জীবনের ডায়েরী থেকে গল্প সমগ্র : পর্ব-১৮

[ ড. টি. এন. রশীদ ]
(গত পর্বের পর) : ঔপন্যাসিকের দৃষ্টিভঙ্গি : রণক্ষেত্রের দামামা বেজে উঠলো। লক্ষ লক্ষ সিপাহী সমরাস্ত্রী, অশ্বারোহী সৈনিক ছুটে এলো উন্মত্ত আক্রোশে। বিপরীত দিক থেকেও ঝাঁপিয়ে পড়ল লক্ষ লক্ষ যোদ্ধা। এক দেশের সাথে আর এক দেশের যুদ্ধ। এক জাতির সঙ্গে আর এক জাতির। ঔপন্যাসিক তখন কোন মিনারের চূড়ায় উঠে নিবেন। সমস্ত দৃশ্য পর্যবেক্ষণ করবেন, রাজার অঙ্গে মখমলের পোষাক পরিচ্ছদ। মাথার মুকুটে মণিমুক্তা হীরার জ্যোতি। সেনাপতির দুঃসাহসিক অভিযান। সৈন্যদের চিৎকার। এসবের একটা কথাও বাদ দেবে না ঔপন্যাসিক।
লিখে নিবেন কতগুলো হাতি, কতগুলো ঘোড়া এ যুদ্ধে যোগ দিল। খুঁটিনাটি প্রত্যেকটি কথা, প্রত্যেকটি বর্ণনা নিয়ে মিলিয়ে লিখে যাবেন। যুদ্ধ জয়ের সৈন্যদল দেশে ফিরবে যখন, তখন তাদের পিছনে পিছনে ফিরবেন ঔপন্যাসিক। হর্ষধ্বনি আর উৎসবের আনন্দ ছিটিয়ে আহ্বান জানাবেন গ্রামীণ আর নগর কণ্যার দল। এ সকল বিষয়েরও বর্ণনা দেবেন ঔপন্যাসিক। যারা উলুধ্বনির আড়ালে কলরব করে উঠলো, তারপর? তারপর হঠাৎ তিনি ছোটগল্পের লেখককে দেখতে পাবেন পথের ধারে। একটি গাছের ছায়ায় বসে আছেন উদাস দৃষ্টি মেলে।
এ কোন ঔপন্যাসিক লেখক? মনে মনে ভাবলেন ঔপন্যাসিক। কোন মিনারের চূড়ায় উঠলো না, দেখল না যুদ্ধের ইতিবৃত্ত, শোভাযাত্রার সঙ্গ নিল না-এ কোন ধরনের সাহিত্যিক? হয়ত এমন কথা বলবেন তিনি ছোটগল্পের লেখককে। আর তখন দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস ফেলে চোখ মেলে তাকিয়ে থাকবেন। ছোটগল্পের লেখক বলবেন, হয়ত না, বন্ধু, এসব কিছুই আমি দেখিনি। কিছু দেখার আমার প্রয়োজন নেই, শুধু একটি দৃশ্যই আমি দেখেছি। পথের ওপারের কোন গবাক্ষের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করবেন তিনি। সেখানে একটি নারীর কাতর চোখ সমগ্র শোভাযাত্রা তন্ন তন্ন করে খুঁজেও একজনকে বের করতে ব্যর্থ হয়েছে।
চোখের কোণে যার ইত্যাকার অশ্রুবিন্দু ফুটে উঠেছে। কে যেন ফেরে নি, কে একজন ফেরে নি, ছোটগল্পের লেখক সেই ব্যথা বিন্দুর টলোমলো অশ্রুর ভেতর সমগ্র যুদ্ধের ছবি দেখতে পাবেন, বলবেন, হয়তো বন্ধু হে, ঐ অশ্রুবিন্দুর মধ্যেই আমার অশ্রুবিন্দু, অনন্ত সিন্ধু। ঔপন্যাসিকদের দৃষ্টিতে আনন্দ আছে বলেই তো শোকের ছায়া, হাসি আছে বলেই তো কান্নার গভীর অনুরণন, অনুরূপ প্রেম আছে বলেই বিরহ, বেদনা আর কান্না রোনাজল প্রেম অবিনশ্বর, প্রেম চিরন্তন, প্রেম চির ভাস্বর। গল্পকারের দৃষ্টি- ওর (প্রেমের) মাঝে আছে ওকে বাঁচিয়ে রাখার উপাদান।
হয়ত সে ততটা স্বপ্নচারিনী নয়। হয়ত বাস্তবে সে বুঝে। কিন্তু ভালবাসার জন্য সে যে কোন স্বপ্নের রাজ্যে বাস করতে প্রস্তুত। আমার মনে হয় এক ভরি সোনার চেয়ে ভালবাসার মূল্য অনেক বেশী। হয়ত এই দু’জনের মিলন এমন সন্তুষ্টি, এমন স্থায়িত্ব লাভ করবে যে, তাদের স্বপ্ন বাস্তবে রূপান্তরিত হবে। মুখ ঘুরে আমার দিকে তাকালো রূপা, ঠোঁটে তার ছোট হাসি। চোখে লুকানো কান্না। বলল, আমি জীবিত কিছুই চাইনি, শুধু ওকেই ভালোবাসতে চেয়েছি। অদৃষ্ট আমাকে তা দিয়েছে। ওর বাহুর আলিঙ্গণে আমাকে দিয়েছে প্রশান্তি। ওর হৃদয় দিয়েছে আমাকে সুখ, স্বর্গ। ভালবাসার প্রথম নির্ণায়ক নিঃস্বার্থপরতা। নিঃস্বার্থ, কখনো ভালবাসা দাবী করে না। ভালবাসা পাওয়ার জন্য নয় বরং দেওয়ার জন্য। কিন্তু নিঃস্বার্থ ভালবাসা পাওয়া খুব কঠিন। তেমনি কঠিন কাউকে স্বার্থহীন ভালবাসা।
আমাদের সমাজের এ সকল প্রেম প্রকৃতির রূপরেখা সহ বিভিন্ন বিষয়ের বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ঔপন্যাসিক উপন্যাস রচনা করে আমাদের বাস্তব ভুল-ত্রুটিগুলো তুরে ধরবে। যাতে সামাজিক সম্ভ্রম রক্ষা পায়। তাহলেই ঔপন্যাসিকের উপন্যাস লেখা স্বার্থক হবে। একজন কবি, সাহিত্যিক, ঔপন্যাসিক জাতি সত্ত্বার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে থাকেন। সুতরাং তাদের দৃষ্টিভঙ্গি সেই কেন্দ্রিক হওয়া উচিৎ।
(চলবে—-)