জীবনের ডায়েরী থেকে গল্প সমগ্র : পর্ব-৪৩

[ ড. টি. এন. রশীদ ]

(গত পর্বের পর) : মাথার ঘাম পায়ে ফেলে এরা পয়সা রোজগার করে। তাতেও স্ত্রীপুত্রের ভরণপোষণ হয় না। ঘরে ফিরে এসে দেখে ছেলেমেয়েরা ক্ষুধার জ্বালায় কাঁদে।। ঘরে এসে এসব দেখে ছেলে-মেয়েদেরকে মারধর করে। ঘরের স্ত্রীকে পেটায়। এদের ক্ষমা করা যায়। কিন্তু যারা বিদ্যা শিক্ষার বড়াই করে, মুখে বড় বড় কথা বলে। টাই, স্যুট পড়ে ভদ্রতার মুখোশ পড়ে অযথা ঘরের স্ত্রীকে মারধর করে তাদের ক্ষমা করা যায় না।

রেশমী বগুড়ায় এসে বগুড়ার মহিলা সমিতির সভাপতি মিসেস রহমানের সাথে পরিচিত হল। তিনি রেশমীকে তার অর্গানাইজেশনে আসতে বললেন। রেশমী রেজার কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে মিসেস রহমানের সাথে কাজে যোগ দিলেন। মিসেস খাতুন এ মহিলা সমিতির সেক্রেটারী, ভদ্র মহিলা বেশ বয়ষ্ক ও অমায়িক। রেশমী প্রায়ই মহিলা সমিতির মিটিং এ আসে। মিসেস খাতুন মহিলা মাদ্রাসার শিক্ষিকা, ভদ্রমহিলা বিধবা সব সময়ই একখানা সাদা কাপড় ও সাদা ব্লাউজ তাঁর অঙ্গে শোভা পায়। এখনও এ বয়সে কাজকর্মে বেশ উৎসাহ উদ্দীপনা আছে।

মহিলা সমিতির কাজকর্ম ততটা গতিশীল ছিল না। মেয়েদের ব্যাপার হরেক রকম অসুবিধা তাদের থাকে। ছেলে-মেয়ে, রান্না-বান্না, স্বামী, ঘর-সংসার সব ঝামেলা মিটিয়ে তাদের সময় নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। অনেক অসুবিধা থাকা সত্ত্বেও রেশমী মিটিং এ আসে। ভাল লাগে বিচিত্র মহিলার সমাবেশ। এক ভদ্র মহিলার সাথে রেশমীর খুব আলাপ হল। ভদ্র মহিলার সাতটি মেয়ে, ভদ্রলোক উকিল, কাটনা পাড়ায় তার বাড়ী। বড় মেয়েটা স্কুলে পড়ে তার নাম আরজু। বড়টা ক্লাস টেনে, মেজোটা ক্লাস নাইনে। তার নাম নাজু, নাজুর গায়ের রং খুব সুন্দর, টানাটানা চেহারা, দেখতে সুন্দরী। বড়টা সুন্দরী না হলেও স্বাস্থ্য চেহারা মন্দ নয়। আরজুর না কি বিয়ে হয়েছিল। বিয়ের রাতেই বর তাকে দেখে পালিয়েছিল। মেয়েটাকে দেখলে বড় মায়া হয়। কত অসহায়, কত নিরূপায় এই বিংশ শতাব্দীর যুগেও আমাদের দেশের মেয়েরা।

সাজু সুন্দরী বলে সাজুর বিয়ে হল এক বড় ঠিকাদারের কাছে। বেশ স্বর্ণালংকার দিয়ে সাজুকে সাজিয়ে নিয়ে গেল। কিছুদিন হাসিখুশিতে বিভিন্ন জায়গায় ঘরে বেড়াতে লাগল। কিছু দিন পর ছোট বোন নাজু তার বাড়ী বেড়াতে গেল। তার স্বামী রাতের অন্ধকারে নাজুকে নিয়ে পালিয়ে গেল। ঘরে পড়ে রইল বিবাহিতা স্ত্রী। নাজুর মা খবর পেয়ে থানায় খবর দেয়। তার নামে ওয়ারেন্ট যায়, তাকে নাজু সহ ধরে নিয়ে আসে। সাজু এ স্বামীর ঘর করতে অসম্মতি জানায়। নাজু, সাজু, আরজু এ তিনটি মেয়েই ভদ্র মহিলার ঘরে পড়ে থাকে।

ভদ্রমহিলা এখন শুধু নামায পড়ে এবং ঘরে পড়ে থাকেন। একটি ছেলে, ছেলেটা স্কুলে পড়ে। সাজু, নাজু, আরজু ওরা বাড়ী বসে মেট্রিক দেওয়ার জন্য তৈরী হচ্ছে। বর্তমান যুগে যে আবহাওয়া তাতে মেয়েদের আত্মত্মনির্ভরশীল না হলে চলে না। রেশমীর দোষ রেজার কাছে সব সময় লেগেই আছে। কথায় আছে, যারে দেখতে নারি তার চলন বাঁকা। ছেলে-মেয়ে তিনটি আস্তে আস্তে বড় হয়ে উঠল। রেজা এখন রেশমীকে ছেলেমেয়েদের সামনে মারে না। ঘরে ভিতরে দরজা বন্ধ করে বাচ্চাদের আড়ালে মালে। ছেলেটা-মেয়েটা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে কাঁদে। রেশমী মার খেয়ে কতক্ষণ কাঁদে। তারপর চুপ করে থাকে। রেশমী বের হয়ে আসলে ছেলে-মেয়েরা মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদে। রেশমী ছেলেমেয়ে সোনামুখ দেখে সকল দুঃখ, বেদনা লাঞ্ছনা ভুলে যায়।

এবার মার খেয়ে রেশমী শয্যাশায়ী হয়ে পড়ল। হাতে, কোমরে, মুখে নীল দাগ। ডাক্তার দেখতে এসে বলল, আপনার হাতে কিসের দাগ? রেশমী বলল ছেলে দুটি লাঠি নিয়ে মারামারি করছিল। তার আঘাত লেগেছে। ডাক্তার হাসল, এ হাসি কি বোকার না বুদ্ধিমানের রেশমী বুঝতে পারল না। রেশমী রবীন্দ্রনাতে দৃষ্টিদান গল্প পড়েছিল। মেয়েদের এত ছলনার প্রয়োজন, মা হয়ে কোলের ছেলেকে ভুলিয়ে রাখতে হয়। স্ত্রী হয়ে স্বামীকে ভুলিয়ে রাখতে হয়। মেয়ে জন্ম লাভ করে এত ছলনার প্রয়াস। রেশমী আস্তে আস্তে জানল সে আবারও অন্তঃসত্ত্বা। রেশমী কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। যার নিজের গতির ঠিক নেই তার পেটে আবার সন্তান। এ সন্তানের কি হবে? সে তো মানুষ হবে না। এদের রক্তের শিরায় শিরায় থাকবে অত্যাচারের লেলিহান শিখা। রেশমী প্রায় সময় শুয়ে থাকে। উঠতে ইচ্ছে করে না। ব্যথায় ব্যথায় শরীরের হাড়গুলো যে গুড়া হয়ে গেছে। ঝি চাকরেরা এসে সহানুভূতি প্রকাশ করে।

(চলবে——–)

ফেসবুকে লাইক দিন

আমাদের সাইটের কোন বিষয়বস্তু অনুমতি ছাড়া কপি করা দণ্ডনীয় অপরাধ।