দায় নিতে চায় না কেউ

বিদ্যুৎ স্পৃষ্টে জীবন-মৃত্যু সন্ধিক্ষণে শিশু মহুয়া

এইচ এম নাহিদ ॥ আড়াই বছরের কণ্যা মহুয়াকে নিয়ে জান্নাত বেগম শহরের এক বীমা কোম্পানীতে মিটিং করছেন। শিশু মহুয়া মায়ের আচল ছেড়ে খেলতে খেলতে বারান্দায় গেলে ১১ হাজার কেভির হাইভোল্টেজ বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে যায়। ৩০ সেকেন্টের মাথায় ৪ তলা ভবন থেকে রাস্তায় একটি রক্ষিত মটর বাইকের উপর পড়ে। এই রিপোর্ট লিখা পর্যন্ত শিশু মহুয়া শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ণ ও প্লাস্টিক সার্জারি ইন্সটিটিউটের আইসিইউ বেডে জীবন মৃত্যু সন্ধিক্ষণে রয়েছে। শিশু মহুয়ার এই নির্মম পরিণতি থেকে সেদিন রাস্তার পথচারিরাও কেঁদেছে। ঘটনাটি গত ১৬ অক্টোবর সোমবার বেলা সাড়ে ১২ টার সময় শহরের মহাজনপট্টি রোডের হাবিব মার্কেটের ৪তলা ভবনের আলফা লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানীর সানসেটে ঘটেছে।
শিশু মহুয়ার মা জান্নাত বেগম চিৎকার করে বলেন, আমার মেয়ের জন্য আপনারা একটু দোয়া করেন, আমি যেন আমার মেয়েকে ফিরে পাই। জানিনা মেয়েটার ভাগ্য কি রয়েছে। প্রত্যক্ষ্যদর্শীরা বলছেন, এমন পরিণতি যেন কারো কপালে না জুটে। আমরা হঠাৎ হাইভোল্টেজ তারে বিকট ফায়ারিং’র শব্দে আতঙ্কিত হয়ে পরি। চোখের পলকেই দেখলাম একটি শিশু বাচ্চা ৪ তলায় হাইভোল্টেজ তারে জড়িয়ে মাটিতে পরে যাচ্ছে। সাধারণ ব্যাবসায়ীরা বলছেন, এমন ঘটনা সহ্য করার মত নয়। রাস্তায় পড়ার পর আমরা কোলে নিয়ে শিশুটিকে সদর হাসপাতালে নিয়ে যাই। বাচঁবে কিনা জানিনা।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, পৌরসভার ৬নং ওয়ার্ডের মহাজনপট্টি রোডের হাবিব মার্কেটের ৪ তলা ভবনটি এ যেন একটি মৃত্যুর ফাঁদ। ওজোপাডিকো’র নগ্ন খোলা হাইভোল্টেজ তার বারান্দার কোল ঘেষে চলে গেছে। স্থানটি মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। ভবন মালিক স্থানটিকে ঝুঁকিমুক্ত না করে আলফা ইনস্যুরেন্স কোম্পানীকে ভাড়া দেন। এখানে প্রতিদিন সাধারণ মানুষের যাতায়াত। এখনই পদক্ষেপ না নিলে ভবিষ্যতে আরো বড় ধরনের দুর্ঘটনাসহ মারাত্মক ঝুঁকির সম্ভবনা রয়েছে।
এই বিষয় নিয়ে হাবিব বিল্ডিং এর ভবন মালিক ফেরদাউস ওয়াহীদ বলেন, হাইভোল্টেজ বিদ্যুতের তার সংরক্ষণ করার দায়িত্ব ওজোপডিকোর, আমার নয়। আমি বিল্ডিং কোড মেনেই এখানে ভবন করেছি। দুর্ঘটনায় আমার কোন দায় নেই।
ওজোপাডিকো’র নির্বাহী প্রকৌশলী মু. ইউসুপ বলেন, সকল দায় ভোলা পৌরসভার এবং ভবন মালিকের। ভবনটির সঠিক নকশা ও ডিজাইনের হেরফের রয়েছে। তারা বিল্ডিং কোড মেনে ভবন তৈরী করলে এমনটি হত না। তাছাড়া ভবন মালিক যদি ভবনের নিরাপত্তার বিষয়ে আমাদের কাছে আবেদন করতেন তাহলে আমরা প্রয়োজনীয় ব্যাবস্থা নিতাম। তিনি আরো বলেন, এই ঘটনাটিসহ আরো ৫টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে ২ জনের মৃত্যু হয়েছে। ভবন মালিকদের বারবার আমরা সতর্ক করছি, কিন্তু কোন কাজে আসছেনা। তাছাড়া শহরের প্রতিটি পোষ্টে ক্যাবল ব্যাবসায়িরা দখলে নিয়েছে। আমি জেলার আইন-শৃঙ্খলা মিটিংএ বারবার বলেছি, কিন্তু কোন কাজ হয়নি। যদি ভোলা পৌরসভা এই বিষয়গুলো নিয়ে সঠিক মনিটরিং করতো তাহলে অবশ্যই শহরে বিল্ডিং সংশ্লিষ্ট সকল দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব হতো।
ভোলা পৌরসভার নকশাকার অনিক ইসলাম বলেন, ভবনটির অনুমোদনের কাগজ আমার কাছে নেই, সম্ভবত ভবন মালিকের কাছে থাকতে পারে। এই মুহুর্তে আমি জানি না ভবনটি নির্মাণে বিল্ডিং কোড মানা হয়েছে কিনা। না মানলে প্রয়োজনীয় ব্যাবস্থা নেয়া হবে।
ভোলা পৌরসভার নির্বাহী প্রকৌশলী মু. জসিম উদ্দিন আরজু বলেন, এই দুর্ঘটনার দায় ওজোপাডিকো ও ভবন মালিকের নিতে হবে। আমরা ভবন মালিককে ডেকে তার কাগজপত্র পর্যালোচনা করে ব্যাবস্থা নেব। তবে তিনি এও স্বীকার করেন যে, কম বেশি দায় সবারই আছে। তবে ভবন মালিক বিষয়টিকে গুরত্ব দেয়া উচিৎ ছিল। আপনারা লেখালেখি করলে কাজ হবে। এছাড়া বিধি মেনেই শহরে ইমারত নির্মাণ আইন বাস্তবায়িত হচ্ছে, কোন অনিয়মের সুযোগ নাই।
ভোলা পৌর শহরটির প্রায়ই বহুতলা ভবন নির্মাণে অনিয়ম করা হয়েছে। ভবন মালিক, পৌরসভা, বিদ্যুৎ বিভাগ, পরিবেশ অধিদপ্তরের সঠিক মনিটরিং ব্যাবস্থা না করার কারনে ভোলা পৌর শহরটি মৃত্যু ফাঁদে পরিনত হয়েছে। এই ফাঁদে যাদের জীবন হানি হয়েছে বা ভবিষ্যতে হবে এমন কোন ঘটনার দায় কোন পক্ষই নেয়নি বা নিবে না বলছেন, সাধারন মানুষ। তারা আরো বলছেন, যদি এখনই কোন ব্যবস্থা না নেয়া হয় তাহলে দিনে দিনে এর পরিধি আরো মারাত্মক আকার ধারন করে শহরের মানুষের জন্য মৃত্যু ফাঁেদ পরিনত হওয়ার শঙ্কা বৃদ্ধি পাবে।
ঘটনার সুত্র ধরে, ইমারত নির্মাণ আইন ২০০৮ ও স্থানীয় সরকার (পৌরসভা) আইন ২০০৯ এর ইমারত নির্মাণ বিধির ৫০ এর ১ (গ)’র ধারা লঙ্ঘন করা হয়েছে ভোলা পৌরসভার নির্মিত অনেক ভবনে। এছাড়াও অনুচ্ছেদের ৩৫,৩৬,৩৭ নং ফর্দ অনুসরন করার অনিয়ম চোখে পড়েছে। সড়ক থেকে ভবনের দুরত্ব, বৈদ্যুতিক লাইন থেকে ইমারতের দুরত্ব, গাড়ী পার্কিং ব্যাবস্থা, ছাদ কার্ণিশ সানসেড নিরাপত্তা নিশ্চিত না করা, জরুরী নির্গমন ব্যাবস্থা না থাকা, সংযোগ স্থাপন, সেটব্যাক নির্দেশনা, কাঠামগত ও নিরাপত্তা কোড ভাইলেশন করা, নকশা ও প্লান পরিবর্তন ও বিধি অনুসরন এবং পরিবর্ধন করা সহ নানান বিষয় সামনে পরিলক্ষিত হয়েছে। তার পরেও বিষয়গুলো নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দায়সারা বক্তব্য দিয়ে তাদের কর্মপরিধীর ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তারা একে অপরের উপর দায় চাপিয়ে ঘটনার আড়াল করার চেষ্টা করেছেন।
এই ঘটনায় শহর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, এই ধরনের নগরায়ণ সারাদেশেই হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনিয়ম আর দূর্ণীতির কুফল সাধারণ মানুষ ভোগ করছেন। কিছু করার নেই। পরিচ্ছণ্য নগরায়নেরে জন্য সরকার যাদের হাতে নিতীমালা ধরিয়ে দিয়েছেন তারাই প্রতিনিয়ত নিতিবিরোধী কাজে জড়িত। তাহলে বিড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধবে কে ? এর থেকে উত্তরনের পথ একটাই, আগে আমাদের মানষিকতায় পরিবর্তন আনতে হবে। তাহলেই সরকারের নিতিমালা মেনে সুন্দর নগরায়ণ করা সম্ভব হবে।
ভোলা পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক তোতা মিয়া বলছেন, ঘটনাটি দুঃখজনক। ভোলা পৌরসভার ইমারত নির্মাণ কমিটির আমি একজন সদস্য, তার পরেও আমার কিছু করার নেই। এই কমিটির সদস্য হলেও ভোলা পৌরসভা কোনদিন আমাকে ডাকেনি। তারা এই বিষয়গুলো নিজেদের মত করে। ভোলা পরিবেশ অধিদপ্তরকে তাদের কোন কাজে আসেনা। এই বক্তব্যে তার কাছে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে তিনি রাজনৈতিক বলয়কে দোষারপ করে বলেন, ইচ্ছা থাকলেও আমাদের করার কিছুই নেই।

ফেসবুকে লাইক দিন

আমাদের সাইটের কোন বিষয়বস্তু অনুমতি ছাড়া কপি করা দণ্ডনীয় অপরাধ।