জীবনের ডায়েরী থেকে গল্প সমগ্র : পর্ব-৪৪

[ ড. টি. এন. রশীদ ]
(গত পর্বের পর) : রেজা কখনো স্বেচ্ছায় কোন ডাক্তার ডেকে দেখায় না। রেশমী নিজেই ডাক্তার ডাকে- চিকিৎসা করায়। একটু ভাল হলে বাবার বাড়ী গিয়ে নিজের গয়না বিক্রি করে চিকিৎসা চালায়। বাবার বাড়ী থাকা অবস্থায় রেশমী শুনতে পায় রেজা জলপাইগুড়ি বদলী হয়েছে। রেশমী সাথে সাথে বগুড়ায় চলে আসে। বগুড়া থেকে বিদায়ের দিনে ওখানকার মহিলারা তাকে বিদায় পার্টি দিল। সঞ্চয়িতা-সঞ্চিতা, বিশ্বনবী এসব ভাল বই উপহার দিল। গলায় পরিয়ে দিল একটা বহু যত্নে গাঁথা মালা। রেশমী যেন লজ্জায় নুয়ে পড়ল। কি আর কাজ করেছে সেই সামান্য সহযোগিতা। এতে এত খুশি ওরা রেশমীর প্রতি। আশ্চর্য, ধন্য এদের দেশপ্রীতি।
বগুড়া থেকে চলে আসবে বলে রেশমী আবার বগুড়ার উল্লেখযোগ্য জায়গাগুলো ঘুরে দেখতে লাগল। মহাস্থান, শান্ত, নীরব, মহামুনি ঋষির পীঠস্থান। সেখানে কটকটি (খাওয়ার জিনিষ) বড় সুস্বাদু। বগুড়া থেকে জয়পুরহাট, জয়পুরহাট থেকে পাহাড়পুর। সত্যি মাটির নিচে কি কারুকার্যময় ঐশ্বর্যশালী দালানকোঠা- তা দেখলে তাকে ভাল লাগে। কত বৎসরের কত ধৈর্যে, মাটির অদৃশ্য আড়াল থেকে- এক গবেষণাকারীরা আবিষ্কার করেছে। কত সুন্দর সুন্দর ছবি এঁকেছে দালানের প্রস্তরে অতীত যুগের অতীত কল্পনার এই শিল্পীদের গুণের তারিফ করলে বোধহয় তাদের সম্মান দেওয়া হয় না। বরং বলতে হয়, বর্তমান শিল্পিরা তাদের শিল্পকলা নৈপুণ্যের কাছে শিশু।
একটা পান্থশালা সেখানে আছে। তাও বেশ সুন্দর। রেশমীর ইচ্ছে ছিল একটি রাত সেখানে থাকার। কিন্তু রেজা অনুমতি দিল না। ওরা জীপগাড়ী নিয়ে গিয়েছিল। জীপ ছুটে চলল বগুড়ার দিকে। পথে কত সুন্দর জিনিষ রেশমীকে হাতছানি দিল। আসার সময় সেখানকার একজন প্রবীণ উকিলের বাসায় খাবার দিল। উকিল ভদ্রলোকও তার স্ত্রী খুব ভাল লোক। তাদের একটিমাত্র ছেলে। তার নাম বুলু। সে ভদ্র মহিলার কাছে রেশমী সব সময় সেলাই শিখত। সন্ধ্যা হলেই হারিকেনটা জ্বালিয়ে তার কাছে চলে যেত। ভদ্র মহিলা একটু মুচকি হেসে, সংসারের সব কাজ দূরে ফেলে তার সঙ্গে গল্প করত, আর সেলাই শেখাত।
ভদ্র মহিলার নিজের বলতে কিছু কাজ ছিল না। কিন্তু ননদ, দেবর ছিল অনেকগুলো। জায়েরা এসে থাকত ওদের ছেলেমেয়ে নিয়ে। রাতদিন রান্না-বান্না খাওয়া এ সবের অন্ত ছিল না। নিজের একটা মাত্র ছেলে, ছেলেটা তখন ক্লাস সেভেনে পড়ত, ভদ্র মহিলা বড় হাসি-খুশি, বড় উদার প্রকৃতির ছিল। অথচ এ ভদ্রমহিলাকে এই দেবররাই তার স্বামী মরে যাওয়ার পর তাকে বিষপানে হত্যা করে। এই পৃথিবীতে মেয়েদের অবহেলাটা পূর্ব থেকে চলে আসছে। দয়া, অনুগ্রহ, অভয় আশ্রয় সহানুভূতি, ভালবাসা, বিশ্বাস, সকলের কাছেই তারা প্রত্যাশা করে। কিন্তু কেউ তাদের একাগ্রভাবে বিবেচনা করে না। জগতের কত পাপ কত অবহেলায় তাদের জন্ম তা মেয়েরা জানে না। জানেন সেই বিশ্ব বিধাতা। কেন তিনি মেয়ে সৃষ্টি করেছিলেন? এত অবজ্ঞা, এত লাঞ্ছনা, এত অবহেলা, এত মারধর তাদের সহ্য করতে হচ্ছে।
এক পর্যায়ে রেশমী ও রেজা ছেলে-মেয়ে সহ জলপাইগুড়ি পৌঁছে গেল। জলপাইগুড়ি এসে রেশমীর মন উড়ে গেল সেই পাহাড়ী ঝর্নার কাছে। ছোট একটা বাসা পেল ওরা বাকালী হাউজের কাছে। ওদের বাসার কাছে থাকত দুটি হিন্দু পরিবার। একই বাড়ী। বাড়ীর মাঝখান দিয়ে পার্টিশন দেওয়া। হিন্দু পরিবার দুটি বেশ ভাল ছিল। ভদ্র মহিলা দু’জনই রেশমীর বাসায় আসা-যাওয়া করত। রেজা সব সময় মফস্বলে যেত। রেশমী যাওয়ার জন্য জোর আপত্তি করলে বাধ্য হয়ে তাকে নিয়ে যেত। সেই শিবক ব্রীজ ভুটান পাহাড়ের খুব কাছে। দু’পাশে দু’টো পাহাড়। মাঝখানে পাহাড়ী নদী তিরতির করে বয়ে যাচ্ছে। একটা বড় ব্রীজ তার উপর দিয়ে গিয়ে তার গায়ে লেগেছে। দুটো বড় বাঘ ব্রীজের দু’ধারে হা করে দাঁড়িয়ে আছে। মিঠু ও সোহেল তা দেখে কেঁদে অস্থির।
রেশমী বাচ্চাদেরকে বুঝাল, ঐটা পাথরের বাঘ, জ্যান্ত নয়। জলপাইগুড়ি থেকে শিবক যেতে সংকীর্ণ কংক্রীটের রাস্তা। দু’পাশে পাহাড়ী নদী। চলমান গাড়ী একটু গতি বাড়ালে শেষ। তবু যেন এ সব সুন্দর জিনিষের কাছে রেশমী মৃত্যুকে ভয় করে না। রেশমী লোক মুখে শুনেছে দার্জিলিং খুব সুন্দর। রেজার কাছে সে প্রায়ই বলত আমি দার্জিলিং যাব। এক সময় রেজা দার্জিলিং দেখার জন্য তারিখ ঠিক করে ফেলল। ৬ই বৈশাখ। বাড়ীর কাছে হিন্দু একটা মেয়ে নাম মৃদুলা, সে একজন গানের শিক্ষিকা, তাকেও সাথে নিল।
(চলবে——-)