চলছে জাটকাসহ বিভিন্ন মাছের পোনা নিধনের মহোৎসব
ভোলার নদীগুলোতে নিষিদ্ধ জালের ছড়াছড়ি

এইচ এম জাকির ॥ ভোলার মেঘনা ও তেঁতুলিয়া নদীতে বাধাজাল, খুটাজালসহ বিভিন্ন ধরনের নিষিদ্ধ জালের ছড়াছড়ি। এ সব জালে প্রতিদিন শত শত মন জাটকা ইলিশ ও ইলিশের রেনুপোনাসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছের পোনা ধ্বংস হচ্ছে। এতে একদিকে যেমন নদীতে ইলিশের বংশ বিস্তার ব্যাহত হচ্ছে, অন্যদিকে মারা যাচ্ছে দেশীয় বিভিন্ন প্রজাতির মাছের রেনুপোনা। অভিযোগ রয়েছে প্রভাবশালী একটি মহল কোস্টগার্ড ও প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই এ জাল ব্যবহার করে ধ্বংস করছে দেশের মৎস্য সম্পদ।
সরেজমিনে দেখা যায়, ভোলা সদর উপজেলার ইলিশা ইউনিয়নের ভাংতিরখাল ও কাচিয়া ইউনিয়নের কাঠিরমাথা নামক এলাকার মেঘনা নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে রয়েছে শতাধিক বাধাজাল। যার মধ্যে আটকা পড়ে যেকোন মাছের রেনুপোনা, এমনকি মাছের ডিম পর্যন্ত আটকা পড়ে এ সকল জালে। পাশাপাশি রয়েছে খুটি জাল। নদীতে খুঁটি গেড়ে তার সাথে ক্ষুদ্র ছিদ্র বিশিষ্ট মশারি জালের মতো একটি বিশেষ জাল বেঁধে নদী থেকে কাচিয়ে তোলা হচ্ছে সকল ধরনের মাছ ও মাছের পোনা। এ জালটি শুস্ক মৌসূমে নদীর পানি কমে যাওয়ায় বিভিন্ন স্থানে জেগে ওঠা ডুবোচরগুলোর কয়েক কিলোমিটার জুড়ে খুঁটি গেড়ে এর সাথে জাল বেধে রাখা হয়। জোয়ারের সময় ওই চরে জমে থাকা পলিতে ইলিশ, পোয়া, বেলে ও চিংড়িসহ দেশীয় প্রজাতির বিভিন্ন ধরনের মাছ ও মাছের পোনা চলে আসে। এরপর ভাটা হওয়ার মূহুর্তে নিচে থাকা জালগুলেকে প্রতিটি খুটির উপরের অংশে বেধে দেয়া হয়। এরপর ভাটার সাথে পানি নেমে জালে আটকা পড়ে ঝাকে ঝাকে জাটকা ইলিশ, ইলিশের পোনা (চাপলি মাছ) সহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছের পোনা।
সাধারণ জেলেরা বলছেন, প্রতিবছর শুস্ক মৌসূমে ক্ষমতাসীন দলের কিছু প্রভাশালী কয়েকজন মৎস্য ব্যবসায়ী মেঘনা নদীর বিভিন্ন স্থানে খুঁটাজাল ও বাধাজাল নামের বিশেষ এ ধরনের নিষিদ্ধ জাল ব্যবহার করে নদী থেকে প্রতিদিন মনকে মন জাটকা ইলিশসহ ইলিশের পোনা (চাপলি মাছ)সহ বিভিন্ন ধরনের মাছের রেনুপোনা ধরা হচ্ছে।
ধনিয়া কাঠিরমাথা এলাকার জেলে মহসিনের সাথে কথা হলে তিনি জানান, আমাদের মতো সাধারণ জেলেদের বেলায় আইনের অভাব নেই। আমরা সামান্য ২ হাজার টাকার কারেন্ট জাল ব্যবহার করলেও প্রশাসনের লোকজন আমাদের জালগুলো ধরে মুহুর্তের মধ্যেই সেগুলো আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। অথচ নদীতে বড় বড় মিয়া-ভুইয়াদের নিষিদ্ধ জলগুলো তাদের চোখে পড়ে না ?
নদীতে নিষিদ্ধ জালের ক্ষতিকর দিক তুলে ধরে ধনিয়া ইউনিয়নের তুলাতুলি এলাকার বশার মাঝি বলেন, নদীর মধ্যবর্তী সিমানার ডুবোচরগুলোর প্রায় ৩ থেকে ৪ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে ২৫-৩০ ফুট লম্বা খুটি গেথে এরসাথে বেধে দেয়া হয় জাল। জোয়ারের পানিতে পুরো চরটা ডুবে গেলে ওই চরে জমে থাকা মিষ্টি পলিমাটি খেতে আসা ইলিশ ও জাটকা ইলিশ, পোয়া, বাটা, বেলেসহ দেশীয় সকল প্রকার মাছ ও মাছের রেনুপোনা এসকল চরগুলোতে আশ্রয় নেয়। এরপর ভাটার ¯্রােতের সাথেই মাছগুলো ওই জালে আটকা পরে। তাছাড়া বেড়িকেট দেয়া জালের জন্য চরে আসা মাছগুলো অন্যত্র যেতে না পেরে ওই চরের সামন্য পানিতে ছুটোছুটি করে। ওই পানি থেকে মুসুরি জালের মাধ্যমে সকল প্রকার মাছের মাছ, মাছে পোনা পানি ছেকে তুলে আনা হয়।
একই এলাকার শাহাবুদ্দিন মাঝি বলেন, খুটি জলের চেয়ে আরো ভয়াবহ হচ্ছে বাধাজাল। যার মধ্যে মাছের রেনুপোনাসহ মাছের ডিম পর্যন্ত আটকে পড়ে। এই জালের মাধ্যমে পুরো নদী থেকে সকল ধরনের মাছ ছেকে ধরা হয়। যেগুলো খাওয়ার উপযোগী সেগুলো রেখে বাকি সকল ধরনের মাছের রেনুপোনা ফেলে দেয়া হয়।
নদীর জন্য এ জাল অত্যান্ত ক্ষতিকর বলে ইলিশা এলাকার নুর ইসলাম মাঝি বলেন, ৫ লাখ মিটার কারেন্ট জাল নদীর যতটুকু ক্ষতি করতে পারে তার চেয়ে কয়েক গুন বেশি ক্ষতি করছে খুঁটা জাল ও বাধা জাল। আমাদের মতো সাধারণ জেলেরা হয়তো কিছু কারেন্ট জাল ব্যবহার করলেও কারেন্ট জালে রেনুপোনা ধ্বংস করে না। বড় ইলিশের পাশাপাশি এ জালে আটকা পড়ে কিছু জাটকা ইলিশ। কিন্তু বড় বড় মিয়দের বাধাজাল, খুটিজাল শুধু জাটকা ইলিশই নয়, এ জাল দিয়ে সকল ধরনের মাছ ও মাছে রেনুপোনা নিধন করা হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক জেলে পেশার লোকজন বলছেন, চাচা-ভাতিজা মিলে নদীটা খেয়েছে গিলে। ইলিশা ভাংতিরখাল নামক এলাকার পুরো মেঘানা নদী দখল করে স্থানীয় ইউপি সদস্য ফারুক ব্যাপারী ও তার ভাতিজা একই ইউনিয়নের ইউপি সদস্য ফরিদ দুজনই হচ্ছে অত্র অঞ্চলের নিষিদ্ধ জালের জনক। এদের মতো এ ধরনের নিষিদ্ধ জাল ব্যবহার করছেন পাশের ইউনিয়ন কাচিয়া কাঠির মাথা নামক এলাকার পলাশ মুরাদার ও হাসেম ব্যপারী। প্রকাশ্য দিবালকে নদীতে নিষিদ্ধ বাধাজাল, খুটিজাল বসিয়ে পুরো নদী দখল করে রেখেছে। কোস্টগার্ড ও মৎস্য কর্মকর্তাদেরকে ম্যানেজ করেই রীতি মতো তারা এ ধরনের নিষিদ্ধ জাল ব্যবহার করছেন বলে অভিযোগ পুরো জেলা পড়ায়।
সাধারণ জেলেদের পাশাপাশি একই কথা বলছেন স্থানীয় মৎস্য ব্যবসায়ীরা। তারা কোস্টগার্ড ও প্রশাসনের নিরব ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলছেন, অধিকাংশ সময়ই নদীতে কোস্টাগার্ড সদস্যরা নেমে ছোট ছোট কারেন্ট জাল ধরে বাহবা নিচ্ছে। অথচ যে সকল জাল ইলিশের পোনাসহ সকল ধরনের মাছের রেনুপোনা ধ্বংশ করছে সে সব জাল ধরার বিষয়টি কখনো তাদের চোখে পরেনা।
মৎস্য ব্যবসায়ী শাহাবুদ্দিন মিয়া বলেন, এ সময় নদীতে ইলিশের পোনা সহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছের পোনা বৃদ্ধি পায়। তাই এ সময় গুলোতেই নদীতে ব্যবহার করছে ক্ষমতাশীন দলের প্রভাশালী মৎস্য ব্যবসায়ীদের নিষিদ্ধ জাল। এ সব নিষিদ্ধ জালের বিষয়ে কোস্টগার্ড ও মৎস্য কর্মকর্তাদের জানানো হলেও তাদের পক্ষ থেকে তেমন কোন ব্যবস্থা নেয়া হয় না।
যদিও কোন জেলে ও মৎস্য ব্যবসায়ীরা বলছেন ভিন্ন কথা, তৎকালীন জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোল্লা মোঃ এমদাদউল্লাহ থাকা কালীন সকল ধরনের নিষিদ্ধ জালের বিরুদ্ধে নদীতে কঠোর অভিযান করা হয়েছে। তখন প্রতিনিয়ত অভিযানের মধ্য দিয়ে পুরো মেঘনা ও তেঁতুলিয়া নদীতে থেকে পুরোপুরো ভাবে নিষিদ্ধ জাল উৎখাত করা হয়েছে। ওই কর্মকর্তা ভোলা থেকে অন্যত্র বদলী হতেই পুরো নদী জুড়ে আবার শুরু হয়েছে নিষিদ্ধ জালের ব্যবহার।
শুধু ভোলা সদর উপজেলাই নয়, এ ধরনের নিষিদ্ধ জালের ব্যবহার দেখা গেছে, দৌলতখান, বোরহানউদ্দিন, লালমোহন, তজুমদ্দিন ও চরফ্যাশন উপজেলার মেঘনা ও তেঁতুলিয়া নদীতে। প্রতি বছরের অক্টোবর থেকে নভেম্বরের এ সময়গুলোতে ইলিশের প্রজনন সময় নদীর অভয়াশ্রমে ডিম ছাড়ার জন্য সাগর থেকে মা ইলিশগুলো নদীতে চলে আসে। সে সময় থেকে টানা চার মাস ওই মাছের রেনুপোনাগুলো বৃদ্ধি পেয়ে পুর্ণাঙ্গ রূপ নেয়। তাই বর্তমানের এই সময়গুলোতে পুরো নদী জুড়ে থাকে ইলিশের পোনাসহ বিভিন্ন প্রজাতিক মাছের পোনার অবাদ বিচরণ। ঠিক এই সময়গুলোকেই বেছে নিয়ে কিছু অসাধু মৎস্য ব্যবসায়ীরা নিষিদ্ধ জাল দিয়ে নদী থেকে ধ্বংস করছে ইলিশের পোনাসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছের পোনা।
এ ব্যপারে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ বলেন, নদীতে যে কোন ধরনের নিষিদ্ধ জালের বিরুদ্ধে তাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। এ যাবত তারা বাধাজাল, খুটিজাল সহ অশংখ্য নিষিদ্ধ জালের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে নদী থেকে এ ধরনের জাল উৎখাত করতে সক্ষম হয়েছেন। এরপরও তাদের অজান্তে কোন কোন জেলে ও মৎস্য ব্যবসায়ীরা যদি এ ধরনের নিষিদ্ধ জাল ব্যবহার করে থাকে এমন কোন অভিযোগ পাওয়ার সাথেই আমরা সেই সকল জালের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে নদী থেকে তুলে এনে তা আগুনে পোড়ানো হবে বলে জানান তিনি।