জীবনের ডায়েরী থেকে গল্প সমগ্র : পর্ব-৫৮

[ ড. টি. এন. রশীদ ]
(গত পর্বের পর) : মদীনা পথ যাত্রী : অগ্নিঝরা উত্তপ্ত, শুষ্ক, বিশাল মরুভূমির উপর দিয়ে হীন এক পথিক ছোট একটি গাঠরী মাথায় করে চলছে। তার জীবনের বহু দিনে সাধ, বহুদিনের স্বপ্ন মদীনা দেখার জন্য, ছোট একটা গাঠুরী মাথায় করে সে মদীনার পানে এগিয়ে চলেছে, শত অনাহার, দারিদ্র্য ও তার উদ্যমকে আটকিয়ে রাখতে পারে নি। ভাগ্য তাকে নিয়ে যাচ্ছে তার কামনার পথে। পিপাসায় গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে। আশে-পাশে দূর-দূরান্তে কোথায় পানির চিহ্ন নেই। মহান প্রভুর দরবারে তার অনন্ত জিজ্ঞাসা- কোথায়? আর কতদূর? মদীনা বল, রহমান। আমি যে আমার সকল শক্তি দিয়ে সেখানে এগিয়ে যাচ্ছি কিন্তু যদি পানি না পাই, খেতে না পাই, মদীনায় যে আমায় যেতেই হবে। জীবনের বহু দিনের সাধ, স্বপ্ন সঙ্গম তীর্থ মদীনা। কতদিন পেটে আহার পড়েনি, ক্লান্ত অবশ তনু, টেনেটেনে চলছি, আর পারি না প্রভু। আর পারি না। জীর্ণ, শীর্ণ, ক্লান্ত-অবশ তণু উত্তপ্ত মরুভূমির কোলে ঢলে যে গান–
আরে ও দরিয়ার মাঝি মোরে নিয়ে যাও রে মদীনায়।
নাঁচ ছোড় মুসাফির গাফিলতি ছেড়ে।…
সখিরা সরাই নিয়ে মরুভূমিতে পানি আনিতে চলল। সখিদের নুপুরের শব্দে, গানের আওয়াজে আস্তে আস্তে মুসাফিরের ঘুম ভেঙ্গে গেল। মুসাফির সখিদের একটু পানির জন্য প্রার্থনা জানাল। সখিরা পর পুরুষের কথা শুনে লজ্জায় মুখ আড়াল করে রাখল, তবুও মুসাফির বার বার একটু পানির জন্য প্রার্থনা জানাল। মুসাফিরের এই আবেদনে সেরা সখির মন গলে গেল। সে ভাবল, হোক না পর পুরুষ, আমি লজ্জার ভান করত: পর্দার অভিনয় দেখায়ে নিজের ঘরে ফিরে যাব। আর এই উত্তপ্ত মরুভূমিতে মুসাফির পানি বিনে মরে পড়ে থাকবে। না, না, তা হয় না। সে এগিয়ে এসে মুসাফিরের হাতে পানি ঢেলে দিলে সোরাই উপুর করে। মুসাফির পানি পান করে খোদার দরগায় প্রার্থনা জানায়, পানি পান করে আবার ঘুমায়ে পড়ল।
ক্রমে ক্রমে রাতের আধার কেটে গিয়ে ভোরের আলো ফুটে উঠল। মরুভূমির কোন দূর দূরান্তের মসজিদ হতে ভোরের আজান ভেসে এল- আল্লাহু আকবার, আল্লাহ আকবার, আশহাদু আল লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ। মুসাফির আযানের ধ্বনি শুনে ব্যথিত ও দুঃখিত হৃদয় তাড়াতাড়ি উঠে বসল। মদীনা যাওয়ার জন্য। মুসাফিরের মনে বারবার প্রতিধ্বনি হতে লাগল মদীনা যাওয়ার জন্য। তার মনে বারবার প্রতিধ্বনি হতে লাগল আসসালাতু খায়রুম মিনান নাউম…। মুসাফির থেমে নেই, আবার পথ চলতে লাগল, সামনে বিশাল পাহাড়।
হয়ত বা এই পাহাড়ের পরেই হবে মদীনা। পাহাড়ের কাছে যেতে কোন লোকজনের দেখা নেই, নিরব নিস্তব্ধ বিশাল এক পাহাড় বিরান মরুভূমির ন্যায় নিজস্ব সত্ত্বা বহন করে দাঁড়িয়েছে। তবুও ভয় নেই মনের আকাংখা ও বাসনা একমাত্র মদীনা যেখানে চির শায়িত আছেন আমাদের নবী মোহাম্মদ রাসূলুল্লাহ (সঃ)। যার দর্শন সৌভাগ্যের ব্যাপার। যদি তিনি বেঁচে নেই, কিন্তু তার অনাকাংখিত দেহ মোবারক শায়িত আছেন। সেখানে সালাম জানায়ে মনের সাধ ও ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটানো যাবে। কিন্তু পাহাড় এক প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াল। হঠাৎ মনের অগোচরে কে যেন বলতে লাগল পাহাড়ের আঁকা বাকা উঁচুনিচু পথ বেয়ে তোমার গন্তব্যে তুমি চলে যাও।
অদৃশ্যের ঐ সংবাদে মুসাফির ছুটে চললেন মহামন্ত্রের বাঁধনের টানে। দূর থেকে দূরান্তরে সামনের পথ পানে রৌদ্র উজ্জ্বল একটি শহর দেখা যাচ্ছে, যে আশায় বুক বেঁধেছিলাম তা হয়ত বা পূরণ হবে। যেতে যেতে মিলে গেল সে দীর্ঘ প্রতীক্ষার শহর মদীনা, মসজিদে নববী, রাসূল (স)-এর স্মৃতি বিজড়িত এলাকা। দীর্ঘ পথ চলার ক্লান্তির অবসান হয়ে গেল মদীনার পথের সন্ধান মিলে, মুসাফিরের আনন্দের শেষ নেই, নেই কোন শুন্যতা। রাসূল (স)-এর দরগাহে যিয়ারতের সুযোগ পেয়ে আনন্দের কান্নায় অঝোর ধারায় অশ্রু ঝরছে বিধাতার করুণায়। ওহে! রাসুল (স) লও সালাম শাফায়েত করিও সেথায়। তুমি যে মদীনার বুলবুল, তোমাকে চিনিতে করি নি ভুল।
(চলবে——-)
