সর্বশেষঃ

মধ্যরাত : পর্ব-১১২

ড. তাইবুন নাহার রশীদ (কবিরত্ন), 

(গত পর্বের পর) : আমার এই ভাবে ওকে খবরটা দেওয়া বোধ হয় উচিত হয়নি। আমি মহা চিন্তায় পরে গেলাম। আবার ডোরা না বিদায় নেয়। মেয়েরা চিরকালেই খুব সেন্টিমেন্টাল। দোলাকে ডাকলাম, দোলা কাছে এল। বললাম, ডোরা ফোন করেছিল, ওকে সুশান্তর মৃত্যুও খবর দিলাম। হঠাৎ ডোরার হাত থেকে রিসিভার পরে যাওয়ার শব্দ শুনলাম। ও বোধ হয় মনে খুব আঘাত পেয়েছে, তুই কিছুক্ষণ পর ওকে বুঝিয়ে শুঝিয়ে ফোন করিস। দোলা বলল আচ্ছা দাদু। তোমার ইউনিভার্সিটির প্রফেসার ও তার স্ত্রীরা সকলেই এখন নিজেরদের বাড়ীতে গিয়েছে। কতদিন আর বন্ধু-বান্ধবরা নিজের বাড়ী-ঘর ছেড়ে তোমার বাড়ীতে পরে থাকবে ? তুমি প্রায় সপ্তাহ খানেক ভার্সিটিতে যাওনি, এখন যেতে হবে। সন্ধ্যার দিকে দোলাকে বললাম। দোলা কাল সকালে দুটো ডাল-ভাত ফুটিয়ে দিস আমাকে ইউনিভার্সিটিতে যেতে হবে। দোলা ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাল।
সন্ধ্যার সময় আবার ফোন বেজে উঠল। দোলাই ফোন ধরল যা বুঝলাম ডোরার ফোন। দোলা ধীরে সুস্থে সুশান্তর পরলোকে চলে যাওয়ার খবরা-খবর দিল। দোলা সুশান্তর কথা বলতে বলতে কাঁদ কাঁদ হয়ে গিয়েছিল। কণ্ঠস্বও বন্ধ হবার মাঝে মাঝে উপক্রম হয়েছিল। তবু দোলা যতদুর সম্ভব ডোরাকে সুশান্তর সব খবরা-খবর দিল। আমার আর কারও সাথে কথা বলার স্পৃহা নেই। সুশান্ত যেন আমার হৃদয়টাকে দুমড়ে-মুচড়ে দিয়ে গেছে। নিজেও চলে গেল, আমাকেও জ্যান্ত অবস্থায় মেরে রেখে গেল। আমি আবার নিয়ম মাফিক ভার্সিটি আসা-যাওয়া করতে লাগলাম। বন্ধু-বান্ধবরা অনেক আশ্বাসের কথা বলে। কিন্তু সমস্ত পৃথিবী তন্ন তন্ন করে খুঁজে সুশান্তর মত এত দিল খোলা, প্রাণ খোলা, উদার-উজার, হৃদয় ঢেলে দূরের মানুষকে কাছে এনে ভালবাসতে দেখিনি। আমার নিজের ভাইকে আমি এত ভালবাসতে পারতাম না। সুশান্ত সেই কলেজ জীবন থেকে আরম্ভ করে আমাকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ভালবেসে গেছে।
উমা খুব চুপচাপ থাকে। মাঝে মাঝে খুব কাঁদে। বড় কষ্ট হয় উমার এই বৈধব্য জীবন দেখে। হঠাৎ ফোন পেলাম। উমার ছোট ভাই কলকাতা থেকে আগামী দিন বৃটিশ এয়ার ওয়েজে আসছে। ওর দেবরদের আজ পর্যন্তও কোন খোঁজ-খবর পেলাম না। বৃটিশ এয়ার ওয়েজে ফ্লাইট নং জানিয়েছিল। আমি সেই টাইমে মিরাবেল এয়ারপোর্ট এ গেলাম। সেদিন জানি আর কি একটা ছিল, বৃটিশ এয়ার ওয়েজ। এয়ার কানাডা, ফ্রান্সের একটা প্লেন, কিছুক্ষণ আগে পরে ৩টা প্লেনের যাত্রীদের ভীষণ ভীড়। এত লোক আমি এত বছর এই মন্ট্রিলে আছি এত প্যাসেঞ্জার সেদিনের মত আমি কোনদিন দেখিনি। প্রথম এয়ার কানাডার প্যাসেঞ্জাররা লাইনে দাঁড়িয়ে পাসপোর্ট চেক করাচ্ছে। তারপর আর এক লাইনে বৃটিশ এয়ার ওয়েজ। এত ভিড়ের মধ্যে উমার ভাইকে আমি চিনব কি করে ? নাম শুনলাম প্রাসাদ। কিন্তু প্যাসেঞ্জারদের পাসপোর্ট টিকেট সব চেক করা শেষ হয়েছে। সকলেই এখন বেরিয়ে আসছে। একটি ছেলে মনে হল ইন্ডিয়ান প্যান্ট-শার্ট পড়া খুবই সুন্দর। মুখ খানা যেন ভগবান নিজ হাতে গড়েছেন। বড় বড় চোখ, টানা জোড় ভ্রুরু, উন্নত নাসিকা, কোন ব্রাহ্মণের ছেলে হবে। ছল ছল চোখ এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। আমি লজ্জা-শরম সব ত্যাগ করে বললাম, হ্যাঁলো- আপনি কি কলকাতা থেকে এসেছেন ? হ্যাঁ, আচ্ছা প্রশান্ত বাবু নামে এখানে কেউ এসেছেন ? আমি বললাম, আমি-ই প্রশান্ত। ছেলেটির সাথে হাত মিলালাম। ছেলেটিকে বললাম, আসুন।
ওকে ওর মালপত্র সহ গাড়ীতে তুললাম। প্রায় ১ঘণ্টার কম সময় লাগল ওকে গাড়ীতে নিয়ে আমার শালভাদরের বাসায় আসথে। উমাকে আগেই জানিয়েছিলাম। কলকাতা থেকে প্রাসাদ আজ আসবে। উমা শুনে খুব মস্ত বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। চোখ দুটো জলে ভরে উঠেছিল। শুধু বলল, প্রশান্ত দা, এয়ারপোর্ট যাচ্ছেন-ত ? বললাম, সুশান্ত বেঁচে থাকলে আজ খুশী হত। ও উঠে অন্যদিকে প্রস্থান করল। সুশান্তর কথা উঠলে সহ্য করতে পারে না। ও মুর্ছা যায়। সে জন্য পারত পক্ষে আমরা কমই তুলি। আমিও হঠাৎ ভাবা বেগে বলে ফেললাম। সে জন্য আমি খুব দুঃখিত হলাম। উমা কাঁদুক, এ আমি কোন ক্রমেই চাই না।

(চলবে——-)

ফেসবুকে লাইক দিন

আমাদের সাইটের কোন বিষয়বস্তু অনুমতি ছাড়া কপি করা দণ্ডনীয় অপরাধ।