জীবনের ডায়েরী থেকে গল্প সমগ্র : পর্ব-৫৯

[ ড. টি. এন. রশীদ ]
(গত পর্বের পর) : ওয়াসাগা সমুদ্র লেক, জরিন ও বিজন : স্ত্রী মারা যাবার পর বিজন ছেলেমেয়ে দু’টোকে নিয়ে কোথায় যেন নিরুদ্দেশ হলেন। কোথায় গেলেন, ক’দিনের জন্য গেলেন, কবে ফিরবেন, আর ওসাগাতে ফিরবেন কিনা তাও বলে গেলেনা না। সকলেই শুনল বিজন, অনিতা, সুনীলকে কোথায় যেন একটু নিঃশ্বাস ফেলতে গেল। আর লোকটার দোষই বা দেই কি করে, বল? সেই যে জরিন ঢাকা ভার্সিটিতে লেখাপড়া করার সময়ে দেখে ভাল লেগেছিল, মন অগোচরে ভালো বেসেছিল। সে কথা বন্ধুবান্ধব, কাকেও মনের ভুলে জানতে দেন নি। এমন কি মা বাবাকেও না। তারপর ভার্সিটির এক অনুষ্ঠানে জরিন রবী ঠাকুরের পূজারিণী নৃত্যনাট্যে পূজারিনীর অংশে অভিনয় নৃত্যে নৃত্যনাট্য নাচ নেচেছিল।
সেদিন যেন বিজন মন্ত্র মুগ্ধের মত জরিনকে তার আরো… আরো ভাল লেগেছিল। তারপর সে জরিনকে পাবার জন্য উন্মুখ হয়ে উঠছিল। তারপর বিজন চাকরী নিয়ে নর্থ অন্টরিউ ভার্সিটিতে চলে আসে। দিন, বছর, সময় পেরিয়ে যায়। বিজন মাঝে মধ্যে দেশে যায়। শুনলো জরিন ঢাকা ভার্সিটিতে এম.এসসিতে ফাস্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়েছে। একটা স্কলার শিপ পেল ম্যাাগগিল ভার্সিটিতে। জরিনের বাবা নেই মা বিধবা। অনেকগুলো ভাইবোন নিয়ে সংসার সংগ্রামে বিব্রত। তবুও বিজন মনে সাহস নিয়ে জরিনের কাছে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাল। জরিন মায়ের কাছে তার কথা জানাল। মা এ প্রস্তাব অতি সহজেই মেনে নিল।
তারপর একদিন তাদের ঢাকার বাড়ীতে বিয়ের ডামাডোল বেজে উঠল। তখন বিজন ওসাগাতে চাকুরী করত। বিয়ের পরপরই জরিনকে নিয়ে এল ওসাগাতে। নির্জন সমুদ্রের উচ্ছাস, আর বাঁধভাঙ্গা তাদের যৌবনের উচ্ছাস বুঝি এরকমই উদ্দাম উত্তর তরঙ্গমালার মত ছিল। এক দিকে ঢেউ খেলানো পাহাড়ের দৃঢ় বাঁধন কালো মেঘের মত ছেয়ে আছে। আর একদিকে ছল ছল কল কল উদ্দাম গতিতে জলগুলো নেচে নেচে ধেয়ে আসচে। ওহ সেকি গর্জন। সমুদ্র নিজের গর্জন যদি নিজে কানে শুনত তাহলে বোধহয় সে এত গর্জন করে নিজের শান্তি বা অন্যের শান্তি ভঙ্গ করত না। জরিন তখন ম্যাগগিলে পড়ছিলো, দু’বছরেই এমএসএস শেষ হলো। এর মাঝেই অনিতা এলো। সুন্দর তাদের মত টুকটুকে দেখতে। তাকেই ঘিরে চলছিলো তাদের জীবনের স্বপ্ন। কিন্তু দেখা গেল অনিতা যতই বড় হচ্ছে ততই বিকলাঙ্গের রূপরেখা প্রতিফলিত হচ্ছে। তবুও বিজন জরিন স্বপ্ন দেখে সুন্দর এক খানা সংসার প্রতিষ্ঠার। অনিতা প্রায়ই চোখ বড় বড় করে ফিট হয়ে যায়। খাওয়া, দাওয়া ছেড়ে বিজন, জরিন ডাক্তার হাসপাতালে ছুটাছুটি করে। বড় বড় ডাক্তার মন্ট্রিল, টরেন্টো, ওসাগা এসব নগরীর সুচিকিৎসায়ও অনিতাকে সুস্থতার দিকে তেমন কোন উন্নতির আশা দেখা যায় না।
অনিতা দিন দিন বড় হতে থাকে। দেখা যায় অনিতা দুল দুল করে হাঁটে। আর কি কথা বলে তা কেউ অবলোকন করতে পারে না। জরিন তা বন্ধু-বান্ধবীকে বুঝিয়ে তুষ্টি করে। এরই মাঝে অনিতার একটি ভাই এলো অনিরুদ্ধ। ছেলেটা একদম বিজনের নাক, মুখ, চোখ। একদম বিজনের মুখখানা কেটে এনে বসিয়ে দিয়েছে। ছেলেটাকে দেখলে সুস্থ সবল বলে মনে হয়। অদূর ভবিষ্যতে জ্ঞানী হবে বললে বোধহয় ভুল হবে না। জবিনের অনেক গুণ ছিল- ভাল নাচ, গান, ভাল পড়াশুনায় শেষ পর্যন্ত এম.এস.এস. করে আর এগুতে পারে নি। মন্ট্রিল ম্যাগগিল থেকে টরনেডো ওসাগাতে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। সেখানে রান্নায় যথেষ্ট সুনাম অর্জন করে সে। এত ভাল চাইনিজ পাকাতে পারত। যা কেউ একবার খেলে চায়নিজ রেস্টুরেন্টগুলো হার মেনে যাবে।
অদ্ভুত মিষ্টি মধুর স্নিগ্ধ আলাপ। অনিতা এখনও কথা যে কি বলে, বুঝা মুশকিল। প্রায় নয়-দশ বছর বয়স হবে। তা কেউ উপলব্ধি করতে পারে নি। কিন্তু জরিন এমন সুন্দর করে আপনাদের বুঝিয়ে দিবেন- আপনারা বিস্মিত হয়ে জরিনের বা অনিতার মায়ের মুখের দিকে অপলক নয়নে চেয়ে থাকবেন। জীবনকে জরিন প্রেম ভালবাসা, মায়া-মমতায় এ সংসারে ছায়া দিয়ে মায়া দিয়ে সোহাগ দিয়ে আদর আপ্যায়নে বেষ্টিত করে রেখেছিল। কিন্তু একদিন দেখা গেল ছোট ছেলেটা হাফানীতে আক্রান্ত। কিছুদিন বিজন ছেলেটাকে নিয়ে টরেন্টোয় জেনারেল হাসপাতালে ছিলো। সবই ভাগ্যের লিখন, মানুষ কত সাধ করে বীজ বোনে ভবিষ্যতের আশায়। সব বীজ যদি অঙ্কুরেই নষ্ট হয়ে যায় তার আর বলার কিছু থাকে না। ছেলে আর মেয়েটাকে নিয়ে তাদের চেষ্টা, পরিশ্রমের শেষ নেই। মাস যায়,… বছর যায়… এক যুগও বোধহয় গেল। কত কথা, কত স্মৃতি, কত স্বপ্ন, কত স্বাধ, সব যেন আল্লাহ বিফলে নিয়ে গেলেন। একদিন দেখা গেল জরিন নিজেই ক্লান্ত, ক্যান্সারে আক্রান্ত হতে শয্যা নিল। কত আশা সাধ জরিনের বেঁচে থাকার। ক্যান্সার শুনে টরেন্টোর বন্ধু-বান্ধবীদের নানা রকম সুখাদ্য রান্না করে পিকনিক-এর আয়োজন করে খাইয়ে দিল। অনেকেই প্রবল আপত্তি তুলল, না, না আপনার শরীর খারাপ। কি প্রয়োজন খাবার দাবার, আমরা এমনিতে খুশি আছি।
জরিন বলল, আমার অসুখের কথা শুনেছ? আমি এত ঘাবড়াবার মানুষ নই। রোগ আল্লাহ দিয়েছেন বেঁচে থাকার এবং মেরে ফেলার তিনিই মালিক। দু’টো বছর ভুগে ভুগে টরেন্টে জেনারেল হাসপাতালে জরিন দিন দিন পাট কাঠির মত হয়ে গেল। তবুও বিজনকে আশ্বাস দিয়ে অভয় দিয়ে সান্ত¡না দিয়ে বুঝ দিয়ে ছেলে মেয়ে দু’টোকে সামনে রেখে মনোবল এনে দিয়েছে। কখনো যেন বিজন ভেঙ্গে না পড়ে সতর্ক দৃষ্টি রেখেছে। নিজের হাজারো যন্ত্রণা বিজনকে বুঝতে দেয়নি। পিছনের যৌবনের রঙ্গিন স্বপ্নে বিজনকে সব সময় রাঙ্গিয়ে রাখত। পবিত্র আল-কুরআনের বাণী কুলু নাফসুন জায়েকাতুল মাউত, (প্রত্যেক প্রাণীই মরনশীল) একদিন মরন এসে জরিনের শিয়রে দাঁড়াল তাকে নিয়ে যাবার জন্য বিকেলে দুপুরে, সকালে সব সময় “বিজন” কখন অনিরুদ্ধ অনিতাকে নিয়ে কখনো একা জরিনের রোগ ক্লান্ত শিয়রে দাঁড়াত। আজ বিকেলে এসে ছিল জরিন কাপা কাপা হাতখানা তুলে বিজনকে স্পর্শ করে বলেছিল, দেখ আমি অতি তাড়া তাড়ি সুস্থ হয়ে উঠব। তুমি ভেবনা বিজন দুঃখের হাসি হেসে ছিল।
মনে মনে বলল, হায়রে জরিন তুমি চলে যাচ্ছ আমি দেখছি। তবুও আমায় তুমি মিথ্যে সান্ত¡না দিচ্ছ। জরিন বিছানার সাথে একদম মিশে গেছে জীর্ণ শীর্ন হাত খানা দিয়ে মাঝে মধ্যে বিজনকে স্পর্শ করে বলত, আমি শিঘ্রই সেরে উঠব। বিজনের ঠোঁটে অবিশ্বাসের মৃদ হাসি চোখে জল। সে দিন সন্ধ্যায় ও বিজন জরিনকে পানি খাইয়ে দিয়ে এল, গায়ের চাদরটা একটু টেনে দিল। ছেলে মেয়েটা ভাল আছে জানাল। কমলার কোস খুলে মুখে দিল, আঙ্গুর ছিড়ে জরিনকে খাইয়ে দিল।
শেষ রাতের দিকে সিষ্টার দেখতে এসে দেখতে পেল জরিন শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করে এ পৃথিবীর অনেক উর্ধ্বে চলে গেছে। সিষ্টার বিজনকে ফোন করে জানাল, বিজন হতভম্বের মত শুনল। জানত জরিন চলে যাবে। তাকে আর ধরে রাখা যাবে না। এ রোগ থেকে মানুষের মুক্তি নেই। তবুও যদি বেঁচে ওঠে এই ক্ষীণ আশাটুকু তাকে জিইয়ে রেখেছিল। বিজন কাঁদল না। কত কান্না তার বুকে পাথর হয়ে চেপে বসে আছে। কত নিশুতি। রাতে আকাশের চাদের দিকে চেয়ে পাহাড়ের নির্জনতার দিকে চেয়ে বুক তার হাহাকার করে এত নির্জন কেন? এ পাহাড় এত উচ্ছল কেন? এ সমুদ্র এই ওসাগা নিরব কেন?
কত মন দেওয়া নেওয়ার পালা চলত জরিনের সাথে ওসাগার উদ্দমতার মাঝে। অনিতা ও তেমনি কিছু বোঝে না আল্লাহ তাকে বুঝবার মত মাথায় কিছুই দেয়নি। অবুঝ অনুরুদ্ধ বুঝবার মত ওর জ্ঞান হয় নি। অনিতার এক খালা বোনকে দেখা শুনা করত। এক মামা ছিল দূর সম্পর্কের তারাই ডেড বডি বাংলাদেশে নিয়ে গেল। আর এখানে টরেন্টের বন্ধু বান্দবরা ভেঙ্গে পড়ল সহানুভূতি সমবেদনা জানাবার জন্য। প্রচলন অনুযায়ী মৃত্যুর তিন দিন পর কুলখানিও করল প্রতিবেশী ও বন্ধুবান্ধবরা। প্রত্যেক বাড়ী বাড়ী থেকে রান্না-বান্না করে পাঠাল। অন্তরঙ্গতা ও আস্তরকিতার কোন ত্রুটি ছিল না।
কিন্তু বিজনের মনে কিছুই না পাওয়ার বেদনার আগুন ধূ ধূ করে জ্বলে উঠল। ভেবেছিল জরিন সারা জীবন কাছে থেকে প্রেম-ভালবাসা, সোহাগ, আদর, অভয় দিয়ে, সান্তনার বাণী দিয়ে তাকে ঘিরে রাখবে। ছেলে-মেয়েটাও তাকে সুখ শাস্তি দিতে পারল না। তারপর জরিনও তাকে ছেড়ে চলে গেল, তারপর হে প্রভু তুমি আর কতদূর … কত বছর… বল? বলে ছেলে ও মেয়েটা কখন কোন যে কোথায় চলে গেল কাকেও বলে গেল না। অনিতার খালা, মামা, বন্ধুরা শুনল বিজন নিরুদ্দেশ… নিরুদ্দেশ… কোথায়? কোথায়? এমেরিকা? কানাডা? ডা? নিউ ইয়র্ক? না, বাংলাদেশে-
গান-
সুখের লাগিয়া এ ঘর বাঁধিনু
অনলে পুড়িয়া গেল।
(চলবে—–)
