জীবনের ডায়েরী থেকে গল্প সমগ্র : পর্ব-৫০

[ ড. টি. এন. রশীদ ]

(গত পর্বের পর) : ডাক্তার সাহেব যেমন শাক চরচরি, ভাজি, ভর্তা, টক খেতে ভালবাসতেন। তেমনি ভাল বাসতেন পোলাও, কোরমা, বিরানী, চপ, কাটলেট। মাঝে মাঝে বলতেন, ইস কুহলী তোমার হাতের রান্না এত সুন্দর মনে হয় তোমার হাতটাই খেয়ে ফেলি। ছেলে মেয়ে গুলো মমের মা খুব ভালবাসতেন। কোন দিন তাদের একটু অনাদর হতে দেয়নি। সব সময় রান্নার পর ছেলেমেয়ে গুলোর গোসল হয়ে গেলে নিজের পাশে বসিয়ে খাইয়ে ঘুমের নির্দেশ দিয়ে তারপর নিজে গোসল করতে যাইতেন। গোসল সেরে খাওয়ার বেলায় আবার ডাক্তার সাহেবের অপেক্ষায় সময় নিত। কখন ডাক্তার সাহেব আসবে তখন একসাথে খাবে। ডাক্তার মানুষ বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জায়গায় চলে যেত। এসে দেখত স্ত্রী না খেয়ে তার অপেক্ষা করছে।
ডাক্তার সাহেব বলতেন, তুমি এখনো না খেয়ে আমার অপেক্ষা করছ। আমি দেখতে পাচ্ছি তুমি একটা বড় ধরণের রোগ না বাঁধিয়ে ছাড়বে না। আমি ডাক্তার মানুষ কবে, কখন, কোথায় চলে যাই। তুমি তার জন্য বসে থাকবে? তুমি খেয়ে ছেলেমেয়ে নিয়ে বিশ্রাম করবে। আজ ডাক্তার সাহেবের সে সব স্মৃতিগুলো বারবার মনে পড়ে ডাক্তার সাহেবকে কাঁদিয়ে তোলে। তার বুকটা হাহাকার করে তোলে। সে ছিল বন্ধুর মত সাথী, সাথীর মত স্ত্রী। আজ আর তাকে দরদ করার কেহ নেই। কাছে ভাই আছে, বোন আছে, কিন্তু তবুও যেন মনে পড়ে কেহ নেই, কিছু নেই।
শীতের কুয়াশা ঢাকা ওড়না পড়া নিস্তব্ধ রাত অনেক না হলেও অনেক মনে হয়। তবে দেয়াল ঘড়িতে টং টং করে একটার ঘন্টা পড়ল। পাহারা ওয়ালা পাহাড়ায় বেরিয়ে পড়ল, তার হাঁকডাক শোনা যাচ্ছে। রাতের কুকুরগুলি পথে পথে ঘেউ ঘেউ শব্দ করছে। পথের পথিক ভয়ে থমকে দাঁড়ায়। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার হাটের লোকেরা আস্তে আস্তে ঘরে ফিরছে। দু’এক মুঠো চাল তরিতরকারী হাতে একটা পঁচা মাছ নিয়ে এত রাতেও বাড়ী ফিরছে। ঘরের স্ত্রী পথ পানে তাকিয়ে আছে ঐ একটু চালের জন্য। ছেলে-মেয়েরা কেঁদে কেটে ভাত না খেয়ে ঘুমিয়ে আছে। মা চুলায় পানি ফুটাচ্ছে আর বলছে এই ভাত হয়ে গেল। এই শীতে এই গভীর রাতে চলছে তাদের জীবনের মহড়া।
হঠাৎ ঝন্ ঝন্ করে খাজা সাহেবের দরজার কড়া বেজে উঠল, খাজা সাহেব গভীর ঘুমের গোরে আঁতকে উঠলেন- আস্তে আস্তে চোখ মুছে উঠে বসলেন-বললেন, কে? বলল, আমি ডাক্তার সাহেবের কম্পাউন্ডার। আপনাদের হট ওয়াটার ব্যাগটা দিন তো? মি. খাজা ভয়ে আতঙ্কের আশংকায় হট ওয়াটার ব্যাগটা কম্পাউন্ডারের হাতে দিল। মিসেস খাজা ভয়ে তাকিয়েও দেখল না। এই দশ দিন পূর্বে ডাক্তার সাহেবের বাড়ীতে এই লোকটা হট ওয়াটার ব্যাগ নিয়ে গিয়েছিল, দু’টো জিনিষ যেন তার মনে চিন্তার বিভ্রাট বাঁধিয়ে দিল। মিস্টার খাজা কম্পাউন্ডারকে বলেন, কি জন্য হট ওয়াটার ব্যাগ চাচ্ছ? সে বলল, ডাক্তার সাহেবের বুকে-পিঠে ব্যথা। মিস্টার খাজা তখনই ডাক্তার সাহেবকে দেখতে গেলেন। দেখলেন, ভদ্রলোক খুব কষ্ট পাচ্ছেন। বুকের ব্যথায় সুন্দর গোলগাল মুখটা কালো হয়ে যাচ্ছে। তখন ডাক্তার ডাকা হল, কিন্তু ডাক্তার কিছুই বুঝতে পারছে না।
রাত শেষে ভোর হয়ে গেল। সারা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ডাক্তার ডাকা হল, তারা কোন রোগ নির্ণয় করতে পারে নি। এভাবে সাতদিন অতিবাহিত হয়ে গেল। সারা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার লোকজন ডাক্তার সাহেবের রোগ মুক্তির অপেক্ষায় থাকল। ডাক্তার সাহেব পেইং ওয়ার্ডে ছিলেন, পাশে আরো রোগী ছিলেন। তারাও ডাক্তার সাহেবের সুখ-দুঃখের ভাগী ছিলেন। ডাক্তার সাহেব যখন ঘুমাতেন ভীষণ নাক ডেকে শব্দ করতেন। এতে পাশের রোগীদের অসুবিধা হত। তবুও রোগী মানুষ সকলেই সকলের সুখদুঃখের ভাগী হওয়া স্বাভাবিক। বিকাল ৪টা থেকে রোগীদের আত্মীয় স্বজনরা আসে রোগীদের দেখতে। ডাক্তার সাহেবের ভাইও এসেছেন। দুই ভাই অনেক কথা হল। সুখ-দুঃখ, ছেলে-মেয়েদের কথা, তার পর স্ত্রী “কুহেলির” কথা বলতে গিয়ে কিছুই বলতে পারলেন না। শুধু কেন যেন ডাক্তার সাহেবের চোখ দিয়ে পানি বেরিয়ে পড়ল। ভাই বলল, দাদা, কেন কাঁদছ? ভাল হয়ে যাবে। ডাক্তার সাহেব একটু হাসলেন, সে হাসি বড় মর্মান্তিক, বড় করুণ, বড় অসহায় ও বেদনা দায়ক। সে হাসি পাষাণের হাসি।
ছ’টার ঘন্টা পড়ল, রোগীদের আত্মীয়-স্বজনদের বিদায়ের ঘন্টা। এ ঘন্টা পড়ার সাথে সাথে ডাক্তার সাহেবের সুদীর্ঘ পাঁচটি বছরের পরিচয়। সে পাঁচটি বছরের কর্মব্যস্ত জীবনের কথা তার মনে পড়ল। সে ঘন্টা ছিল রুটিন করা ঘন্টা। কাজের ঘন্টা। আর আজকে এ ঘন্টা হয়ত জীবনের শেষ ঘন্টা। ভাই বলল, দাদা আসি। ডাক্তার সাহেব উত্তর করলেন না- কি যেন ভাবলেন, কি যেন বলতে চাইলেন।

(চলবে———)।

 

ফেসবুকে লাইক দিন

আমাদের সাইটের কোন বিষয়বস্তু অনুমতি ছাড়া কপি করা দণ্ডনীয় অপরাধ।