মধ্যরাত : পর্ব-২৩৭

ড. তাইবুন নাহার রশীদ (কবিরত্ন),
(গত পর্বের পর) : আমি বললাম না, না; কখন আমার কষ্ট হবে না। তোমার এত জ্বও তোমার কষ্ট হচ্ছে না ? না না, আমি আপনাকে কষ্ট দিতে চাই না। আমি আর থাকতে পারলাম না, থার্মোমিটার লাগিয়ে উমার জ্বর মাপলাম। দেখলাম জ্বর ১০৫ ডিগ্রী, আমি বার বার ভাল করে দেখলাম। ঘরে পুরানো একটা আইসব্যাগ ছিল ফ্রিজ থেকে বরফ বের করে মাথায় আইস ব্যাগ ধরলাম। উমা প্রলাপ বকতে আরম্ভ করল। সুশান্ত তুমি এসেছ ? এতদিন কোথায় ছিলে ? আমাকে ভুলে যাওনি-ত ? এস ? বস আমি বললাম, কি এসব বলছ। মাথায় আইস ব্যাগটা ভাল করে ধরে রাখলাম। উমা আবার ভুল বকতে শুরু করল। সুশান্ত তুমি যেওনা, আমাকে একা ফেলে যেওনা। আমার কেও নেই, আমি যে বড় একা সুশান্ত।
আমি আর স্থির থাকতে পরছি না। আমার দু’চোখের পানি দু’গাল উপছে পরছে। ফুলে ফুলে আমি ছেলে মানুষের মত কাঁদলাম। তখন রাত ম্যধরাত হবে, নিঝুম দুনিয়া নিরব হয়ে যেন উমার কথায় সেও ফুলে ফুলে কাঁদছে। ভোরের আলো আসার তখনও অনেক দেরী আছে। বাড়ীর অনেক দিনের পুরোন খুব কালো বিড়ালটা মিউ মিউ করে কাঁদছে। চোখ দুটু অন্ধকারে জল জল করে জ্বলছিল। আমি ওটাকে দেখে ভয়ে আঁতকে উঠলাম। এ-কি এত কালো সর্বনাশী বিড়ালটা ওটাকে আমি সুশান্ত মরার আগে, ও যখন হাসপাতালে ছিল, তখন দেখেছি। আজ আবার ওটা কোথা থেকে এতরাতে এখানে এ ঘরে উপস্থিত। এমনি নানা কথা নানা ভাবনা আমার মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল।
উমা জ্বরের তাপে প্রলাপ বকা বন্ধ হয়ে আচ্ছন্নের মত পরে রইল। আমি ওর মাথায় বরফ ধরে রাখলাম। আইস ব্যাগটা বোধ হয় একটু লিক ছিল তবু কাজ চলে যাচ্ছে, থার্মোমিটার দিয়ে জ্বর মেপে দেখলাম, এত এত চেষ্টা; এত পরিচেষ্টার পরও মাত্র জ্বও ১০৪ এসেছে। বললাম, কিযে ব্যাপার সাংঘাতিক ব্যাপার। এত আইস ব্যাগ লাগিয়ে তবুও জ্বর চার এর নীচে নামছে না। এই নিস্তব্ধ বাড়ীটায় উমা, আমি, হেমন্ত বেলাই চলে গেল। রাত ভোর হয়ে এল। পাখির কিচির মিচির শব্দে তবু যেন আমার মনে একটু সাহস এল। উমার মাথায় আইস ব্যাগটা লাগিয়ে রেখে আমি উঠে বাথরুমে গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে ফিরে এলাম। উমা তখন চোখ খুলে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছিল। আমি আগ্রহ সহকারে বললাম, উমা কিছু খাবে ? জল খাবে ? উমা বলল, অতিক্ষীণ স্বরে একটু জল, আমি তাড়াতাড়ি গ্লাসে করে জল এনে দিলাম। উমা মাথা তুলে ঢক ঢক করে জলটুকু একচুমুকে খেয়ে ফেলল। বললাম, কিছু বলবে ? বল, কি তোমার অসুবিধা। কোথায় তোমার কষ্ট হচ্ছে। ও বলল, দাদা আমার গা পুড়ে যাচ্ছে। আমার শরীর জ্বলে যাচ্ছে, আমার বড় কষ্ট। আমি বললাম, ভাল হয়ে যাবে। কিচ্ছু হবে না।
দরজায় বেল বেজে উঠল। আমি দরজা খুলে দেখলাম হেমন্ত দাঁড়িয়ে আছে। বলল, মাসিমা কেমন আছেন। বললাম, ভীষণ জ্বর, সারারাত আইস ব্যাগ ধরে বসে ছিলাম। শুধু প্রলাপ বকেছে, হেমন্ত অস্থির হয়ে উঠল। দেখি দেখি বলে উমার ঘরে ঢুকে কপালে হাত রাখল। উমা চোখ তুলে হেমন্তকে দেখল। বলল আমার বড় কষ্ট বাবা। হেমন্ত বলল, ভাল হয়ে যাবে। আমি তাড়াতাড়ি নাশতা খেয়ে নিয়ে ডাক্তারের কাছে ফোন করলাম, কখন উমাকে নিয়ে আসতে পারি, ডাক্তারের সেক্রেটারী ফোন ধরে আমাকে বেলা ১২টায় যেতে বলল। দেখলাম যে বড্ড দেরী হয়ে যাচ্ছে, আমি ওকে ইমার্জেন্সিতে নিয়ে যাবার জন্য মনস্থ করে ফেললাম। হেমন্তও এসে পরেছে, বললাম হেমন্ত তুমি উমাকে ধরে আমার গাড়ীতে নিয়ে পিছনের ছিটে বস, আমি ড্রাইভ করছি। হেমন্ত উমাকে বলল, মাসিমা আপনি একটু উঠে বসুনত ?। উমা অনেক কষ্টে উঠে বসল। জ্বরে চুলগুলি বালিশেল ঘসায় ঘসায় জট পাকিয়ে গেছে। মুখ খানা সাদা পাংশুটে হয়ে গেছে। চেখদুটি যেন রক্তশূণ্য। তবু হেমন্ত উমার ঘর থেকে একখানা চিরুনী নিয়ে নিজ হাতে চুলগুলি পরিপাটি করে নিল। উমা বার বার বলছিল দাও, হেমন্ত দাও, আমি নিজে চুল আচড়াতে পারব। হেমন্ত বলল মাসিমা, আমি দেখতে পারছি অসম্ভব জ্বরে আপনার হাতদুটু থর থর করে কাঁপছে।
(চলবে——-)