মধ্যরাত : পর্ব-২৭০

ড. তাইবুন নাহার রশীদ (কবিরত্ন),

 (গত পর্বের পর) : দোলা উঠে চলে গেল। উমাও কিচেনে কি যেন কাজে উঠে গেল। আমি অনেকক্ষণ কি যেন ভাবলাম। আস্তে আস্তে রাত বাড়তে লাগল। আমি শুতে যাওয়ার জন্য উঠে পরলাম। পাশের ঘরে দোলার গলার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। উমার ঘরের কোন শব্দ নেই। রবীন্দ্রনাথ একজন বিধবাকে বনের শুভ্র বসনা রজনীগন্ধার সাতে তুলনা করেছেন। সত্যি কবিরা যত সুন্দর উপমা দিতে পারে। আমরা সাধারণ মানুষরা এক আনাও শব্দ ব্যবহার করতে জানিনা। একজন বিধবার স্বামী হারানোর কি সম্মর্তিক গভীর বেদনা। সে নিজে না হারানো পর্যন্ত অন্যেরটা উপলব্ধি করতে পারে না। ধুকে ধুকে, কুড়ে কুড়ে মনের গভীরে দুষ্ট গ্রহের মত তিলে তিলে শেষ করে একটি সাবলীল সুন্দর মনের অনুপম পুষ্প শজ্জা। এরকম পৃথিবীতে শত শত, কোটি কোটি মেয়ে স্বামী হারাচ্ছে। আর তারা নিজের বেশবাস রূপ সজ্জা ত্যাগ করে সাদা থান পড়ে, নিরাভরণ দুটি হাতে সংসারের সকল কাজে মলিন মুখে সমাধা করে যায় এখানেই নারীর মহত্ত। রাত অনেক বেড়ে চলল, এরকম অগুনতি কত কথা আমার মনের গভীরে এসে উঁকি দেয়। ঘুমের সঙ্গে আমার চিরদিনের আড়ি। রাতজাগা কতগুলো পাখির ডানা ঝাপটিয়ে উড়ে যাবার শব্দ পেলাম। জানালার ফাঁক দিয়ে অনন্ত নীল আকাশে একটি শুকতারা আমার দিকে গভীর চোখ মেলে ব্যকুল করে দিচ্ছে। আমি হেরে গিয়ে চোখ বুঝলাম। পৃথিবীতে এত প্রশ্ন ও এত ব্যথা যন্ত্রণার উত্তর আমার একলার পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়। সেরাতে আমি অনেক ঘুমিয়ে ছিলাম বোধ হয়।
ভোরের দিকে কচের ডাকে চোখ খুললাম। দাদু, দাদু আমি গভীর ঘুমের মধ্যে বললাম কি ? কি? বলল দাদু দোলার খুব শরীর খারাপ। আমি চমকে উঠলাম। তাইত, আমার দোলা অসুস্থ। তাড়াতাড়ি ঘুম ভেঙ্গে নিয়ে কাপড় পড়ে নিয়ে কচকে বললাম, ওকে তৈরী হতে বলো। উমাকে ডাকো, কচ উমার ঘরের কাছে গিয়ে বলল উমাদি, উমাদি, উঠেন, দোলার শরীর খারাপ। উমা ব্যকুল হয়ে চোখ মুছতে মুছতে দৌড়ে দোলার ঘরে এল কিরে দোলা কি ? দোলা বলল- উমাদি পেট ব্যথা, উমা নিজের জীবনে মাতৃত্বের স্বাদ না পেলেও সে সব বুঝে নিল। আমাকে বলল- প্রশান্ত দাদা মেটানিটি চল। উমার দোলার দু’চারটে কাপড় চোপড় গুছিয়ে নিল, দোলা খোড়াতে খোড়াতে নীচে নেমে গাড়ীতে উঠল। আমি গাড়ীতে উঠে স্টার্ট দিলাম অল্পক্ষণের ভিতর আমি দোলা ও উমাকে নিয়ে নার্সিং হোমে এসে পরলাম। সিষ্টাররা দোলাকে ডেলিভারি রুমে ঢুকাল। আমি হতভম্বের মত উমাকে নিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকলাম। এক সিষ্টার দোলার স্বামীর কথা জিজ্ঞাসা করল, আমি বললাম- বাড়ীতে, দোলা কচকে পাঠিয়ে দিতে। বলল আমি উমাকে নিয়ে বাসায় ফিরে এলাম। দেখলাম কচ বসে আছে। ঘড়ির কাটার দিকে চেয়ে আমি বললাম, তোমাকে দোলা যেতে বলেছে। সিষ্টারও বলল, ও লজ্জা পেল। বললাম- লজ্জার কিছুই নেই। যাও এখানেই তাই নিয়ম। স্বামী কাছে থাকলে নাকি মেয়েরা স্বস্তি ও সান্তনা লাভ করে। যদিও আমাদের দেশে মেয়েরা লজ্জা পায়। কচ কাপড় চোপড় পরে তৈরী হল। আমি বললাম- উমা নাস্তা দাও, কচ সেরকম কিছু খেলনা। আমি কিছু মুখে দিয়ে কচকে মেটানিটিতে নামিয়ে দিয়ে বাসায় ফিরে এলাম। নিজের ঘরে কিচু খুটিনাটি কাজ সারলাম। উমা তার কিচেনের কাজ-কর্ম গুছাতে লাগল। মনটা আমার বড় ব্যকুল উচাটন। তবু দুর্বল হলে চলবেনা। মেয়েটার আমি ছাড়া ওর আপন কেহ নেই। স্বামী ছেলে মানুষ, কি-ই-বা বুঝে। তবু দেখলাম চিন্তিত, বউকে ভালবাসে। এটুকু যা শান্তি পাই।
আমি ইউনিভার্সিটি যাওয়ার পথে দেখে যাওয়ার জন্য মেটানিটিতে গেলাম। ডাক্তারের সাথে, সিষ্টারের সাথে আলাপ করলাম। বলল- নর্মাল ডেলিভারি হবে, সবই স্বাভাবিক; তবে ব্যথাটা কম। ব্যথার স্যালাইন দেবে, বেশি দেরী করবে না। ব্যথা না বাড়লে সিজারিন করবে। আমি ভার্সিটি থেকে একটু ঘুরে আসার জন্য মনস্থির করে ফেললাম। গাড়ীতে উঠে ড্রাইভ দিতে যাব, তখনই কচ বলল- দাদু আপনাকে ডোলা ডাকে। আমি তাড়াতাড়ি চলে এলাম, কিরে দোলা কিছু বলবি ? দাদু তুমি যেওনা। আমি হেসে ফেললাম, ভয় কি ? ও কিচ্ছু না, হাজার হাজার মেয়ে মা হচ্ছে। আর তুই এত বড় ডাক্তার খানায় থেকে এত বড় উচ্চ শিক্ষিত ডাকআতর। সিষ্টার এর তত্বাবধানে থেকে ভয় পাচ্ছিস ? তাহলে আমাদের দেশের মা-বোনেরা কি করবে ? কোন ভয় নেই, দোলা বলল- না দাদু তুমি যেওনা আমার ভয় হয়।

(চলবে——–)

ফেসবুকে লাইক দিন

আমাদের সাইটের কোন বিষয়বস্তু অনুমতি ছাড়া কপি করা দণ্ডনীয় অপরাধ।