জীবনের ডায়েরী থেকে গল্প সমগ্র : পর্ব-৫২

[ ড. টি. এন. রশীদ ]
(গত পর্বের পর) : আদর করতেন, খাওয়াতেন, ছোট ছেলেমেয়ে দু’টোকে দুধ খাওয়াতেন, ঘুম পাড়াতেন। ঘুমের মাঝে কচি সুন্দর দুটো মুখ তাকে মায়ায় জড়িয়ে ফেলছিল। এতে ডাক্তার সাহেবের ভাই-বোনের বড় আপত্তি ছিল। সাত দিনের মধ্যে মম মেয়েটার মাথা ফেটে রক্তে ঘর ভরে গেল, মুশুটা দিন দিন শুকিয়ে যেতে লাগল। খাজা সাহেবের বাড়ী যেতে ওদের নিষেধ করে দেওয়া হল। তবুও দুপুর বেলা ওদের ফুফু ঘুমিয়ে থাকত, তখন গিয়ে দরজার কড়া নাড়ত আর বলত, জায়ী জায়ী। জাহিদ খাজা সাহেবের এক ছেলের নাম। মম তাকে জায়ী বলে ডাকত। যখন মমদের বাড়ীতে খুব কাজের চাপ বৃদ্ধি পেত, তখন ডাক্তার সাহেবের বোনটা ছোট ছেলেমেয়ে দু’টোকে পাঠিয়ে দিত মিসেস খাজার কাছে। মিসেস খাজা তাদেরকে সাদরে গ্রহণ করত। কখন কোন বিরক্ত বোধ করেন নি। ডাক্তার সাহেব টাকা পয়সা ব্যয় করতেন ঠিকই, কিন্তু ছেলে মেয়েদের যতœ নিতেন কম।
মিস্টার খাজা এরই মাঝে সিলেট বদলী হয়ে গেল। সিলেট থেকে মাঝে মাঝে গভর্নমেন্টের সাক্ষী উপলক্ষ্যে তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় যেতেন। তখন মম ও মুশুকে দেখার জন্য তাদের বাড়ীতে যেতেন। যাওয়ার সময় ওদের জন্য মজার খাবার নিয়ে যেতেন। ছেলেমেয়েকে আদর করে গভীর স্নেহে কাছে ডাকতেন। দু’টোকে দু’হাতে কোলে তুলে নিতেন। বলতেন, বলত আমি কে? মম বলত, চাচা, মুশু বলত- তাতা। ছোট মুখের আধো আধো কথাগুলো খাজা সাহেবের বুকে স্নেহের সমুদ্র তুলে দিত। নিজে পিতা ছিলেন বলে ছেলে মেয়েদের মর্ম বুঝতেন। বাড়ীর অন্যান্য সকল ছেলে মেয়েদের পড়াশুনার খবর নিতেন। তারপর নিজে নিজে ভাবতেন, কি যেন বলতে চাইতেন, কিন্তু বলতে পারতেন না। মম মুশুকে আবার কাছে ডাকতেন, বলতেন, আমি আসি চাচা। তোমাদের জন্য লজেন্স আনতে যাচ্ছি। ওরা খুশি খুশি মুখে হাত গুটিয়ে দেখাত এতগুলো আনবা চাচা।
খাজা সাহেব রিক্সায় উঠে রেল স্টেশনের দিকে আসতে আসতে ডাক্তার সাহেবের ছবিটা তার চোখের সামনে সিনেমার ছবির মত ভেসে উঠত। এত বড় লব্ধ প্রতিষ্ঠিত ডাক্তার, যার নাম শুনে লোক ধন্য ধন্য করত, যার চিকিৎসায় মানুষের রোগমুক্তি হত, যার টাকা পয়সার কমতি ছিল না, তার ছেলে মেয়েদের আজ এই করুণ পরিস্থিতি। সিলেট গিয়ে মিসেস খাজার কাছে সব বলত। মিসেস খাজা এসব শুনলে তার চোখ ভরে পানি আসত। নিজের ছেলেমেয়েরা দুঃখ প্রকাশ করত। খাজা সাহেবের বাড়ীটা ছিল পাহাড়ের উঁচু টিলার উপর। দু’পাশে অসংখ্য বেলি ফুলের ঝাড়, হাস্নাহেনার সারি, কৃষ্ণচূড়ার কেয়ারী আর ছিল অসংখ্য বক্ত গোলাপের গাছ। সিলেটে এত সুন্দর মনোরম বাংলো খুব কম লোকেরই ছিল। সে দিনটির কথা মিসেস খাজার চির জীবন মনে থাকবে। দিনটা ছিল হয়ত শুভ, কিন্তু আজ মনে হচ্ছে দিনটি ছিল অশুভ।
সেদিন ছিল কোন এক অফিসারের ডিনার পার্টি। অপরূপ করে বাড়ীটাকে সাজিয়ে ছিল। প্রত্যেকটি হাস্নাহেনা গাছে দিয়েছিল লাল, নীল, বাল্ব। বাংলোর ডিজাইনের আকারে ঝুলিয়েছিল হরেক রকমের বৈদ্যুতিক আলো। সন্ধ্যা প্রদীপের সাথে সাথে আলোগুলো ফিক্ ফিক্ করে হেসে উঠল। আর হেসেছিল সোনার ডালার মত করে শুক্ল পক্ষের সুন্দর চাঁদটা। অসংখ্য অতিথির আগমনে মনোরম ঘর গুলি ভরে গেল। অসংখ্য শাড়ী, চুড়ির রিনিঝিনিতে মনে রঙ্গিন নেশা ধরে গেল। আধো আধো ভাষায় একের প্রতি অপরের প্রীতি সম্ভাষণ চলল বাহিরের ঘরে নানা রকমের মোটা গলার আওয়াজ শোনা গেল। তারা রাজনীতি, সমাজ নীতি, গার্হস্থ্য নীতির বড় বড় কথা বলছে। দেশের উন্নতি, অবনতি যেন তারাই আনতে পারে। এমনি উচ্চাভিলাসী কথা।
মিসেস খাজাও এসে ড্রইং রুমে ভদ্র মহিলাদের সাদর সম্ভাষণ জানিয়ে ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে বসে পড়লেন। সকলের সাথে নানা রকমের আলাপ আলোচনা করলেন। আবার কতক্ষণ শুনলেন, আবার নিস্তব্ধ হয়ে কি যেন ভাবলেন, মুখটা পাশে ফিরিয়ে সকলের অজান্তে অশ্রুভরা চোখ দুটো মুছলেন। আবার মনকে সুস্থ করলেন। বললেন, ভাই মনটা আমার আজ ভাল নয়, আমাদেরই একটি পরিচিত পরিবার ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়…… তার কাহিনী কিছু কিছু বর্ণনা করলেন। তারপর বললেন, তার ছোট ছেলে নাম তার মুশু আজ চিঠি পেলাম পানিতে পড়ে মারা গেছে। ভদ্র মহিলারা কেউ শুনল। কেউ শুনল না। আবার কেউ বাঁকা চোখে দেখে রঙিন গল্প পারলেন। তারা তখন দেখছিলেন তাদের উজ্জল ভবিষ্যতের সুন্দর স্বপ্ন।
মুশুর মত একটি অনাথ শিশুর কথা শোনার সময় কোথায়? অবসরই বা কোথায়? তবুও মুশুর কথা মনে করে মিসেস খাজা অশ্রুভরা চোখ দু’টো মুছলেন। অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে দূরে তারাভরা আকাশের পানে চেয়ে চেয়ে দেখলেন। দেখলেন মুশু যেন এক ঝাক তারা মাঝে দৌড়া দৌড়ি করে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কত হাসি খুশি সে মুখখানা, যেন কোন দুঃখ নেই, ক্লান্তি নেই, আছে অজস্র আনন্দের ফুলঝুরি। তিনি যেন চিৎকার করে ডাকতে গেলেন, হঠাৎ এক ঝাঁক মেঘ এসে আকাশটা ঢেকে গেল, চাঁদটা ডুবে গেল। (চলবে——)
