জীবনের ডায়েরী থেকে গল্প সমগ্র : পর্ব-৪০

[ ড. টি. এন. রশীদ ]

(গত পর্বের পর) : রেশমী যেন বিশ্বজগতের মধ্যে একটা নতুন শব্দ শুনল। আশ্চর্য হয়ে অবাক হয়ে আজিমের মুখের পানে একটু তাকিয়ে দেখল। আজিমও তাকাল- তারপর যে যার মত খেয়ে উঠে গেল। বিকালের দিকে, মিঠুকে নিয়ে আজিম বেড়াতে গেল। ছেলেটি আশ্চর্য ধীর-স্থির, স্বল্পভাষী, মমতাশীল, অনুভূতিশীল। রেশমী আশ্চর্য হয়ে দেখে, জীবনে সে বেশী পুরুষ ছেলেদের ঘনিষ্ঠতা পায় নি। একমাত্র বাবা-মা, মামাত ভাই বাঁশী ওদেরকে দেখেই মানুষ। বাঁশীও ছিল বড় দুরন্ত, অস্থির, মানুষের সাথে ক্লাসের ছেলেদের সাথে মারামারি, পিটাপিটি লেগেই থাকত। বাবার কাছে যে কত নালিশ আসত। আর সেই সঙ্গে রেশমীর নামেও ভীষণ অভিযোগ থাকত। পাশের বাসার আজ এর মেয়েকে মেরেছে, কাল ওর গাছের আম পেরে খেয়েছে, পরশু ঐ হোটেলওয়ালার মেয়েকে ধরে বেঁধে ঘরের দরজা আটকিয়ে মেরেছে। খুলনায় মৌলভী পাড়ায় ওদের বাড়ী ছিল। সেখানে নামকরা এক তালুকদার বাড়ী ছিল। সেই বাড়ীর এক বুড়ি ছিল। বুড়িটা ছিল বড় কিপটে, ওর কত ফল যে রেশমী চুরি করে খেয়েছে ও অন্যদের খাইয়েছে। ওদের এক চাকরানী ছিল। সে ভাল গাছে চড়তে পারত। পুরুষকে ওর গাছে ওঠার কাছে হার মানিয়ে দিত। ওর নাম ছিল মায়াজান। ছোটবেলা থেকে রেশমীদের বাড়ী কাজ করে লেখাপড়াও কিছু শিখেছিল, খেলাধুলা, কেরাম বোর্ড, লুডু, কড়ি, গুটি এসবে রেশমীকে হারিয়ে দিত।
মেয়েটার আশ্চর্য বুদ্ধি ও শক্তি। ঐ তালুকদার বাড়ীর বুড়ির যত ফল রেশমীর কথামত মায়াজান চুরি করত। বুড়ি রেশমীকে কত অভিশাপ দিত। বুড়ির একটা মসজিদ ছিল। ঐ মসজিদে পাড়ার সব ছেলেমেয়েদের নিয়ে রেশমীও সব চুরির জিনিষ ভাগ করে খেত। বুড়িটা নিজে কিছু জিনিষ কিনে খেত না। রেশমীদের বাড়ী গেলে ওরা মিষ্টি আনলে বুড়ি মিষ্টির শিরা চেয়ে খেত। এমনি হাড় কিপটে বুড়ি। বুড়ির স্বামী সেই সময়ে একজন বড় উকিল ছিল। দুটি মাত্র মেয়ে রেখে ভদ্র লোক মারা যায়। বুড়ি মেয়ে দুটিকে বিয়ে দিয়েছেন। বড় জামাই মোক্তার। ছোট জামাই ব্যবসা করে। মোক্তার সাহেবের অনেক ছেলে মেয়ে ছিল। একটা ছেলেমেয়েও লেখাপড়ায় ভাল ছিল না।
বুড়ির মেলা ফলের বাগান ছিল। বাগানে দারুচিনি গাছ, তেজপাতার গাছ, ছবেদা, গোলাপজাম, লিচু, পানিফল, বেলগাছসহ হরেক রকমের ফুল গাছ ছিল। বাগানের পাশেই শান বাঁধানো দীঘি। দীঘির জল কাক চক্ষুর মত টলটল করে। মৌলভী পাড়ার ছেলেরা বুড়ির দীঘিতে গোসল করে। আর ডিল মেরে বুড়ির গাছের ফল পেড়ে খায়। বুড়ি দূর থেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে আর ছেলেমেয়েদের অভিশাপ দেয়। আজিমের বন্ধের প্রায় ১৫ দিন কেটে গেল। রেশমীর কাছে আজিম প্রায় পুরাতন হয়ে এল। শুক্ল পক্ষের চাঁদাটা যখন বড় হয়ে উঠল, তখন আজিম বায়না ধরে, চলেন চাচী নদীর কাছ দিয়ে বেড়িয়ে আসি। রেশমী রাজি হয়, মিঠুকে সাথে করে ওরা বেড়ায়। আজিম সাইকেল চালাতে জানত না। চাচার সাইকেলটা নিয়ে শিখতে চাইল, রেশমী অনুমতি দিল। আজিম সাতদিনের মধ্যে সাইকেল চালানো শিখে ফেলল। রেজা তখন অনেক দূরে সাত দিনের জন্য মফস্বলে গিয়েছিল। তখন বৈশাখ মাস। প্রচন্ড গরম গরমের তাপে শরীর যেন ক্লান্ত লাগত। সন্ধ্যা হলেই আজিম চাচীকে নিয়ে নদীর পারে যেত ঠান্ডা বাতাসের জন্য।
একদিন সন্ধ্যায় রেশমী ঘরের দরজা বন্ধ করে শুয়েছিল। কে যেন লাঠি দিয়ে জানালার ফাঁকে খোঁচা মারল। রেশমী ভয়ে চিৎকার করে উঠল। অনেকক্ষণ পর আজিম ঘুরে এসে বলল, আমি আপনাকে ভয় দেখিয়ে ছিলাম। রেশমী ভাবল এ আবার কেমন ছেলে। অন্যকে ভয় দেখিয়ে মনে মনে আনন্দ পায়।
ছুটি প্রায়ই শেষ হয়ে এল, আজিম চলে গেল। তার চলে যাওয়ার পর রেখে গেল স্নেহ, মায়ামমতার একটা আলেখ্য। আজিমদের বাড়ী ছিল রূপসা নদীর পূর্বপাশে। গ্রামের একজন মাতব্বারের ছেলে। তারা অনেক ভাই, বোন ছিল। তাঁর বাবা দুই বিয়ে করেছে। তার আপন মা একটু অসুস্থ ছিল। ছোটবেলা থেকে সে আদর যতœ যথাউপযুক্ত পায় নি। বড় ভাই গ্রামের মৌলভী, তার মামার জেল হয়েছিল। আজিম রেজার দূর সম্পর্কের আত্মীয় হত। এক পর্যায়ে বর্ষা এসে গেল। রেজা বাগেরহাট বদলী হলো। বাগেরহাট ডাক বাংলায় ওরা অবস্থান করত। বাগেরহাটের ডাকবাংলা ও নদীটা তাদের কাছে খুব ভাল লাগত। কিছুদিন অবস্থানের পর তারা বাগেরহাট কলেজের কাছে একটা বাড়ী পেল। এখানে রেশমীর ২য় ছেলে সোহেল হলো। রেশমীর শরীর তেমন ভাল ছিল না। ক্লান্তি যেন লেগেই থাকত। দুটি ছেলেকে নিয়ে রেশমীর দিনগুলো দুঃখে, সুখে চলে যেতে লাগল।

(চলবে——-)

ফেসবুকে লাইক দিন

আমাদের সাইটের কোন বিষয়বস্তু অনুমতি ছাড়া কপি করা দণ্ডনীয় অপরাধ।