চরের মানুষের জীবন : পর্ব-৩

স্বাস্থ্য সেবা থেকে বঞ্চিত চর কচুয়াখালীর নারী-পুরুষ ও শিশুরা

চরের মানুষের জীবন : পর্ব-৩

জাহিদ দুলাল ॥ স্বাস্থ্য সেবা মানুষের মৌলিক অধিকার। তবে এ অধিকার থেকে বঞ্চিত ভোলার লালমোহন উপজেলার পশ্চিম চরউমেদ ইউনিয়নের তেঁতুলিয়া নদীর বুকে জেঁগে ওঠা বিচ্ছিন্ন দ্বীপ চর কচুয়াখালীর হাজার হাজার মানুষ। এ চরের অন্তত পাঁচ হাজার মানুষের জন্য নেই কোনো স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্র। যার ফলে বছরের পর বছর ধরে চরের বাসিন্দারা এক প্রকার প্রকৃতির ওপর ভরসা করেই বেঁচে আছেন। এই ভরসাই যেন তাদের বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা জোগায়।
সরেজমিনে চর কচুয়াখালীতে গিয়ে দেখা যায়, জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি কী, সেটিই জানেন না এই চরের অধিকাংশ নারীরা। গর্ভকালীন সময়ে করণীয় ও বর্জনীয় সম্পর্কেও নেই তাদের প্রয়োজনীয় ধারণা। বংশপরম্পরায় দাদি-নানিদের কাছ থেকে যা জেনেছেন তা নিয়েই চলছে এই চরের নারীদের জীবন। বিচ্ছিন্ন চর কচুয়াখালীর প্রতিটি পরিবারে তিন থেকে পাঁচজন করে সন্তান রয়েছে।
চরের আবাসনের বাসিন্দা চার সন্তানের জননী বিবি আয়েশা ও তিন সন্তানের জননী বিবি কুলসুম বলেন, এই চরে কোনো চিকিৎসা কেন্দ্র নেই। যার জন্য কেউ গুরুতর অসুস্থ্য হলে খেয়ায় করে নদী পার হয়ে যেতে হয় লালমোহন উপজেলা সদরে। প্রতিদিন সকাল ৯ টায় খেয়া ছেড়ে যায় উপজেলার মূল ভূখন্ড গজারিয়া খালগোড়া এলাকার উদ্দেশ্যে। ওই খেয়াটি আবার বিকাল ৩ টায় গজারিয়া থেকে চরের উদ্দেশ্যে ছেড়ে আসে। যার জন্য সকাল ৯ টার খেয়ায় কেউ যেতে না পারলে পরদিন ছাড়া আর এই চর থেকে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। খুব জরুরী প্রয়োজনে যেতে হলে রিজার্ভ ট্রলার নিতে হয়। যাতে অনেক খরচ। চরের অধিকাংশ পরিবারই দরিদ্র।


তারা আরো বলেন, যদি কোনো গর্ভবতী মায়ের দুপুর বেলায় প্রসব বেদনা উঠে এবং দ্রুত চিকিৎসকের কাছে নেওয়ার প্রয়োজন হয় তাহলে পরদিনের খেয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হয়। এর মাঝের সময় কেবল আল্লাহর ওপর ভরসা করেই কাটাতে হয়। প্রসূতি মায়েদের এমন কষ্ট ভোগ করতে হচ্ছে বছরের পর বছর ধরে। এছাড়া এ চরের শিশুরা বঞ্চিত হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের টিকাগ্রহণ থেকেও। যার জন্য নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরা। প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে শিশুদের স্বাভাবিক বৃদ্ধিতেও। তাই এই চরে একটি স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্র স্থাপন করার দাবি জানাচ্ছি।
বিচ্ছিন্ন চর কচুয়াখালীর বাসিন্দা মো. জাহাঙ্গীর, জসিম এবং মো. রহিম জানান, চরে বসতি শুরু হওয়ার প্রথম কয়েক বছর এখানের মানুষজন অসুস্থ্য হলে সুস্থতার জন্য মসজিদের ইমামের কাছ থেকে ঝাঁড়ফুঁক নিতেন। তবে গত পাঁচ বছর আগে চরের কিল্লার ওপর একটি ওষুধের দোকান (ফার্মেসী) হয়েছে। ওই দোকানের মালিকই এখন আমাদের চরবাসীর চিকিৎসা সেবায় ভরসা। তিনি সাধ্যের মধ্যে চরবাসীকে সেবা দেওয়ার চেষ্টা করেন। যেসব সেবা তার সাধ্যের বাহিরে সেগুলোর জন্য তিনি মানুষজনদের ভালো চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার পরামর্শ দেন। চর কচুয়াখালীর হাজার হাজার মানুষের স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিতের জন্য আমরা এখানে একটি স্বাস্থ্য কেন্দ্র স্থাপন করে সেবা কার্যক্রম চালুর জোর দাবি জানাচ্ছি।
ওষুধের দোকানদার মো. ইউনুছ বলেন, নদীতে বাড়ি ভেঙে যাওয়ায় গত পাঁচ বছর আগে এই চরে আসি। এসে নিজ চোখে দেখেছি অসুস্থতায় চরের মানুষের কষ্টের দৃশ্য। চরবাসীর চিকিৎসা সেবা দেওয়ার জন্য আমি তিন মাসের প্রশিক্ষণ নিয়ে একটি ওষুধের দোকান শুরু করি। এখানে কোনো কোম্পানির লোকজন আসে না। যার জন্য নদী পার হয়ে উপজেলা সদর থেকে ওষুধ আনতে হয়। এতে করে খুব দরকারি ওষুধ আনতেও একদিনের মতো সময় লাগে। এছাড়া আমি তো আর সব চিকিৎসা করতে পারি না। যার জন্য অনেক সময় রোগীদের উপজেলা সদরের ডাক্তারদের কাছে পাঠাই। এতে করে চরের অসহায়-দরিদ্র মানুষদের অনেক দুর্ভোগে পড়তে হয়। তাই সরকারিভাবে দ্রুত সময়ের মধ্যে এখানে যদি একটি স্বাস্থ্য কেন্দ্র স্থাপন করা হয় তাহলে চরবাসীর স্বাস্থ্য সেবার মতো মৌলিক অধিকারটি নিশ্চিত হবে।


এ বিষয়ে লালমোহন উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা (ইউএইচএফপিও) ডা. মো. তৈয়বুর রহমান জানান, আমরা চাই প্রতিটি মানুষের স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত হোক। এরই ধারাবাহিকতায় দুর্গম ওই চরের মানুষের স্বাস্থ্য সেবার জন্য একটি কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন করা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে চরের বাসিন্দাদের মধ্যে কেউ জমি দান করতে হবে। জমি দান করলে সে অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট দপ্তরে ওই চরে কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপনের জন্য আমরা প্রস্তাব পাঠাবো। ওই প্রস্তাবনা অনুমোদন পেলে চর কচুয়াখালীর মানুষের স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিতের জন্য একটি কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন করা হবে।

ফেসবুকে লাইক দিন

আমাদের সাইটের কোন বিষয়বস্তু অনুমতি ছাড়া কপি করা দণ্ডনীয় অপরাধ।