জীবনের ডায়েরী থেকে গল্প সমগ্র : পর্ব-০৭

[ ড. টি. এন. রশীদ ]

(গত পর্বের পর) : আমি নিজেও একজন ভাষা প্রেমী, দেশপ্রেমী। তাই আমি প্রতিবাদ মুখ হয়েছিলাম। আমার এই কবিতাটি প্রকাশের পর দেশের লোকদের মধ্যে একটা হৈ-চৈ পড়ে গেল। শত্রুরাও মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। দেশের অবস্থাটা এমন হলো যেন গরম তেলের মধ্যে একফোঁটা পানি পড়ল। তোলপাড় হল আমাকে নিয়ে। কারণ এ কবিতার রচয়িতা হলাম আমি। পুলিশ আমাকে ধরে নিয়ে গেল। পরে অবশ্য আমি আমার শারীরিক অসুস্থ্যতার কারণে ছাড়া পেলাম। কিন্তু আমার পিছনে পুলিশ ছায়র মত লেগে গেল। কোথায় যাই, কি করি, কি বলি; এমনকি বাড়ীতেও পাহারা পড়ে গেল। আমার কারণে আমার স্বামীর চাকুরীতে অনেক সমস্যা হল। কারণ তিনি তখন খুলনা জেলার ম্যাজিষ্ট্রেট ছিলেন। এ কারণে আমাকেও আমার ফাষ্ট ক্লাশ স্বামীর কথা শুনতে হয়েছে। আমার স্বামীকে খুলনা থেকে বদলি করা হয়েছে। তাঁর পদোন্নতি নিয়ে অনেক সমস্যা করেছে। আমার ছেলে-মেয়েরাও আমার এসব কাজ পছন্দ করত না। কিন্তু তবুও আমার কাজ বন্ধ রাখিনি।
২১ ফেব্রুয়ারী সারাদেশে হরতাল ডাকা হল। অবস্থা বেগতিক দেখে সরকার ২০ তারিখ সন্ধ্যায় ঢাকা সর্বত্র ১ মাসের জন্য হরতাল, সভা-মিছিল নিষিদ্ধ করে ১৪৪ ধারা জারি করে। এতে বাঁধার মুখেও একের পর এক মিছিল চলতে থাকে। হরতালও সফল ভাবে চলছিল। ঠিক এ রকম অবস্থায় পাকিস্তান সরকারের সরকারি নির্দেশে ছাত্রদের মিছিলের উপর গুলি চালানো হয়। ধুলোয় লুটিয়ে পড়ে ছালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ নাম না জানা আরো কয়েক তরুণের তাজা প্রাণ। ঢাকার রাজপথ রক্তে রঞ্জিত হলো। হত্যাকান্ডের এই খবর শহরের চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লে পরিস্থিতি মারাত্মক অবনতি ঘটে। প্রতিবাদে হাজার হাজার মানুষের মিছিল সমাবেশে ঢাকার রাজপথ প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। পূর্ববাংলার আইন পরিষদে মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ এ ঘটনার প্রতিবাদ করলে মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমিন কৌতুক করে বিষয়টি এড়িয়ে যান।
পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারী আবারো হরতাল এবং গায়েবানা জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। এ দিন সংবাদ পত্রে ৩ জন নিহত, ৩০০ জন আহত, ১৮০ জন গ্রেফতারের খবর ছাপা হয়। রেল যোগাযোগ বন্ধ থাকে, সচিবালয় কোন কাজ কর্ম হয় না। মন্ত্রীরা সব পালিয়ে সেনানিবাসে অবস্থান করে। ফলে মুসলিম লীগ সরকার পুরো বিকল হয়ে পড়ে। শেষ পর্যন্ত অত্যাচারীরা বাধ্য হয়। আমাদের ভাষা আমাদের ফিরিয়ে দিতে। রাষ্ট্রভাষা বাংলা হল। আর শহীদদের রক্ত¯œাত বলিদানের কথা স্মরণ রাখতে ২১ ফেব্রুয়ারী হল মাতৃভাষা দিবস। দেশ যখন আবার একজন যোগ্য নেতার খোঁজ করেছিল, তখনই স্বরূপে আবির্ভুত হল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিিন পাকিস্তানীদের বৈষম্যমূলক আচরণ লক্ষ্য করে তাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের নতুন পরিকল্পনা গ্রহণ করতে থাকে। এক পর্যায়ে তার কথায় সাধারণ মানুষ মুগ্ধ হয়ে গেল।
এই বাঙ্গালী নেতার সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাৎ হয় খুলনায় সার্কিট হাউজে। ১৯৭১ সাল দেশের পরিস্থিতি খুব উত্তপ্ত। ঢাকার রাজপথ, উদ্যান, সভা সমাবেশ, মিটিং মিছিলে পাকিস্তানী শাসকদের অন্যায় অত্যাচার দিনদিন বেড়েই যেতে লাগল। নিরীহ বাঙ্গালী যেন কোনঠাসা হয়ে পড়ল। এমন পরিস্থিতিতে ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে আমাদের প্রিয় বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। আজও তাঁর বজ্রকণ্ঠ আমার স্মৃতিতে ভাসে।

(চলবে——)

ফেসবুকে লাইক দিন

আমাদের সাইটের কোন বিষয়বস্তু অনুমতি ছাড়া কপি করা দণ্ডনীয় অপরাধ।