পাকিস্তান কি বোমাবর্ষণের শিকার হবে ?

সম্প্রতি একটি টক-শোতে প্রফেসর ড. কালিমুল্লাহ মন্তব্য করেছেন যে, ভারত যেকোনো মুহূর্তে পাকিস্তানের ওপর হামলা চালাতে পারে। তবে আমার বিশ্লেষণে মনে হয়, ভারত এখন, এমনকি আগামী দশ বছরেও, কোনো যুদ্ধ শুরু করার মতো অবস্থায় নেই।

যুদ্ধের সম্ভাবনা বোঝার জন্য আমাদের ভারতের অর্থনৈতিক কাঠামো এবং তাদের দুর্বলতাকে বিশ্লেষণ করতে হবে, সামরিক সক্ষমতাকে নয়। ভারতের অর্থনীতি বিদেশি বিনিয়োগের ওপর নির্ভরশীল এবং দেশটি বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ উৎপাদন কেন্দ্র। পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ শুরু হলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা তাদের বিনিয়োগ প্রত্যাহার করবে এবং নতুন কোনো বিনিয়োগ আসবে না, ফলে অর্থনীতিতে ভয়াবহ ধস নামবে।

কিছু মানুষ বলতে পারেন, ইসরায়েল একাধিক ফ্রন্টে যুদ্ধ করেও নিজের ভূখণ্ড নিরাপদ রাখতে পারছে, তাহলে ভারত কেন পারবে না? কিন্তু এই তুলনা বাস্তবসম্মত নয়। ইসরায়েলের একটি শক্তিশালী বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আছে এবং তাদের অভ্যন্তরে তেমন কোনো বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন নেই। অথচ ভারতের বিশাল ভূখণ্ড, তুলনামূলকভাবে দুর্বল বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, এবং নানা স্বাধীনতাকামী আন্দোলন — এই সবই ভারতের ভেতর থেকে যুদ্ধের সময় দুর্বলতা তৈরি করবে।

ভারতের আরেকটি বড় ঝুঁকি হলো চীনের সাথে বিশাল সীমান্ত ভাগাভাগি করা। চীন সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে না পড়ে ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলো এবং পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ করে ভারতের বিরুদ্ধে কৌশলগত সুবিধা নিতে পারে।

তদুপরি, দুটি পরমাণু শক্তিধর দেশের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধের সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ, কারণ এর পরিণতি হবে মারাত্মক। তাই বাস্তবিক অর্থে, যুদ্ধের সম্ভাবনা খুবই কম।

তবে প্রশ্ন আসতে পারে: যুদ্ধের সম্ভাবনা এতই কম হলে, ভারত কেন এমন আগ্রাসী ভঙ্গি দেখাচ্ছে? এর উত্তর নিহিত আছে রাজনৈতিক কৌশলের মধ্যে। বিশ্বে, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে, চলমান অস্থিরতা ও সংঘাতের প্রেক্ষাপটে ভারত চেয়েছিল নিজেদের অবস্থানকে ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের’ সাথে সংযুক্ত করতে। কাশ্মীরে সন্ত্রাসী হামলার চিত্র তুলে ধরে ভারত আশা করেছিল যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন অর্জন করতে, বিশেষ করে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ইরান-বিরোধী যুদ্ধ পরিকল্পনার সাথে সঙ্গতি রেখে। এতে করে তারা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চলমান বাণিজ্যযুদ্ধের চাপও কিছুটা লাঘব করতে পারতো।

কিন্তু বাস্তবে এসব প্রচেষ্টা ফলপ্রসূ হয়নি। উপরন্তু, দেশের ভেতরে হিন্দু-মুসলিম বিভাজনকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ের চেষ্টা ভারতীয় সরকারের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। এ অবস্থায় পাকিস্তান-বিরোধী আগ্রাসী অবস্থান গ্রহণ করে মোদি সরকার অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক লাভের আশায় আছে — বিশেষ করে নিজের শক্তিশালী নেতা হিসেবে ভাবমূর্তি গড়ে তুলে টানা তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার লক্ষ্যে।

সবশেষে বলা যায়, অর্থনৈতিক, কৌশলগত ও রাজনৈতিক বাস্তবতা বিবেচনায় ভারত আগামী দশ বছরে পাকিস্তানের সাথে কোনো পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে জড়ানোর অবস্থায় নেই। সীমান্তে গুলিবিনিময় বা ছোটখাটো সংঘর্ষ হতে পারে, তবে বড় ধরনের যুদ্ধের সম্ভাবনা নেই। একটি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ ভারতের অর্থনীতিতে অপূরণীয় ক্ষতি ডেকে আনবে এবং দেশটির কয়েকটি রাজ্যের বিচ্ছিন্নতার সম্ভাবনাও তৈরি হতে পারে। তাই যারা যুদ্ধের আশায় বুক বেঁধেছে, তাদের হতাশই হতে হবে — পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ আপাতত কল্পনার বাইরে।

-মাকসুদুর রহমান তুহিন
প্রভাষক (ইংরেজি),
বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামাল কলেজ
প্রাক্তন প্রভাষক, বাংলাবাজার ফাতেমা খানম কলেজ।

ফেসবুকে লাইক দিন

আমাদের সাইটের কোন বিষয়বস্তু অনুমতি ছাড়া কপি করা দণ্ডনীয় অপরাধ।