জীবনের ডায়েরী থেকে গল্প সমগ্র : পর্ব-৫৭

[ ড. টি. এন. রশীদ ]
(গত পর্বের পর) :
নতুনের আগমন (১৩৮৫ বাংলা সন) :
হে নতুন
দেখা দিক আর একবার
জন্মের প্রথম শুভক্ষণে,
১৩৮৫ সাল শনিবার ১লা বৈশাখ। বাংলা নববর্ষ অনেক ঘাত প্রতিঘাতে, দুঃখ-বেদনা, ব্যর্থ সফলতাকে বক্ষে ধারণ করেছিল যে বৎসরটি উহা এখন অতীত, মহাকালের অতল গহ্বরে নিমজ্জিত কালের যাত্রার ধ্বনিতে এখন নতুন বছরের ১৩৮৫ সাল আমাদের দ্বারপ্রান্তে। দিন রাত্রির পরিক্রমণে ঋতু চক্রের আবর্তনে আসে নববর্ষ। অতিক্রান্ত দিনগুলি যত সুন্দর যত বেদনা দায়ক। হোক না কেন উহা অতীত। অতীতের তীর হতে যে করুণ দীর্ঘশ্বাস ভাসিয়া আসে উহা দ্বারা প্রভাবিত হইলে চলিবে না। অনেক দূরের চৈত্র শেষের বেদনা বাঁশী বাজে বনে বনে, তরুলতা ফলেফুলে সাজে বসন্ত। ঐ বিদায় নিল চৈত্র দিনের পাতা ঝরবার পথে। নববর্ষের আগমণী বৈশাখী রুদ্র রাজের রথে।
আসা-যাওয়া পৃথিবীর রীতি। পুরাতন বিদায় নেয়, নতুন আসে। দিনপঞ্জীর হিসেবে চৈত্র বিদায় নেয় আসে বৈশাখ। নতুন বছরের নতুন দিনে অনেক আশা উদ্দীপনা নিয়ে বাংলার মানুষ নতুন বছরকে স্বাগত জানায়। অন্তরের গভীর অন্তস্থল থেকে প্রার্থনা করে আগামী দিনগুলোতে সুখ-শান্তিতে কাটানোর জন্য। সমৃদ্ধি জীবন, উজ্জ্বল সম্ভাবনাময় ভবিষ্যত প্রতিষ্ঠার আশায়। পৃথিবীর সকল কিছু এক সময় বিলীন হয়ে যাবে। তখন মহান স্রষ্টা ছাড়া আর কিছুই থাকবে না। এ কথা সকলেরই জানা ও বিশ্বাস থাকার কথা। তবুও কেন যেন হাজারও মায়া মমতা ঘিরে উদযাপিত হচ্ছে শুভ নববর্ষ ও আগামণী দিনের প্রত্যাশায় কবিতার ছন্দে না বললেই নয়।
নতুন তুমি বুঝি
আজ এলে,
চৈত্রের ঝরা পাতা ঝরে গেলে
তরুমর্মর নব পল্লবে,
বিকশিত তোমার আগমনে।
বনে বনে ফুল ফুটে,
নব কিশলয়ে গন্ধ আগর বাতি জ্বলে,
রূপ ছন্ধার মূর্ছনা জাগে
নুপুর নিক্কন তলে।
ছন্দে ছন্দে তুমি আস
গন্ধে গন্ধে তুমি ভরে দাও
পাপ, অন্যায়, দুঃখ, কষ্ট গ্লানি
নতুন পরশে নতুন করে মুছে নাও।
তোমার আশার আনন্দে,
মাধবী লতায় মাধবী ফুল ফোটে,
কৃষ্ণচূড়া গাছে, কৃষ্ণচূড়া হাসে,
আর আমার মনের ময়ূর নেচে উঠে।
তাই তোমায় আমি স্বাগত জানাই
সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বেলে,
জীবন দুয়ারে আশায় আনন্দে
তুমি বুঝি আজ এলে।
পুরাতন বছরে নিষ্ফল সঞ্চয়ের
বালি ঝেড়ে ফেলে এল নববর্ষ
১লা বৈশাখ, নববর্ষের উৎসবের পথ,
ধরে যাত্রা হলো আর একটা বছর।
পিছনে পড়ে রইল একটা বছরের হাসি, কান্না,
আনন্দ বেদনার স্মৃতি
ভুলে গেছি সকলে
অতীতের সকল রীতি।
পয়লা বৈশাখ নববর্ষ উৎসব উদযাপনের শুরু আজ থেকে নয়। যতদূর জানা যায় মধ্য যুগ থেকে বাংলা নববর্ষ উদযাপনের প্রচলন শুরু হয়েছে। সেই যুগ থেকে গ্রাম বাংলার মানুষ তাদের চাষাবাদ, খাজনা দেওয়া, হিসাব-নিকাশ, জন্ম-মৃত্যুর তালিকা বিয়ের তারিখ নির্ধারণ সব কিছুই পয়লা বৈশাখের বর্ষপঞ্জী অনুসারেই করতেন। বর্তমানে অধিকাংশ ক্ষেত্রে মানুষ বাংলা বর্ষপঞ্জী অনুসরণ করে থাকে। কিন্তু শহরে নববর্ষ আসে দুই বার। একবার অফিসিয়াল আর একবার নন অফিসিয়াল। অফিসিয়াল নববর্ষ পয়লা জানুয়ারীতে। ঐদিন থেকে স্কুল, কলেজ, অফিস আদালতে সব কিছুর বর্ষ শুরু হয়।
বিত্তবান আধুনিক নাগরিকরা একত্রিশে ডিসেম্বর রাত্রে ঘটা করে বর্ষ বিদায় দেন। হোটেলে, ক্লাবে, খানাপিনার আয়োজন করে। রাত বারটায় বর্ষ বিদায় এবং নববর্ষ আহ্বান করেন। তারপর তাদের বছর এগিয়ে চলে ইংরেজী ক্যালেন্ডারে পা ফেলে। নন অফিসিয়াল নববর্ষ আসে পয়লা বৈশাখ। এতে বর্ষ বিদায়ের কোন ভূমিকা নেই। চৈত্র সংক্রান্তি বলে একটা অনুষ্ঠান আছে। পয়লা বৈশাখ আসে ভোরের সূর্যের আলোর রথে চড়ে। উৎসব প্রিয় সংস্কৃতিমনা বাঙ্গালীরা ঐ দিনটিতে ষোল আনা বাঙ্গালী হয়ে উঠেন। ঐ দিনটিতে পোষাকে প্রসাধনে, খাওয়ায়, সংস্কৃতিক উৎসবে বাঙ্গালী সংস্কৃতির সবটুকু অনুসরণ করে। আর নতুনের অগ্র যাত্রায় মানুষ পুরাতনকে ভুলে যায়। খুঁজে নেয় নতুন আলোর অনন্য এক দিগন্ত। এরই মাঝে গেয়ে যায় নতুনের জয়গান।
হে নতুন তুমি বুঝি আজ এলে…
(চলবে————–)।
