ভেঙ্গে পড়ছে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা

চীনের উহান থেকে জন্ম নেওয়া কভিড-১৯ বিশ্বের ৩৯ লক্ষাধিক মানুষের জীবন কেড়ে নিয়েছে এবং ১৯ কোটি মানুষকে আক্রান্ত করতে পারলেও শিক্ষাব্যবস্থাকে স্থবির করতে পারেনি। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ নিষ্ঠুর ভয়াবহতায় রূপ নিলেও পৃথিবীর কোনো দেশে শিক্ষাব্যবস্থা থেমে নেই। শুধুমাত্র দক্ষিণ এশিয়ার বাংলাদেশসহ কয়েকটি দেশে থেমে আছে শিক্ষার চাকা। সেভ দ্যা চিলড্রেন এর মতে, করোনা ভাইরাস একদিন চলে যাবে ঠিকই কিন্তু বিশ্বের ৯৭ লাখ শিশু আর কখনো স্কুলে ফিরবে না। সে হিসেবে বলা যায়, সহসাই যাচ্ছে না করোনা। তাই করোনাকে সঙ্গি করেই ঢেলে সাজাতে হবে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে। এক্ষেত্রে শিক্ষা নীতিনির্ধারণী সংশ্লিষ্টদের যথাশীঘ্র উদ্ভাবনী উদ্যোগ নেয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অটো প্রমোশন ও অটো পাস আগামী প্রজন্মের উপর অভিশাপ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। গুণগত মানের শিক্ষাবিহীন আগামী প্রজন্ম অথর্ব জাতিতে পরিণত হচ্ছে। অটো প্রমোশন ও পাস করা শিক্ষার্থীরাই আগামীতে দেশ পরিচালনার মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করবে। যেকোনো জাতির জন্য মানসম্মত শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। কোনো জাতিকে ধ্বংস করতে সেই জাতির শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস করে দিলেই যথেষ্ট। সেহেতু দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ভেঙে পড়ার অর্থ হলো আমাদের উন্নয়ন অগ্রগতির স্থবিরতা। কোভিড-১৯ কালীন সময়ে দেশের শিল্প বাণিজ্য কারখানা চালু থাকলেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা। করোনা মহামারির কারণে বিগত ১৫ মাস ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ এতে শিক্ষার বিভিন্ন স্তরের প্রায় ৪ কোটি শিক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
শিক্ষক অভিভাবকরা বলেছেন, করোনা-পূর্ববর্তী সময়ে শিক্ষাব্যবস্থার যে অগ্রগতি হয়েছিল তা পুনরুজ্জীবিত করতে নজর দেয়া খুব জরুরি। কোভিড কালীন অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে মধ্য-আয়ের বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতেই শিক্ষার চাকা সচল রাখা জরুরি। আর শিক্ষার চাকা সচল রাখতে শিক্ষকদের জীবন মানের উন্নয়নে নজর দিতে হবে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সহ সংশ্লিষ্টদের। শিক্ষকদেরকে শুধুমাত্র কালির আঁচড়ে আর বক্তব্য বিবৃতিতে প্রশংসা করলে হবেনা, তাঁদের প্রাপ্য সম্মানটুকু ও বৈষম্য দূরীকরণ করা খুব প্রয়োজন। বিগত ১৫ মাসে করোনা মহামারি আমাদের অভিভাবককে বুঝিয়ে দিয়েছে, শিক্ষাক্ষেত্রে শিক্ষকদের গুরুত্ব কতটুকু। লক-ডাউনের সময় যেসব অভিভাবকরা নিজেদের সন্তানদের গৃহশিক্ষা দিয়েছেন, তাঁরা নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন যে, শিক্ষকদের সম্মানজনক বেতন ভাতা ও বৈষম্য দূরীকরণ কতটা জরুরি। তাদের প্রাপ্য সম্মান মর্যাদা ও পিছনের অভাব দূর করা না হলে শিক্ষার মানোন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হতে বাধ্য। বিশ্বের বিভিন্ন দেশগুলো করোনা কালীন সময়ে তাদের শিক্ষকদের জন্য প্রণোদনা হিসেবে বাজেটে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার অর্থ বরাদ্দ রেখেছে। অথচ আমাদের দেশের ৬ লক্ষ কোটি টাকার বাজেটে শিক্ষকদের জীবন মানের উন্নয়নে কোন বরাদ্দ রাখা হয়নি। এতদসত্ত্বেও বাংলাদেশ বেসরকারি শিক্ষক কর্মচারী ফোরাম সহ শিক্ষক সংগঠনগুলো মাননীয় মন্ত্রী ও এমপিদের কাছে অনেক দেনদরবার করে এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের বিদ্যমান বৈষম্য দূরীকরণ ও এমপিওভুক্ত শিক্ষা জাতীয়করণের দাবি সংসদে উত্থাপন করা সত্ত্বেও তা উপেক্ষিত হয়েছে। এবারো এমপিওভুক্ত শিক্ষকগণ নামমাত্র ২৫% উৎসব ভাতা নিয়েই একটি ঈদ উৎসব পালন করতে হচ্ছে। পেশাগত বৈষম্যের কারণেই শিক্ষার মানোন্নয়নে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। করোনা পরবর্তী দেশের শিক্ষাব্যবস্থা পুনরুদ্ধার এবং ঝরেপড়া শিক্ষার্থীদের পুনরায় শিক্ষার মূল শ্রোতধারায় ফিরিয়ে আনতে এই শিক্ষকদেরকে অনন্য ভূমিকা পালন করতে হবে। সেহেতু এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বৈষম্য দূরীকরণের যৌক্তিক দাবির প্রতি সম্মান জানিয়ে বৈষম্য দূরীকরণ ও এমপিওভুক্ত শিক্ষা জাতীয়করণ ঘোষণা দিয়ে অতিসত্বর তা কার্যকর করার জোর দাবি জানাচ্ছি।
দেশের শিক্ষাব্যবস্থার মূল সমস্যা শিক্ষার মান, যা করোনা মহামারীর পূর্বেও কাঙ্খিত পর্যায়ে ছিল না। এমনকি দেশের বিদ্যমান শিক্ষাব্যবস্থা বঙ্গোপসাগরে নিক্ষেপ করার কথা আমরা মন্ত্রীর বক্তব্যে শুনতে পেয়েছি। বিদ্যমান শিক্ষাব্যবস্থার উপর রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ, শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক এবং শিক্ষানুরাগী কেউই সন্তুষ্ট নন। কারণ শিক্ষাশেষে একজন শিক্ষার্থীর যে দক্ষতা, যোগ্যতা অর্জন করার কথা, তা শিক্ষার্থীরা অর্জন করতে পারছিলো না। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, অনুপাত, ধনী গরীবের বৈষম্য এবং শিক্ষকদের পেশার প্রতি উদাসীনতা এর পেছনের কারণ বলে মনে করি।
করোনা মহামারী কালীন সময়ে কী পরিমাণ শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে তা জরিপ করা উচিত। অনেক শিক্ষার্থী স্কুলের রাস্তা এমনকি শিক্ষকদের নামধাম পর্যন্ত ভুলে গেছে।
করোনা পরবর্তী সময়ে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরের ঝরে পড়া রোধ মোকাবেলা ভিন্নমাত্রার ও জটিল হয়ে উঠবে। ২০১৯ সালে মাধ্যমিকে ঝরে পড়ার হার প্রতি পাঁচজনে দুইজন ছিল, করোনা পরবর্তী এ হার প্রায় দ্বিগুণ হয়ে দাঁড়বে। মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমে শিক্ষার্থীদের সংশ্লিষ্টতার হার বাস্তবতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। মহামারির সময়ে দূরশিক্ষণ অনলাইন শিক্ষা খুব কমসংখ্যক শিক্ষার্থীরাই উপকৃত হয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসার পর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হলেও অনেকে আর হয়তো বিদ্যালয়ে ফিরে আসবে না। ঝরেপড়া শিক্ষার্থীদের ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া এবং বিদ্যালয়ে ধরে রাখার জন্য এখন-ই কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। গতানুগতিক শিক্ষাদান পদ্ধতির পরিবর্তন ও শিক্ষাব্যবস্থার পদ্ধতিগত পরিবর্তন আনতেই হবে। শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন পদ্ধতির উদ্ভাবন করতে হবে। সময়ের প্রয়োজনেই শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা, উদ্ভাবন এবং মানবিক গুণাবলী অর্জন করতে হবে। এটা প্রমাণিত আমাদের বিদ্যমান শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিকুল পরিস্থিতি মোকাবেলায় মোটেও সহনীয় নয়। তাই আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় যুক্ত করতে হবে শিক্ষা টিভি, তথ্য প্রযুক্তি নির্ভর শিক্ষাদান পদ্ধতির। নতুন মূল্যায়ন পদ্ধতির উদ্ভাবন ও শিক্ষকদের প্রয়োগমুখী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা খুবই প্রয়োজন।
ঈদের পূর্বে এমপিওভুক্ত শিক্ষক কর্মচারীদের পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতার দাবি সরকারের সামর্থ্যের বাইরে ছিল বলে মনে করি না। বিগত অর্থ বছরে শিক্ষা খাতে বরাদ্দকৃত অব্যবহৃত ও উদ্বৃত্ত অর্থ থেকেও এমপিওভুক্ত শিক্ষক কর্মচারীদের পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা দেয়া সম্ভব ছিল। আন্তরিকতা ও সদিচ্ছা থাকলে এই যৎসামান্য অর্থ শিক্ষার পেছনে ব্যয় করা হলে দেশ দেউলিয়া হয়ে যেতো না। এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বেতন-ভাতা সামাজিক বাস্তবতার সাথে মোটেও সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। করোনা পরবর্তী সময়ে শিক্ষার ধারাবাহিকতা রক্ষায় অতিসত্বর শিক্ষকদের বিদ্যমান বৈষম্য দূরীকরণের জোর দাবি জানাচ্ছি।

মোঃ সাইদুল হাসান সেলিম
সভাপতি
বাংলাদেশ বেসরকারি শিক্ষক কর্মচারী ফোরাম।

ফেসবুকে লাইক দিন

আমাদের সাইটের কোন বিষয়বস্তু অনুমতি ছাড়া কপি করা দণ্ডনীয় অপরাধ।