গিয়াস উদ্দিন আল মামুন, বা জোট থেকে আন্দালিব রহমান পার্থকেও হাইকমান্ড মনোনয়ন দেয় সেই ক্ষেত্রেও জেলা বিএনপি মনোনয়ন প্রাপ্ত প্রার্থীর পক্ষেই কাজ করবে। বিএনপির রাজনীতিতে দলের সিদ্ধান্তের বাহিরে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই।

ফেসবুকে লাইক দিন

আমাদের সাইটের কোন বিষয়বস্তু অনুমতি ছাড়া কপি করা দণ্ডনীয় অপরাধ।