মধ্যরাত : পর্ব-১৬৬

ড. তাইবুন নাহার রশীদ (কবিরত্ন),

(গত পর্বের পর) : রাতে খেতে বসলাম। ভাত, পাওয়া রুটি, মাংস, নিরাসিষ। আমি সামান্য ভাত খেলাম নিরামিষ দিয়ে। মাংস খেতে কেন জানি ইচ্ছে করছিলনা। ডোরা বলল প্রশান্ত ডিম দেব। আমি বললাম না। সুশান্ত খুব খেল, উমাও মন্দ খেলনা। আমার শরীর খুব ভাল লাগছিল না। সারা পথে বসে থেকে আমার পিঠ কোমর খুব ব্যাথা করছিল। আমি বললাম আমি ঘুমুব। আমার ঘরে গিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। সুন্দর সাদা ধবধবে চাদর, সুন্দর নরম বালিশ, সমস্ত ঘরটায় আগরবাতির গন্ধে কেমন পুত পবিত্র মনে হল। ছোট ববেলা বড়দিও হাত ধরে অনেক সময় পূজোর ঘরে ঢুকতাম। তেমনি যেন সুন্দর পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন। ডোরার আপন হাতের স্নিগ্ধ সুরভি দিয়ে বহুদিনের সঞ্চিত নিগুড় ভালবাসা যেন বিছানাটির প্রাণ কেন্দ্রে জড়িয়ে আছে। যেন আমার কানে কানে বলছে, ওগো সুপ্রিয় আমি যে কতকাল, কতযুগ, তোমার পথ চেয়ে বসে আছি। কত রাত কত নিশিদিন, কত হাজার হাজার বছর তুমি ছাড়া এ বিছানায় কেউ নিদ্রা যায়নি। আমি যেন ঘুমিয়ে পরলাম। অনেক অনেক রাতে মধ্য রাতে যখন শারদীয় পূর্ণিমার বড় চাঁদটা আকাশের এক কোণে হেলে পরেছে। অসংখ্য তারাগুলি ঝিমিয়ে আছে। রাতজাগা পাখী মধ্য রাতের প্রহর ঘোষণা করছে। তখন আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। আমি ঘুম থেকৈ জেগে দেখলাম আমার পাশের ছোট টেবিলে গ্লাসে জল ঢাকা রয়েছে, অতি যতœ সহকারে।
লেসের সাদা কাজ করা ঢাকনা দিয়ে, যেন কত আগ্রহে, কত ভালবাসায়, কত প্রাণ কেন্দ্র জড়িয়ে আছে তার পাতায় পাতায়। আমি জলটুকু খেয়ে উঠে ড্রইং রুমে গিয়ে জানালার কাঁচ তুলে আকাশেল বড় চাঁদটার পানে, নির্নিমেষ নয়নে চেয়ে থাকলাম। ঝিমিয়ে পরা তারাগুলোকে দেখলাম। কত গুলো পাখি কিচির মিচির করে এ ডাল থেকে পাইন গাছের আর এক ডালে গিয়ে বসল। নিস্তব্ধ নিঝুম বনানী, নিরব পৃথিবী, বনবীথির রাজ্যেও যেন শান্ত স্নিগ্ধ ভাব নেমে এসেছে। সবগাছ পালাগুলো যেন বিশ্ব পিতার ধানে আত্মমগ্ন। আমার চোখ ফিরে এলো। ড্রইং রুমের মধ্যে দেখলাম ড্রইং রুমের এক পাশে ডোরা একটা ছোট্ট ডিভান পেতে চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমুচ্ছে। আকাশের চাঁদের মতই ওর সুন্দর মুখ খানা পুত পবিত্র দেখে মনে হয়। এ মুখ আমি ছাড়া কেহ স্পর্শ করে দেখেনি।
আমাকে সুশান্তকে দুটো কামরা ছেড়ে দিয়ে নিজে এমনি করে ঘুমুচ্ছে। আমি শুধু দূর থেকে ওকে অপলক নেত্রে দেখলাম। ওর কাছে যেতে আমার সাহজ হলনা। ভয়, ভক্তি, ভালবাসা আমাকে স্পর্শ করতে বিবেক নিষেধ করল। তবু কাছে বসে ওকে দেখলাম। কোনদিন আমি ওকে এত নিবিড় করে দেখিনি। দীর্ঘকাল, দীর্ঘদিন, দীর্ঘবছর ও আমার জন্য প্রতিক্ষা করে করে মন ওর ফিরে গেছে। সে নাকি আমারই দোষ। একথা সব সময়ই অভিযোগ করে। আজ আমি ওর একান্ত কাছে, নিবিড় করে পাবার এইত সময়। কিন্তু সমাজ, ঐযে আগুন স্বাক্ষী করে মন্ত্র পড়া। ঐ ঘুনে ধরা সমাজের শৃঙ্খলা মানতে গিয়ে ঘটা করে অনুষ্ঠানগুলি সুযোগ-সুবিধার অভাবে না করতে পেরে, দুটো জীবন দুদিকে বেঁকে গেছে।
আস্তে আস্তে পুবের আকাশ ফরসা হয়ে এল। ডোরা স্নিগ্ধ সুন্দর সুশীতল বাতাস আমার মনে শান্তি এনেদিল। আমি আবার গিয়ে নিছানায় আশ্রয় নিলাম। মাথার বালিশটা বুকের কাছে আকরে ধরে কতক্ষণ যে কেঁদেছি। আজ আমার তত মনে নেই। শুধু মনে পড়ে কেঁদে কেঁদে আমার একটু তন্দ্রা এসে গিয়েছিল। কার সুকোমল হাতের স্পর্শ পেয় চোখ মেলে তাকিয়ে দেখি ডোরা। ওর বড় বড় ডাগর ডাগর টানা টানা হারিণের মত দুটো চোখ আমার চোখের উপর নিবদ্ধ রেখে মিষ্টি করে হাসল। আর বলল, রাত্রে ভাল ঘুম হয়েছে-ত ? আমি বললাম ছাই। কেন ? তুমি-ত খুব ঘুমিয়েছ। আমি বললাম। ডোরা বলল কে বলল ? আমি বললাম, আমি গুনে দেখেছি। ডোরা বলল আচ্ছা খুব ভাল গুনতে জানো দেখছি। এমনি করে হাসিতে ঠাট্টায় রাত্রের বিরহটা অনেকটা আনন্দে পরিণত হলো।

(চলবে———–)

ফেসবুকে লাইক দিন

আমাদের সাইটের কোন বিষয়বস্তু অনুমতি ছাড়া কপি করা দণ্ডনীয় অপরাধ।