জীবনের ডায়েরী থেকে গল্প সমগ্র : পর্ব-৪২

[ ড. টি. এন. রশীদ ]

(গত পর্বের পর) : তবুও এ সংসারে তাকে থাকতে হবে। তিলে তিলে অত্যাচার সহ্য করতে হবে। সমাজ সংসার তাকে ক্ষমা করবে না। দেখতে দেখতে দুটি ছেলে হয়েছে আরও একটি সন্তান গর্ভ ধারণ করেছে। এসবের কথা সব সময় ভাবে। জানে না সে কি ভাগ্য নিয়ে আসছে। তারা বড় হয়ে দেখবে তার বাবা তার মাকে মারছে, বকাবকি করছে। এসব দেখে তারা কি শিক্ষা নিয়ে বড় হবে? বড় ছেলেটা রেশমীকে মারার সময় জড়িয়ে ধরে কাঁদে, তবু রেজার হাত নামে না। রেজা চায় রেশমী চলে যাক। বলে তুই চলে যা তোকে ভাগিয়ে দিলাম। রেজার মূল কৌশল ছিল রেশমী স্বেচ্ছায় চলে যাক।

রেশমী যায় না, যেতে পারে না। পেটের ভাতের জন্য নয়, মান সম্মানের জন্য। সে জানে ভাত-কাপড়ের অভাব তার হবে না। কিন্তু ব্যক্তিত্ব ও সম্মান হারিয়ে গেলে আর পাওয়া যাবে না। সন্তানগুলোর প্রতি চেয়ে মনের মমতা জাগে। আফসোস হয় এদের অনাগত ভবিষ্যতের পানে তাকিয়ে। মিঠু এখন অনেক বড় হয়েছে। বাড়ীতে একটু একটু মার কাছে পড়ে। মাঝে মাঝে মাকে জিজ্ঞেস করে, বাবা তোমাকে মারে কেন? তুমি মারতে পার না? রেশমী বলে, ছিঃ বাবা অমন কথা বলে না, তুমি পড়। মিঠু বলে- আমি বড় হয়ে বাবাকে মারব, এক্কেবারে মেরে ফেলব।

রেশমী বলে, এসব বলে না, পাপ হয়। তিনি তোমার বাবা। এমনি করে সংসারটা চলছে দুঃখে হোক আর সুখে হোক। রেজা প্রায়ই মফস্বল যায়। রেশমী চেয়ে থাকে উদার আকাশের দিকে। তার বুকে কত স্থান- তার বুকে কত তারা। অপার অসীম সে ছোট ছোট তারাগুলি। কত বড় চাঁদ, তা-ও কেমন এক কোণে সুন্দর করে হেসে থাকে। সে কত সহজ, সরল, সুন্দর, কত কমনীয়, কত নমনীয়। খ- খ- মেঘগুলি কেমন ভেসে ভেসে আকাশের বুকে বেড়াচ্ছে। কই আকাশের আরশিতে একটুও রাগ দেখা যাচ্ছে না। তার মুখ হাসিতে, আনন্দে গৌরবে উজ্জ্বল। তার স্বামীর বুকে একটু স্থান হলো না। ঐ ক্ষুদ্র বুকে এই এতটুকু একটি মেয়ের জায়গা হলো না। রবী ঠাকুরের একটা কবিতা তার মনে পড়ে গেল।

“যে আমাকে দেখে অসীম ক্ষমতায়,
ভাল-মন্দ মিলায় সকলি।”

সে এ সংসারের জন্য কি না করেছে। স্বামীকে সুখী করার জন্য আর কোন কৌশল তার পেটে নেই। রেশমী এখন সমাজের অন্যান্য নারীদের সাথে পরিচিত হতে লাগল। বাগেরহাটের এসিস্ট্যান্ট সার্জন, নাম যে কি- এত মনে নেই। সার্জনের স্ত্রী ভদ্র মহিলা একদিন বেড়াতে এসে রেশমীর টেবিলে রাখা বইয়ের মাঝে রেশমীর লেখা কবিতা আবিষ্কার করলো। রেশমী মাঝে মাঝে লিখত, কিন্তু কাউকে দেখাত না। স্বামীকে কিছু বলত না। সার্জনের স্ত্রী সকলের কাছে প্রকাশ করল রেশমী লেখে। সবাই জিজ্ঞেস করতে রেশমী লজ্জায় নুয়ে পড়ল। রেশমীর ভিতরে একটা নতুন অনুভূতি প্রকাশ পেল। তখন বাগেরহাটে একটি মুসলিম মহিলা সমিতি নামে একটি মহিলা সংগঠন ছিল। রেশমীকে সকলে মিলে সেক্রেটারী বানাল, রেশমী অনেক আপত্তি তুলছিল, স্বামীও ছেলেমেয়েদের নিয়ে। ভদ্রমহিলারা তার আপত্তি কেউ মানল না। রেশমীকে বাধ্য হয়ে দায়িত্ব নিতে হলো। ভয় ছিল রেজাকে নিয়ে, সে কিভাবে গ্রহণ করবে? সংগঠনের সদস্যরা রেজাকে অনেক বুঝানোর পর রেজা শেষ পর্যন্ত আপত্তি করলো না।

এই সংগঠন কর্তৃক রেশমী বাগেরহাটে সমাজসেবা মূলক অনেক কাজ করেছে। অনেক সাংস্কৃতি অনুষ্ঠান, অনেক ড্রামা, নৈশ বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা সহ অনেক কাজ করেছে। সেই সময় একটা প্রাইমারী স্কুলের সেক্রেটারীও ছিল। সকলেই তার সুনাম করল। কিন্তু তার স্বামীর কাছে কোন সুনাম তার ছিল না। সব সময় তার দোষ ত্রুটি গুলো বড় করে দেখত। পঁচিশে বৈশাখ রবী ঠাকুরের জন্ম দিনে হিন্দুরা একটি জন্ম বার্ষিকী পালন করছে। রেশমীও ইচ্ছে করল ঐ অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহন করতে। স্বামীর অনুমতি চাইল সে অনুমতি দিল না।

রেশমী কত অসহায় একটা সামান্য হুকুমের জন্য রেশমী প্রতিবন্ধকতার স্বীকার হলো। কিন্তু কে যেন সাহস দিল, অভয় দিল তুমি যাও, তুমি যাও, রেশমী চলে গেল। বিয়ের পর সে কোন পুরুষেদের অনুষ্ঠানে যায়নি। অথচ মহিলা সমিতির সাথে জড়িত হওয়ার পর সকল অনুষ্ঠানে জড়িত হওয়ার চেষ্টা করে। সে সময় বাঘেরহাট কলেজের এক অনুষ্ঠানে সরাসরি প্রিন্সিপালের অনুমতি নিয়ে অনুষ্ঠানে কবিতা পাঠ করেছিল। দেখল কতগুলি উৎসুক মুখ তার দৃষ্টি পানে তাকিয়ে আছে। লজ্জা সংকোচ ভয় তার থেকে কোথায় চলে গিয়াছে তা বেশমী বলতে পারে না। হাজার হাজার লোক হাত তালি দিয়ে তাকে অভ্যর্থনা জানাল। এই প্রথম রেশমী নিজকে আবিস্কার করল। সংসার জগৎ ছাড়া বাহিরে যে একটা জগৎ আছে সেটা আসীন করল। যদিও তাঁর স্বামী তাঁর রূপের জন্য তাঁকে নিজের মনে স্থান দেয়নি। কিন্তু সমাজ সেটা ভুল করেনি। রেশমী প্রতিভার জন্য সমাজ তাকে শ্রেষ্ট আসন দিল।

রেশমী শাস্তি পেল, স্বস্তি পেল, আশ্বাস পেল- হাক ছেড়ে বাঁচল। বিশ্ব স্রষ্টার নিকট কৃতজ্ঞতা জানাল। রেজা রেশমীকে নিয়ে বগুড়ায় বদলী হল। রেশমীর তিন সন্তান মিঠু, সোহেল, ঝরা। রেশমী সংসারপ্রিয়, সংসারের জন্য যতটুকু তার আয়ত্বে ততটুকু সে করে যায়। বগুড়া একটি শিক্ষিত এলাকা। শিক্ষা, দীক্ষা, নাচ, গান, অভিনয় তারা খুব পারদর্শী। কৃষ্টি কালচারের উন্মুক্ত দুয়ার। সেখানের নবাব বাড়ী দেখার মত জায়গা। সেই নবাবী কৃষ্টি কালচারের স্মৃতি এখনও বহমান। এখনো জীর্ণ খাচায় শীর্ণ বাঘটা ক্ষুধার জ্বালায় ঘুরে ঘুরে বেড়ায়।

কৃত্রিম সিংহটা জ্বলজ্বল চোখে হা করে দাঁড়িয়ে আছে। সিংহ দরজায় এখন আর সেই বন্দুকধারী দারোয়ান নেই। তবে বড় তালাটা ঝুলছে অতীতের স্মৃতি রোমন্থন করে। রেশমী সেগুলো প্রায়ই দেখতে যায়। তার সাহিত্যের ছোঁয়া যেন এখানে আছে। করতোয়া নদীটা এঁকেবেঁকে বয়ে গেছে। বেগমদের প্রমোদ উদ্যান থেকে নদী পর্যন্ত একটা ধাপে ধাপে সিঁড়ি নেমে গেছে। দু’ধারে বনলতায় বনফুল লাল নীল হলুদ, বেগুনি রং নিয়ে আপন মহিমায় ভাস্বর। রেশমী কতক্ষণ সময় নিয়ে করতোয়া নদীর তীরে বসল। হরেক রকম কল্পনার জগতে তিনি হারিয়ে গেলেন।

রেশমী উঠে দাঁড়াল- না এ শুধু ক্ষণিকের মোহ, মায়া, এ সব কিছু নয়। আজ যেখানে এত জাকজমক কাল হয়ত সেখানে ঘাসে ঘাসে গভীর জঙ্গল ঢেকে যাবে। মিঠু কাঁদতে লাগল মা বাড়ী চল। রেশমী বাড়ী ফিরে এল। ২৫ পয়সা রিক্সাওয়ালাকে দিতেই রিক্সাওয়ালা নিয়ে এল। সত্যি এরা কত গরীব, এই চার আনা পয়সার জন্য এই নবাব বাড়ী থেকে কাটনা পাড়া নিয়ে এল।

(চলবে——-)

ফেসবুকে লাইক দিন

আমাদের সাইটের কোন বিষয়বস্তু অনুমতি ছাড়া কপি করা দণ্ডনীয় অপরাধ।