আমরা স্বাধীন হয়েছি সত্য, কিন্তু বৈষম্যমুক্ত হতে কি পেরেছি : আজাহারুল ইসলাম

স্টাফ রিপোর্টার, লালমোহন ॥ ৭৬ বছর বয়সী বীরমুক্তিযোদ্ধা মো. আজাহারুল ইসলাম। ভোলা জেলার লালমোহন পৌরসভার ৩নং ওয়ার্ড সওদাগর চৌমূহনী হাওলাদার বাড়ীর বাসিন্ধা। ১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ও নিজে সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। বর্তমানে শারীরিক ভাবে অসুস্থ্য তিনি। মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা তার সাথে তিনি যা বলেছেন তা হলো।
বীরমুক্তিযোদ্ধা মো. আজাহারুল ইসলাম বলেন, ১৯৬৮ সালে তৎকালীন পাকিস্তান পুলিশ বাহিনীতে চাকুরী হয় আমার। রাজশাহী জেলার সারদায় পুলিশ ট্রেনিং সেন্টারে ট্রেনিং শেষ করে প্রথমে ময়মনসিংহ পুলিশ লাইনে যোগদান করি। সেখান থেকে পরে টাঙ্গাইল জেলার পুলিশ যোগদান করি। ১৯৭২ সালে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর দেশমাত্রিকা ও স্বাধীনদেশের জন্য এবং পাকিস্তানিদের বিভিন্ন বৈষম্যের কারণে আমি ও আমার সহকর্মী তোফাজ্জল টাঙ্গাইল জেলার পুলিশ লাইন থেকে পালিয়ে নওগা জেলা হয়ে ভারতের মধুপুর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে যোগদান করি। সেখানকার কমান্ডার ছিলেন আঃ জলিল। আমি ও তোফাজ্জল পুলিশ বাহিনীর সদস্য হওয়ায় আমাদের কমান্ডার আমাদের দুজনকে অনান্য মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং দেয়ার জন্য নিযুক্ত করে। ৫ মাস আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র ও গোলাবারুদ চালানোসহ বিভিন্ন বিষয়ে ট্রেনিং প্রদান করি। এরপর ৭১ সালের সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে ৭নং সেক্টরের কমান্ডার ল্যাপ্টটেনেন্ট মো: নুরুজ্জামনের নেতৃত্বে হিলী এলাকায় ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাথে মিলে একত্রে পাকবাহিনীর সাথে সামনা সামনী যুদ্ধে অংশগ্রহণ করি এবং পাকবাহিনীকে পিছু হটতে বাধ্য করি। নওগাঁ মহাকুমা বদল গাছী থানা পাহারপুর হাইস্কুলে আমরা মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প করি। আমাদের সাথে মোট ১২৫জন ছিলো। নওগাঁ মহাকুমার পাহারপুর থেকে পাকবাহিনী মুক্ত করতে আমরা বিভিন্ন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করি। আমরা ছিলাম সামনের যোদ্ধা। আমাদের পিছনে থাকতো ভারতীয় বাহিনী। সেখানকার যুদ্ধে আমাদের দুজন প্রশিক্ষিত মুক্তিযোদ্ধা মৃত্যুবরণ করে। প্রায় তিন মাস সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে আমরা পুরো নওগাঁ মহাকুমা থেকে পাকবাহিনীকে বিতারিত করতে সক্ষম হই। এরপর দেশ স্বাধীন হলো। দেশ স্বাধীনের পর আমরা অস্ত্র গোলাবারুদ তৎকালীন নওগাঁ মহাকুমা অফিসে ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে জমা দেই। সেখানে আমাদের সবাইকে জয়বাংলা সাটিফিকেট দেওয়া হয়।
পাকিস্তানি পুলিশ বাহিনী থেকে পালিয়ে যাবার কারণে ১৯৭১ সালে আমাকে সাময়িক বরখাস্ত করে। আমার সার্ভিস বুকে তারা গাদ্দার লিখে রাখে। দেশ স্বাধীনের পর আমি টাঙ্গাইল পুলিশ লাইনে পূণরায় যোগদার করি এবং বাংলাদেশ সরকার আমার সাময়িক বরখাস্ত প্রত্যাহার করে নেয়। যা আমার চাকুরী খতিয়ান বইতে উল্লেখ রয়েছে। মুত্তিযুদ্ধে পুলিশের ভূমিকা বই এর তৃতীয় খন্ডে ৪৬২ পৃষ্ঠায় ক্রমিক নং ১২৮ নাম্বরে আমার নাম উল্লেখ রয়েছে। ২০০১ সালে বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনী থেকে অবসর গ্রহণ করি।
বীরমুক্তিযোদ্ধা মো. আজাহারুল ইসলাম আক্ষেপ করে বলেন, আমার সহযোদ্ধারা প্রায় সকলে মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে তালিকাভূক্ত হয়ে সরকারি সকল প্রকার সুযোগ সুবিধা ভোগ করছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় আমার নাম মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকাভূক্ত হয়নি। এজন্য আমি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে কোনো রকম সুযোগ সুবিধা পাইনি। আর পাবো কিনা সন্দেহ রয়েছে। আমি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলাম মূলত পাকিস্তানিদের বিভিন্ন বৈষম্য দূর হওয়ার জন্য এবং স্বাধীন সুন্দর বাংলাদেশের জন্য। আসলে আমরা স্বাধীন হয়েছি সত্য কিন্তু বৈষম্যমুক্ত হতে কি পেরেছি ?