[ ড. টি. এন. রশীদ ]
(গত পর্বের পর) : একদিন শুভক্ষণে শুভদিনে তারা দার্জিলিং রওয়ানা দিল। রেশমী ওদের সঙ্গে দলেবলে ট্রাকের ভিতর বস্তাবন্দি হয়ে দার্জিলিং গেল। দার্জিলিং-এর সৌন্দর্যকে রেশমী ভালভাবে উপভোগ করতে পারে নাই। রেজা পথে সব সৌন্দর্যই উপভোগ করছে। রেশমীর বয়স তখন আনুমানিক ২০ বছর। রেজা যদি বলত, রেশমী সামনে এসে বস, ওখানে কিছু দেখা যাবে না- তাহলে রেশমী আসত। স্বামীর প্রতি অত জোর করার সাহস রেশমীর তখন হয় নি। দার্জিলিং গিয়ে রেশমীর পছন্দক্রমে অনেক কিছু কিনতে চাইল, কিন্তু রেজা তা প্রত্যাখ্যান করেছে। ছেলেমেয়েদের রেজা কিছু কিনে দিল। রেশমীর জন্য কিছুই কিনল না। দার্জিলিং-এ তারা তাদের এক পরিচিত লোকের বাড়ী উঠল।
রেশমী দার্জিলিংয়ের পরিবেশ ঘুরে ঘুরে দেখল- কি সুন্দর। এ মনোরম পরিবেশ। বিশ্বের সকল সৌন্দর্য দিয়ে মহান আল্লাহ একে গড়েছেন। কাঁচের ও কাঠের ছবির মত লোকের ঘর বাড়ীগুলো। ঢেউ খেলানো পাহাড়ের চূড়ায় সবুজের সমারোহ। কপি, টমেটো, মটরসুটি থোকায় ভরে আছে। বৈশাখের এই খর রৌদ্রে এখানে দারুণ শীতের আলোড়ন, ভাবতে বিস্ময় লাগে। রাস্তার বাঁকে বাঁকে উলকাটা ও উলের বই নিয়ে মেম সাহেবেরা বসে আছে। উল সে কি রং-বেরংয়ের উল, চোখ যেন জুড়িয়ে যায়। কত সাইজের বাহারে বাহারে কাঁটা চেয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। না কিনলেও হাতে নিয়ে দেখতে ভাল লাগে। পাহাড়ে উঠানামা করতে কি কষ্ট, বুক যেন ভেঙ্গে যায়। কিন্তু রেশমী বেশী দুর্বল হয় না। কারণ সে হালকা গঠন প্রকৃতির মানুষ। সর্বত্রই সে অগ্রগামী থাকে। একটা গরম কাপড়ের দোকানে তারা গেল। সে ভাগ্যক্রমে রেজা সাথে ছিল না। যে ভদ্র মহিলার বাসায় তারা উঠেছিল সে ভদ্র মহিলাই সাথে ছিল। সে একজন এমবিবিএস ডাক্তার। সে নিজেই পছন্দ করে রেশমীকে একটা গরম ও ভালো কোট বানাতে বলল। রেশমীও অর্ডার দিল।
দর্জিকে ডাকা হলো, দর্জিকে দেখে রেশমী অবাক। বিচ্ছিন্ন একটা পাঞ্জাবী গায়ে, ময়লা একটি পায়জামা পরনে। জীর্ণ শীর্ণ একজন ভদ্র লোক। রেশমীর ধারণা এ লোক কিভাবে ওভারকোট বানাবে? আশ্চর্য ও বিস্মিত হয়ে রেশমী তাকে দেখল। ভদ্র মহিলা বলল, এ খুব ভাল দর্জি, এ লোক মুসলমান। সত্যিই শিল্পিরা খুব গরীব। কিন্তু মনের কোণায় আছে এদের প্রতিভার স্বর্ণ মুকুট। তাদের ভাগ্যে নেই যশের জয়মাল্য। মহান স্রষ্টাই তাদের এ নিয়তির মাধ্যমে সৃষ্টি করেছেন। রেশমী উলের দোকান থেকে ৪ পাউন্ড উল কিনে নিল। বাসায় প্রায় বেলা দু'টার মধ্যে ফিরে এল। রেশমী বাসায় এসে রেজাকে ওভারকোট বানানোর কথা বলল। রেজা শুনতে রেগে ফেটে পড়ল। কেন তুমি এত টাকা খরচ করলে? রেশমী বলল, আমার একটা ওভারকোট গায়ে দিতে ইচ্ছে করছে- সে দিনের ঝগড়া ওদের ওখানে মিটে গেল।
যেই ভদ্রলোকের বাড়ী তারা উঠেছিল তাদের বাসায়ই তারা খাওয়া দাওয়া করেছেন। মাঝে দু-এক দিন কিছু কেনাকাটা করতে চাইলে তারা ভীষণ আপত্তি করত। একদিন রেজা সকালের দিকে পাহাড়ীদের কাছ থেকে কিছু বিস্কুট কিনেছিল। সকলেই সকালের চা-নাস্তার সাথে ঐ বিস্কুট খেল। ঐ হিন্দু গানের শিক্ষিকাকে রেজা বিস্কুট সেধেছিল। মিসট্রেসটা রেজার হাত থেকে ছোঁ মেরে বিস্কুটটা নিয়ে মুখে পুরে দিল। আর সে কি হাসি- হো হো করে উভয়ই হাসল। রেশমী কখনো কোন মেয়ে মানুষকে এমনি করে হাসতে দেখে নি। কথায় বলে খাল কেটে কুমির আনতে নেই। তারপর দিন তারা জলপাইগুড়ি ফিরে চলল। ড্রাইভার কিছু খেল না- বলল, আম্মা খেলে আমি ড্রাইভ করতে পারব না। সে সকাল থেকে গুড়িগুড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল। মেঘে মেঘে আর কুয়াশায় দার্জিলিংকে মোটেই চেনা যাচ্ছিল না।
খালি মটরটা-আর মটরের লাইটের আলোয় কালো পিচের রাস্তাটা দেখা যাচ্ছিল। ঘুম স্টেশনে এসে মটরটা থেমে গেল পেট্রোল নেবার জন্য। ছেলেমেয়েদের জন্য রেশমী কিছু চিনাবাদাম কিনল। ঘুম স্টেশন নাকি দার্জিলিংয়ের ভিতর সবচেয়ে উঁচু স্টেশন ও উঁচু পাহাড়। পথে মাঝে মাঝে ড্রাইভার পানি ও পেট্রোল নিল। ঘুম স্টেশন থেকে দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে রেশমীদের গাড়ী এসে কার্সিয়াং স্টেশনে এসে থামল। ড্রাইভার এখানে পান্থশালা থেকে কিছু খেয়ে নিল। নেমে পড়ল কার্সিয়াং টিভি সেনিটেরিয়াম দেখার জন্য। কিন্তু সেখানে উঁচু পাহাড়ে টিলায় কি করে উঠবে? কোন পথঘাট নেই। শেষ পর্যন্ত রেশমী পাহাড় বেয়ে উঠতে লাগল, এক পর্যায়ে রেশমী উপরে উঠে গেল, সঙ্গে আর যারা ছিল কেহই উঠতে পারল না।
কার্সিয়াং টিভি সেনেটেরিয়াম এর উপরে উঠে রেশমী ছেলে মানুষের মত চারিদিক দৌড়ে দৌড়ে দেখতে লাগল। হরেক রকম ফুলের সমারোহ সেনেটরিয়ামটা ছেয়ে আছে। রেশমীর আনন্দ আর ধরে না। তথাপি দুঃখ, যন্ত্রণা, ব্যথা বারবার করে উকি দিয়ে সেনেটেরিয়ামের রোগীদের দেখার জন্য চেষ্টা করল। কিন্তু কিছুই দেখতে পেল না। তখন দুপুর গড়িয়ে আসছে। ড্রাইভার চেচিয়ে রেশমীকে ডাকতে লাগল, আম্মা নেমে আসুন।
(চলবে---------)
সম্পাদকঃ মুহাম্মদ মাকসুদুর রহমান