জীবনের ডায়েরী থেকে গল্প সমগ্র : পর্ব-৩৬

[ ড. টি. এন. রশীদ ]
(গত পর্বের পর) : ওরা শাহজাদপুর ছেড়ে সিরাজগঞ্জে বদলী হল। সেদিন রেশমীর কি আনন্দ, এই মফস্বলে এসে সে যেন দম আটকে মরে যাচ্ছিল। নৌকায় সব জিনিষপত্র তুলে, তারা নৌকায় করে সিরাজগঞ্জ রওয়ানা হলো। রাত্রে মাঝিরা নৌকায় রান্না করল, ওদের রান্না কি সুন্দর, বড় বড় বাবুর্চিদেরও হার মানিয়ে দেয়। নৌকা যতই সিরাজগঞ্জের দিকে এগুতে লাগল ততই রেশমীর আনন্দ বাড়তে লাগল। রাত্রে চাঁদের আলোয় রেশমী যেন বোবা হয়ে গিয়েছিল। মানুষ না কি অনেক আনন্দে-দুঃখে বোবা হয়ে যায়। সে কি আলোর খেলা- সারা নদী যেন আলোয় ফুলঝুরি খেলছিল। বড় চাঁদটা যেন নদী থেকে নেয়ে উঠেছিল। আকাশের ছোট ছোট তারাগুলি রেশমীকে দেখে যেন হেসেছিল। রেশমীও ওদের মত ছোট কি না?
রাত যখন ভোর হয়ে এল, দেখল মাঝিরা গুণ টেনে চলছে, নদীর কিনারে পাট ক্ষেতের পাশ দিয়ে ধানের শীষের কিনার ঘেঁষে কলমী লতার বুক চিরে শাপলা বনের মাঝ দিয়ে, পদ্ম বনের পদ্মকলির শির ছুঁয়ে। তবুও যেন ওদের কোন ক্লান্তি নেই। সেই সুন্দর, সাবলীল, মিষ্টি মধুর হাসি, পরিশ্রান্ত মুখে লেগেই আছে। আর দু’জন মাঝি কেমন তালে তালে দাঁড় টেনে চলছে। হাসছে, পান খাচ্ছে, নিস্তব্ধ নদীর বুক দিয়ে ওদের ছোট নৌকা নেচে নেচে চলছে, তার মাঝে ওরা দুটো প্রাণী কপোত-কপোতীর মত। বেলা দশটার সময় ওরা এসে সিরাজগঞ্জ পৌঁছে গেল।
সিরাজগঞ্জের এস.ডি.ওর বাড়ীর কাছে ওরা ছোট্ট একটি বাসা পেল। বাসার কাছেই ফৌজদারী আদালত, সাব-রেজিস্ট্রার অফিস, কত রং বেরংয়ের লোক। ডুলি চরে চরে গ্রামের মহিলা-পুরুষ আদালত, ফৌজদারীতে আসে। আদালত প্রাঙ্গনে চানাচুর, পান, শরবতের দোকান বসে যায়। সকাল দশটা থেকে বিকাল পাঁচটা পর্যন্ত যেন এক মেলা বসে। রেশমীর ভাল লাগে এ জন কোলাহল, এ দৃশ্য। সকাল ১১টা থেকে হিন্দুদের ছেলে-মেয়ে, বৌ-ঝিরা যমুনায় স্নান করতে যায়। সধবার লাল চওড়া পাট শাড়ী পরে, কপালে লাল বড় সিঁদুরের ফোটা পরে বাহিরে যায়। অনেকে স্নান শেষে ভিজা শাড়ীটা গায়ে জড়িয়ে বাড়ী ফিরে। বিধবারা সাদা থান কাপড় পড়ে হাতে পিতলের ঘটি ভরে গাঙ্গের পবিত্র জল নিয়ে বাড়ি ফিরে চলে। যুবতীদের ভিজা গায়ে অপূর্ব লাগে। যৌবনের ধাপে ধাপে ভিজা অঙ্গে অঙ্গে কাপড় ভাজে ভাজে জড়িয়ে থাকে। উন্নত স্তন দুটো যৌবনের সাক্ষ্য দেয়।
ছোট ছোট ছেলে-মেয়ে প্যান্ট, ফ্রক পরে বা নেংটা মায়ের হাত ধরে বাড়ী চলে যায়। রেশমী অনিমেষ নয়নে তাকিয়ে দেখে। এমনিভাবে ওর দিনগুলি চলে যায়। রেজা মফস্বল গেলে সাত দিনের আগে বাড়ী ফিরে না। রেশমীর ৬ মাসের বাচ্চা পেটে- শরীর, মন উভয়ই অসুস্থ। রাতদিন জল্পনা-কল্পনা তার অকাল মৃত্যু হবে। সে আর বাঁচবে না। মৃত্যু যেন তার সঙ্গে সব সময়ই আলিঙ্গন করে চলছে। শুকনো মনের বীণার তার মনের অজান্তে কোথাও যেন ছিড়ে গেছে, তা শত চেষ্টা করেও জোড়া লাগে না। যে ছিল চঞ্চল, চপল একটি দুরন্ত মেয়ে। আর সে হলো নিরিহ, শান্ত, স্তব্ধ মেয়ে। রেজা তার খুব প্রশংসা করে। কিন্তু রেশমীর মন কেঁদে কেঁদে বেড়ায়, তার হারানো সত্ত্বাকে খুঁজে পাবার জন্য। সে যেন এখানে এসে কথা বলতে পারে না, সত্য কথাও বলতে পারে না, মিথ্যা কথাও বানাতে পারে না। খেতে ইচ্ছে করে না, কোন কাজে মন বসে না, শুধু ভাবতে ভাল লাগে। কোথাও যেন কোন সুদূর পরাহত জীবনে সে ফিরে যায়- এ সব কল্পনার রাজ্য তার মনে বিস্তার করে।
মনে হয় সে একটি সুন্দরী মেয়ে, কলেজে সে পড়াশুনা করে। তার সৌন্দর্য চারদিকে বিজড়িত। কাকেও সে ভালবাসে না। তাকে কেহ ভালবাসে না। কারো ভালবাসা সে চায় না। কারো ভালবাসা সে সহ্য করতে পারে না। কারো তাচ্ছিল্য, উপেক্ষা তার জীবনে অসহ্য। এমনি ব্যক্তিত্বে, গাম্ভীর্যে ছিলো তার কৈশোরটা। তার বাবা তাকে আদর করলেও রাগ করত। মা তাকে একটু বকলে সে আর দু’একদিন ভাতই খেত না। শেষে বাবা-মা দু’জনই আদর করতো, চুমু খেত, আদর করে ভাত খাওয়াত। বাবা বলত, মেয়েটা কোথায় কার ঘরে পড়বে। আর এভাবে রাগ করলে শেষে না খেয়েই মরবে। মেয়ের কপাল নাকি বাঁদীর কপাল। রেজা রেশমীকে নিয়ে যমুনা নদীর পাড়ে যেত। নদীর কিনারায় ঘুরে বেড়াত। মুগ্ধ নয়নে ভাদ্রের ভরা নদীর নব যৌবনের দিকে তাকিয়ে থাকত। একটি স্টীমার সিরাজগঞ্জ থেকে টাঙ্গাইল আসা যাওয়া করত। অন্ধকার নদীর বুকে স্টীমারের সার্চ লাইটটা পরে নদীটা চমকে উঠত। রেশমীর ঐ আলোটা দেখে বড় রাগ হতো, সে যেন রেজাকে নিয়ে ঐ অন্ধকারে বসে থাকতে ভালবাসত।
(চলবে———)